একটি চরিত্রও কাল্পনিক নয়

কী ভাবে ধরা পড়েছিলেন ছত্রধর মাহাতো? টলিউডের যে কোনও পরিচালক অনায়াসে এ বিষয় নিয়ে ছবি বানাতে পারেন। এমনই সত্য ঘটনা অবলম্বনে এক থ্রিলারের সন্ধান দিলেন সুরবেক বিশ্বাসকী ভাবে ধরা পড়েছিলেন ছত্রধর মাহাতো? টলিউডের যে কোনও পরিচালক অনায়াসে এ বিষয় নিয়ে ছবি বানাতে পারেন। এমনই সত্য ঘটনা অবলম্বনে এক থ্রিলার ‘বেবি’

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৭ মার্চ ২০১৫ ০১:১৫
Share:

ধাতব বস্তুটার শীতল স্পর্শ মাথায় পেয়েই ভেবড়ে গেলেন ছত্রধর মাহাতো!

Advertisement

এতক্ষণ যে সাংবাদিক লালগড় আন্দোলন নিয়ে নানা রকম প্রশ্ন করছিলেন, তিনিই মুহূর্তে অন্য মূর্তি ধারণ করেছেন। ছত্রধরের জামা থেকে ল্যাপেল মাইক্রোফোন খোলার ছুতোয় কাছে গিয়ে ছ’ফুট উচ্চতার সেই টিভি-সাংবাদিক বলিষ্ঠ বাঁ হাত দিয়ে আচমকা পেঁচিয়ে ধরেছেন জনসাধারণের কমিটির নেতার ঘাড়। আর অস্বাভাবিক ক্ষিপ্রতায় সেই সাংবাদিক ডান হাত দিয়ে বার করে এনেছেন নাইন এম এম পিস্তল। যা কৌশলে আটকানো ছিল ক্যামেরার ব্যাগের প্যাডিংয়ে। সাংবাদিকের ক্যামেরাম্যান হিসেবে যিনি ছিলেন, তিনিও একই গুপ্ত জায়গা থেকে বার করে এনেছেন আর একটি আগ্নেয়াস্ত্র।

ছত্রধর বুঝে গেলেন, ওঁরা দু’জন সাংবাদিক বা ক্যামেরাম্যান নন। ছদ্মবেশী পুলিশ। ভেকধারী সাংবাদিক ঝাঁঝালো স্বরে ছত্রধরকে বললেন, “চল, তোর লেকচার অনেক শুনেছি।”

Advertisement

কিন্তু লালবাজারের ওই দুই অফিসারকে ততক্ষণে মাওবাদীদের খাস তালুক লালগড়ের বিরকাঁড় গ্রামে ঘিরে নিয়েছে জনা চল্লিশেক লোক। অনেকেরই হাতে রাইফেল, কারও কারও হাতে তির-ধনুক, তরোয়াল, টাঙি। তখন ‘রিপোর্টার’ তাঁর ‘ক্যামেরাম্যান’-কে বললেন, “টেক বডি পজিশন।” অর্থাৎ দুই পুলিশ অফিসার একে অপরের পিঠে পিঠ ঠেকিয়ে চলবেন। যাতে সামনে-পিছনে নজর রাখা যায়। গাছের উপরে, ঝোপের আড়ালে, আলের ধারে তখন মাওবাদী ‘সেন্ট্রি’-রা বন্দুক তাক করে। কিন্তু দুই অফিসার চেঁচিয়ে বলছেন, “সব হটে যা। আমাদের মারলে তোদের দাদাও কিন্তু মরবে।” বিস্ময়ে, আতঙ্কে ছত্রধরের মুখ দিয়ে বেরোচ্ছে গোঙানির ‘উঁওওও’ আওয়াজ, যার অন্তর্নিহিত অর্থ, ‘কেউ বাবা কিছু করতে যাসনে, না হলে এদের হাতে বেঘোরে মরতে হবে আমাকে।’

২০০৯-এর ২৬ সেপ্টেম্বর, দুর্গাষ্টমীর দুপুরে হওয়া এই সফল ‘অপারেশন ছত্রধর মাহাতো’-র কথা ক’দিন আগে মনে হচ্ছিল নীরজ পাণ্ডের পরিচালনা করা, অক্ষয় কুমারের ‘বেবি’ ছবিটা দেখতে দেখতে। ‘বেবি’ পুরোদস্তুর রুদ্ধশ্বাস এসপায়োনেজ অ্যাকশন থ্রিলার। ছবির পরতে পরতে উত্তেজনা, নাশকতার চক্রান্ত ভন্ডুল করে জঙ্গিদের ধরতে গোয়েন্দা-পুলিশের একের পর এক কুশলী চাল, দু’পক্ষের সংঘর্ষ, ব্যাকরণ না মেনে সম্পূর্ণ নিজের ঝুঁকিতে কাজ করার সিদ্ধান্ত, সরকারের উপরমহলের মধ্যে বিশ্বাস জাগানো যে, সোজা আঙুলে ঘি না উঠলে আঙুল বাঁকা করতেই হবে—মাল্টিপ্লেক্সের নরম ঠান্ডায় বসে চিজ পপকর্ন আর কোলা সহযোগে এ সব দেখার সময়ে অনেক বাঙালিই হয়তো ভেবেছেন, স্ত্রী কিংবা বান্ধবীকে ঠোঁট উল্টে বলেওছেন, অন্য রাজ্যে হলেও হতে পারে, কিন্তু এই রাজ্যের ভেতো বাঙালি পুলিশদের পক্ষে এই ধরনের অপারেশন অসম্ভব। অথচ সেই অসম্ভবই সম্ভব হয়েছিল ছত্রধর মাহাতোকে ধরার বেলায়।

বেবি-তে যেমন অক্ষয় কুমার ভূমিকা নিয়েছেন অজয় সিংহ রাজপুত নামে এক ডাকাবুকো অফিসারের। অপারেশন কার্যকর করার ক্ষেত্রে তিনিই মুখ্য চরিত্র। তেমনই ছত্রধরকে পাকড়াও করায় প্রধান ভূমিকা নেন কলকাতা পুলিশের এক ‘ভেতো বাঙালি’ অফিসার। সেলুলয়েডের পর্দায় অক্ষয় যেমন চরম বিপদ হতে পারে জেনেও সে সবের তোয়াক্কা করেননি, বাস্তবে লালগড়ের মাটিতে সেই অফিসারও একার ঝুঁকিতে অপারেশন শেষ করার দায়িত্ব নেন। ‘ব্যাকআপ টিম’ না পৌঁছনো সত্ত্বেও। ছবিতে ড্যানি ড্যানজোংপা টাস্ক ফোর্সের প্রধান ফিরোজ আলি খানের ভূমিকায়, যিনি অক্ষয়ের উপরে আস্থা রাখেন। অপারেশন ছত্রধর-এর সময়েও সেই জুনিয়র অফিসার যাবতীয় সহযোগিতা পেয়েছিলেন স্পেশ্যাল টাস্ক ফোর্স (এসটিএফ)-এর তদানীন্তন প্রধান রাজীব কুমারের কাছ থেকে। আর সবার মাথার উপরে বটগাছের মতো ছিলেন তৎকালীন পুলিশ কমিশনার গৌতমমোহন চক্রবর্তী। যেমনটি ছবিতে ছিলেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহোদয়।

‘বেবি’-তে অনুপম খের প্রযুক্তিতে দক্ষ গোয়েন্দা অফিসার ওমপ্রকাশ শুক্ল। একটু তিরিক্ষি মেজাজের, যাঁর সঙ্গে পর্দায় অক্ষয় কুমারের বাদানুবাদ হয় প্রায়শই। জঙ্গি চাঁই বিলাল খানকে খতম করার মিশনে সৌদি আরবে যাওয়ার নির্দেশ পেয়ে দু’জনেই টাস্ক ফোর্সের প্রধান ফিরোজকে প্রথমে সাফ জানান, তাঁরা একে অপরের সঙ্গে কাজ করতে অপারগ।

বাস্তবের লালগড়ে অভিযানের সময়ে লালবাজারে তৈরি হওয়া বিশেষ কন্ট্রোল রুম থেকে ছত্রধর মাহাতো এবং সাংবাদিক ও ক্যামেরাম্যানের ছদ্মবেশ ধরা দুই অফিসারের অবস্থান নজরে রাখছিলেন আর এক জন। রিপোর্টারবেশী গোয়েন্দার সঙ্গে কন্ট্রোল রুমে থাকা ওই পুলিশ অফিসারেরও কথায় কথায় ঝগডা হত। কিন্তু ‘মিশন’ সফল করার স্বার্থে সেই বিবাদ আখেরে ধুয়েমুছে যায় সিনেমা ও বাস্তব দু’জায়গাতেই।

আরও কাকতালীয়, অনুপম খের ছবিতে অক্ষয়ের এক সহযোগী রানা দাগ্গুবাতি বা জয়সিংহ রাঠৌরকে তির্যক ভঙ্গিতে ‘টারজান’ বলে সম্বোধন করবেন, যিনি কি না কেবল শারীরিক শক্তিই ধরেন, বুদ্ধি তেমন রাখেন না। বাস্তবেও ছত্রধরের সাক্ষাৎকার নেওয়ার ভান করবেন যিনি, সেই ভুয়ো রিপোর্টারের ভুয়ো ক্যামেরাম্যান ছিলেন কলকাতা পুলিশের কমান্ডো বাহিনীর এক অফিসার। পর্দায় সৌদি আরবের রিসর্টে থাকার সময়েও রানা রোজকার শারীরিক কসরত ছাড়েননি, তেমনই বাস্তবে ঝাড়গ্রামের হোটেলে উঠে ওই কমান্ডো অফিসার মাঝরাতেও ডন বৈঠক করেছেন!

‘বেবি’-তে বিলাল খানকে খতম করতে রাতারাতি কাগজে-কলমে একটি ভুয়ো কোম্পানি তৈরি করে ব্যবসায়িক প্রয়োজনের বাহানা দেখিয়ে তিন অফিসার পাড়ি দেবেন সৌদি আরবে। আর ছত্রধর ও লালগড়ের মাওবাদীদের কাছাকাকাছি পৌঁছতে গোয়েন্দা অফিসার নিজেকে ‘এশিয়ান নিউজ এজেন্সি’-র ফ্রি-ল্যান্স সাংবাদিক বলে পরিচয় দিয়েছিলেন। ওই সংবাদ সংস্থার বাস্তবে অস্তিত্বই নেই। সৌদি আরবে যাওয়া ভারতীয় গোয়েন্দা দলকে সাহায্য করেছিলেন সে দেশের নাগরিক শুভাকাঙ্ক্ষী মিকাল জুলফিকার, সিনেমায় যিনি আশফাক। রিপোর্টার সাজা পুলিশ অফিসারও পেয়েছিলেন এ রকম এক সাধারণ মানুষের সাহায্য।

২০০৯-এর জুলাইয়ের শেষ সপ্তাহ। জঙ্গলমহলে প্রাণহানি, ল্যান্ডমাইন বিস্ফোরণ, গুলি চলা— এ সব তখন নিত্যদিনের ঘটনা। প্রশাসনের হাত থেকে একটার পর একটা তল্লাট ছিনিয়ে নিজেদের দখলে নিচ্ছে মাওবাদীরা। খাস ঝাড়গ্রামে প্রবেশও তখন গোয়েন্দা-পুলিশ-আধা সামরিক বাহিনীর কাছে আতঙ্কের। অথচ ছত্রধরের কাছে পৌঁছতে হলে ঘনিষ্ঠ হওয়া বাধ্যতামূলক তখন মাওবাদীদের অতি বিশ্বস্ত, ঝাড়গ্রামেরই বাসিন্দা এক সাংবাদিকের কাছে। টেলিফোনে তত দিনে সেই সাংবাদিকের সঙ্গে আলাপ জমিয়ে ফেলেছেন পুলিশ অফিসার। হাওড়া থেকে ট্রেনে খড়্গপুর পৌঁছলেন তিনি। সেখানেই তার জন্য শুভাকাঙ্ক্ষী ব্যক্তি অপেক্ষা করছিলেন একটি আই টেন গাড়ি নিয়ে। তিনিই জোগাড় করেন দুর্ঘটনায় পা ভাঙা এক ব্যক্তিকে। যাঁকে বসানো হয় চালকের আসনের পাশে। যাতে মাওবাদীরা পথ আটকালেও কিছু সন্দেহ না করতে পারে। মাওবাদী-ঘনিষ্ঠ সাংবাদিকের বাড়ির কাছে অফিসারকে পৌঁছে দেন সেই শুভাকাঙ্ক্ষী।

ঝাড়গ্রামের সেই সাংবাদিকের মন ভেজাতে ভুয়ো সাংবাদিক নিয়ে যান এক উপহার। সাংবাদিকের স্ত্রীর জন্য। এক্সক্লুসিভ ডিজাইনের একটি শাড়ি, তখনই দাম ছিল সাড়ে তিন হাজার টাকা। অফিসার তাঁর স্ত্রীর পরামর্শে সেটা কেনেন। ওই এক শাড়ি পেয়ে মাওবাদী-ঘনিষ্ঠ সাংবাদিকই শুধু নন, তাঁর পরিবারও গলে গেলেন। সেপ্টেম্বরে মাওবাদী-ঘনিষ্ঠ রিপোর্টারই ঝাড়গ্রাম জেলের কাছে একটি হোটেলে ওই পুলিশ অফিসারের থাকার ব্যবস্থা করে দিলেন। ঠিক হল, ছত্রধরের কাছ থেকে সবুজ সঙ্কেত পাওয়া গেলেই লালগড়ের উদ্দেশে যাত্রা করা হবে। গোয়েন্দার কাছে দ্বিতীয় একটি মোবাইল ফোন ছিল, যার মাধ্যমে তিনি যোগাযোগ রাখতেন লালবাজারের সঙ্গে। কিন্তু প্লাস্টিকে মোড়া অবস্থায় সেই ফোনটা লুকনো থাকত কমোডের সিস্টার্নে! এমন ভাবে, যাতে ফ্লাশও করা যায় অথচ ফোনেরও ক্ষতি না হয়।

সপ্তাহ খানেক কাটানোর পর খবর এল, ছত্রধর অষ্টমীর দুপুরে সাক্ষাৎকারের সময় দিয়েছেন। কিন্তু ক্যামেরাম্যান? সপ্তমীর গভীর রাতে ঝাড়গ্রামের হোটেলে ঢুকলেন ক্যামেরাম্যান, আসলে কলকাতা পুলিশেরই এক কমান্ডো। তাঁর সঙ্গে আনা ক্যামেরার ব্যাগে লুকনো দু’টো পিস্তল আর কয়েকটি মাইক্রো জিপিএস (গ্লোবাল পজিশনিং সিস্টেম)-ডিভাইস। সাধারণ বোতাম বা পেনের মতো দেখতে, যেগুলো কন্ট্রোল রুমে সঙ্কেত দেবে ওই দুই অফিসারের অবস্থানের। ওই সব জিনিসপত্রে সুসজ্জিত হয়েই অষ্টমীর সকাল ন’টা নাগাদ ঝাড়গ্রাম থেকে দুই ছদ্মবেশী পুলিশ অফিসার কয়েক জন সত্যিকার সাংবাদিকের সঙ্গে মোট তিনটি মোটর বাইকে পাড়ি দিলেন লালগড়ের উদ্দেশে।

ঠিক ছিল, একান্ত সাক্ষাৎকার নেওয়ার সময়ে তিনি মিনিট তিনেক ঠায় এক জায়গায় থাকবেন, মোটেই নড়বেন না। এতেই বোঝা যাবে, ছত্রধর তাঁর হাতের মধ্যে। সেই জায়গায় ওই অফিসার বারো মিনিট অপেক্ষা করার পরেও দেখলেন, অ্যারেস্টিং টিমের কারও টিকিটিরও দেখা নেই। তখন সম্পূর্ণ একার সিদ্ধান্তে তিনি ছত্রধরকে পাকড়াও করেন তাঁর সতীর্থ কমান্ডোর সাহায্যে। ‘বেবি’-তে ঠিক যে ভাবে বিলাল খানকে গুলিতে খতম করার পর গোয়েন্দা-অফিসার অজয় রিসর্টের সেই স্যুইটেই অপ্রত্যাশিত ভাবে শীর্ষ জঙ্গিনেতা মৌলানা সইদ রহমানকে পেয়ে যান এবং একার সিদ্ধান্তে তাঁকে জীবিত অবস্থায় ভারতে আনার পরিকল্পনা করেন।

কিন্তু ছত্রধরের ক্ষেত্রে অ্যারেস্টিং টিম সময় মতো পৌঁছলো না কেন? তারা নাকি জিপিএস ডিভাইসের সঙ্কেত পেলেও দিশা ভুল করে ফেলেছিলেন!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন