বলিউডের অন্যতম গায়ক-নায়ক অভিনেতা অশোককুমার। ছবি: সংগৃহীত।
হিরো বদল
গপ্পোটা এই রকম।
১৯৩৫-৩৬ সাল নাগাদ বম্বের (অধুনা মুম্বই) অন্যতম ডাকসাইটে স্টুডিয়ো ‘বম্বে টকিজ়’-এর মালিক এবং পরিচালক হিমাংশু রায়ের নতুন ছবি ‘জীবন নাইয়া’র শুটিং বেশ খানিকটা এগিয়ে গিয়েছে। নায়িকা হিমাংশুর স্ত্রী দেবিকারানি, নায়ক নাজ়মুল হুসেন।
দেবিকারানি তখনই খ্যাতির শীর্ষে। তাঁর বিপরীতে ‘জওয়ানি কি হাওয়া’ ছবিতে অভিনয় করে নাজ়মুলেরও বেশ নামডাক হয়েছে। সেকালের ধারা অনুযায়ী, তিনি বম্বে স্টুডিয়োর বেতনভোগী অভিনেতাও বটে। ‘জীবন নাইয়া’ করতে করতেই দু’জনের ঘনিষ্ঠতা চিত্রনাট্যের প্রয়োজন ছাপিয়ে উভয়ের ব্যক্তিজীবনে উপচে পড়ে। এমতাবস্থায় হঠাৎই একদিন দেবিকা-নাজ়মুল জুটি ‘জীবন নাইয়া’, বম্বে টকিজ় এবং হিমাংশু রায়ের জীবনের নৌকা বেসামাল করে স্টুডিয়ো এবং শহর ছেড়ে অন্যত্র পাড়ি দেন। বলাবাহুল্য, গোপনে। পারিবারিক কেলেঙ্কারির আঁচের চেয়েও হিমাংশুকে অধিকতর কাবু করে ফেলে ছবির অর্থলগ্নিকারী তথা পাওনাদারদের তাগাদা।
বিস্তর খোঁজখবরের পর জানা যায়, দেবিকা ও নাজ়মুল কলকাতার গ্র্যান্ড হোটেলে ডেরা গেড়েছেন। হিমাংশু তাঁর সহকারী শশধর মুখোপাধ্যায়কে কলকাতা পাঠান দেবিকাকে ফিরিয়ে আনার জন্য। শোনা যায়, অনেক বোঝানোর পরে দেবিকা মোটা অর্থ এবং কিছু আনুষঙ্গিক শর্তের বিনিময়ে বম্বে ফিরতে রাজি হন এবং ফেরেনও। কিন্তু নাজ়মুল হুসেনের ফিল্মি কেরিয়ার কার্যত সেখানেই খতম হয়ে যায়।
ফের তোড়জোড় করে ছবি তো শুরু হবে, কিন্তু নায়ক কই? ‘বম্বে টকিজ়’-এর এক তরুণ ল্যাব অ্যাসিস্ট্যান্টকে বাগানে সিগারেট ফুঁকতে দেখে তাঁর উপরে নজর পড়ে হিমাংশুর। কুমুদলাল গঙ্গোপাধ্যায় নামে তরুণটিকে তিনিই প্রস্তাব দেন নায়কের ভূমিকায় অভিনয় করার। কুমুদলাল নামটা সিনেমার পর্দায় ঠিক লাগসই হবে না ভেবে হিমাংশুই নবাগত হিরোর নতুন নামকরণ করেন— অশোককুমার।
‘অচ্ছুৎ কন্যা’ ছবিতে দেবিকারানির সঙ্গে অশোককুমার। ছবি: সংগৃহীত।
গোড়ার দিকে সিনেমায় অভিনয় করার আগ্রহ একেবারেই ছিল না কুমুদলালের। বরং অল্প বয়স থেকেই তিনি আগ্রহী ছিলেন সিনেমার প্রযুক্তিগত বিষয়ে। জবলপুরের কলেজ থেকে স্নাতক হয়ে কলকাতায় আইন পড়তে এসেছিলেন বাবা কুঞ্জলাল গঙ্গোপাধ্যায়ের নির্দেশে। কিছুদিন আইন পড়ার পর পরীক্ষায় বসার ফি-এর টাকায় ট্রেনের টিকিট কিনে তিনি পাড়ি দেন মুম্বই। সেখানে তাঁর শ্যালক শশধর মুখোপাধ্যায় তখন হিমাংশু রায়ের ডানহাত, ‘বম্বে টকিজ়’-এর অন্যতম কর্ণধার। কুমুদলালের পরিকল্পনা ছিল, হিমাংশু রায়ের সুপারিশপত্র নিয়ে তিনি সিনেমার টেকনিক্যাল কাজ শিখতে জার্মানি যাবেন। অবশ্য ঘটনাচক্রে, শশধরের সুপারিশে তিনি ‘বম্বে টকিজ়’-এই ল্যাবরেটরি অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসাবে নিযুক্ত হলেন।
হিন্দি সিনেমার ইতিহাসে প্রথম সুপারস্টার অশোক কুমারের অভিনয়ে আসা যেমন নাটকীয়, তেমনই অ-নাটকীয় অভিনেতা হিসাবে তাঁর বিবর্তনের ইতিহাস। অভিনয়ে অনিচ্ছুক কুমুদলালকে গোড়ায় নাকি শুনতে হয়েছিল, চোয়াল এবং থুতনির গড়নের কারণে ছবির পর্দায় ওঁকে খুব একটা মানাবে না! ‘জীবন নাইয়া’ মুক্তি পায় ১৯৩৬ সালে। মোটামুটি চলেও। সে-বছরেই মুক্তি পায় দেবিকারানির বিপরীতে তাঁর দ্বিতীয় ছবি এবং প্রথম সুপারহিট ‘অচ্ছুৎকন্যা’। ছবি সুপারহিট হলেও অশোককুমারের অভিনয়ের আড়ষ্টতা এবং নার্ভাসনেস তাতে স্পষ্ট। এ নিয়েও গল্প আছে। অশোককুমার নিজেই জানিয়েছিলেন, গোড়ায় অভিনয়ের তিনি কিছুই বুঝতেন না। তখনকার নামজাদা নায়িকা এবং সর্বোপরি তিনি যে প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন, সেখানকার ‘মালকিন’ দেবিকারানির হিরো হিসাবে কাজ করবেন, এটা ভেবেই নাকি তাঁর ‘শিরদাঁড়ায় ঠান্ডা স্রোত বয়ে গিয়েছিল’! শেষোক্ত উপলব্ধিতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই— দেবিকা-নাজ়মুলের কাহিনি তখনও জনস্মৃতিতে টাটকা।
অনিচ্ছুক নায়ক থেকে দুঁদে অভিনেতা
‘জীবন নাইয়া’ ও ‘অচ্ছুৎ কন্যা’র অভিনয়ের সময়ে দেবিকার হাত ধরতেও নাকি অশোককুমারের হাত কাঁপত। পরিচালক ফ্রানৎস অস্টেন (‘বম্বে টকিজ়’-এর বেতনভোগী পরিচালক অস্টেন এবং সিনেমাটোগ্রাফার জোসেফ হ্বিরসিঙ— দু’জনকেই জার্মানি থেকে নিয়ে এসেছিলেন হিমাংশু রায়। নাৎসি দলের সমর্থক হওয়ায় অস্টেনকে ১৯৩৯ সালে গ্রেফতার করে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়া পর্যন্ত জেলে রেখেছিল ব্রিটিশ পুলিশ), হিমাংশু এবং স্বয়ং দেবিকারানিকে পর্যন্ত নবাগত নায়ককে বোঝাতে হয়, এটা অভিনয়ের অঙ্গ! অশোককুমারের কেরিয়ারের শুরুর দিক নিয়ে লেখক-চিত্রনাট্যকার নবেন্দু ঘোষ লিখেছেন, প্রথম কয়েকটি ছবি মুক্তি পাওয়ার পর অনেকেই অশোককুমারের প্রশংসা করেন। কিন্তু প্রায় সকলের মুখেই শোনা যেত, ‘অচ্ছা হ্যায়, মগর দিল খোল কর কাম করো’। দিল খোলকর? এর মানে কী? অশোককুমার বুঝলেন, লোকে যেটা বলছে, তিনি নিজেও সেটা আঁচ করছেন। কোথাও একটা গন্ডগোল হচ্ছে। হিমাংশু রায়ের পরামর্শে তিনি অভিনয়ের টেকনিক্যাল দিকগুলির উপরে নজর দিতে শুরু করেন। বিদেশি ছবির নায়কদের, বিশেষ করে রোনাল্ড কোলম্যান, স্পেন্সার ট্রেসির মতো সে-যুগের হলিউড তারকাদের কাজ খুঁটিয়ে দেখতে শুরু করেন। অভিনয় শিক্ষায় সবচেয়ে বেশি সহায়তা পান শশধরের কাছে। তিনি নিজেই বলতেন, ‘শশধর নিজে অভিনয় করেন না, কিন্তু ওঁর মতো ট্রেনার দুর্লভ’। এর পাশাপাশি, অভিনয়ের পদ্ধতি শেখার জন্য নিয়মিত বিদেশি বইপত্র ঘেঁটে দিনের পর দিন ব্যক্তিগত ভাবে সেগুলির অনুশীলন করতেন অশোককুমার। শিখতেন সহ-অভিনেতাদের থেকেও।
তপন সিংহ পরিচালিত বাংলা ছবি ‘হাটেবাজারে’র একটি দৃশ্যে অশোককুমার। ছবি: সংগৃহীত।
নবেন্দু ঘোষ আরও লিখেছেন, ‘সংলাপ কমিয়ে স্রেফ চোখ দিয়ে কতখানি অভিনয় করা যায় সেটা দাদামণি (অশোককুমার) বোঝেন লীলা চিটনিসের সঙ্গে অভিনয় করতে গিয়ে।’ দেবিকারানির বিপরীতে ‘অচ্ছুৎ কন্যা’র বিপুল জনপ্রিয়তার পর অশোককুমারের পরের বেশ কয়েকটি ছবির নায়িকা ছিলেন হিন্দি ছবির সম্ভবত প্রথম গ্র্যাজুয়েট অভিনেত্রী লীলা চিটনিস। গজেন্দ্রকুমার মিত্রের কাহিনি ‘রজনীগন্ধা’ অবলম্বনে শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের চিত্রনাট্য থেকে তৈরি ছবি ‘কঙ্গন’ (১৯৩৯) অশোককুমার-লীলা চিটনিস জুটির প্রথম ছবি। মুক্তির পর ছবিটি বিপুল জনপ্রিয়তা পায়। এর পর ওই জুটির উপর্যুপরি দু’টি ছবি বন্ধন (১৯৪০) এবং ঝুলা-ও (১৯৪১) সিলভার জ়ুবিলি উদ্যাপন করে।
অভিনয়ের বিস্তার
নায়ক হিসাবে জনপ্রিয়তার শীর্ষ থাকার সময়েই অশোককুমার সে আমলের চলচ্চিত্র-বিধির বাইরে গিয়ে একটি বড় ঝুঁকি নেন জ্ঞান মুখোপাধ্যায়ের ‘কিসমত’ (১৯৪৩) ছবিতে অ্যান্টি-হিরোর ভূমিকায় অভিনয় করে। ঘটনাচক্রে, ছবিটি হয়ে ওঠে হিন্দি ছবি, বরং বলা ভাল, ভারতীয় চলচ্চিত্রের প্রথম ‘ব্লকবাস্টার’! ‘বক্স অফিস ইন্ডিয়া’র পরিসংখ্যান বলছে, কলকাতায় কেবল রক্সি সিনেমা হলেই ছবিটি চলেছিল টানা ১৮৪ সপ্তাহ! এই জনপ্রিয়তা পরবর্তী কালে ‘শোলে’ বা ‘হম আপকে হ্যয় কৌন’-ও ছুঁতে পারেনি। ‘কিসমত’-এর দরুণ অশোককুমারের জনপ্রিয়তা হয় আকাশছোঁয়া। সে সম্পর্কে তাঁর ঘনিষ্ঠ সুহৃদ তথা উর্দু সাহিত্যের প্রখ্যাত লেখক সাদাত হাসান মান্টোর স্মৃতিচারণ, ‘অশোকের জনপ্রিয়তা হু-হু করে বাড়ছিল। ও কমই বেরোত, কিন্তু ওকে দেখামাত্র বম্বের রাস্তায় ভিড় জমে যেত। গাড়ি-ঘোড়া থেমে রাস্তাঘাট স্তব্ধ হয়ে যেত। পুলিশকে লাঠি চালিয়ে সেই ভিড় সরাতে হত’।
শুধু জনপ্রিয়তার নিরিখে নয়, বস্তুত ‘কিসমত’ ছবিতেই আমরা প্রথম অশোককুমারের বিশিষ্ট অভিনয়শৈলীর উন্মেষ দেখতে পাই। মার্জিত, সপ্রতিভ, বুদ্ধিদীপ্ত, অনুভূতির চাপা এবং সংযত প্রকাশ— চলচ্চিত্রের উপযোগী অভিনয় কৌশলের এ-হেন নিপুণতা এ-দেশে যাঁদের হাত ধরে আসে, অশোককুমার সেই অতি-বিশিষ্ট অগ্রপথিকদের অন্যতম। হিন্দি ছবির নায়ক হিসাবে তিনি যখন কেরিয়ারের তুঙ্গে, তখনই, অর্থাৎ ১৯৪৬-৪৭ সালে আবির্ভাব ঘটে ভারতীয় চলচ্চিত্রের তিন ‘আইকনিক’ নায়ক— দিলীপকুমার, দেব আনন্দ এবং রাজ কপূরের। এঁদের তিন জনের গোড়ার দিকের কাজে অশোককুমারের প্রভাব যথেষ্টই দেখা যায়।
নতুন হিরো হিসাবে ওই ত্রয়ী বেশ দ্রুত নিজেদের জায়গা করে নিলেও অশোককুমারের চাহিদা কমেনি। ‘কিসমত’ থেকেই তাঁর কাজের ধরনে স্পষ্ট হয় ভারতীয় ছবির নায়কের প্রথাসিদ্ধ ছক ভেঙে পরিণত চরিত্রের ভূমিকায় নিজেকে ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা। ভারতীয় প্রায় সব বাণিজ্যিক ছবিতেই নৈতিকতা, ভাল-মন্দের সীমানাগুলি সচরাচর সাদা-কালো রেখায় টানা হয়। বাণিজ্যিক ছবির অভিনেতা অশোককুমার দু-একটি ব্যতিক্রম বাদ দিলে সারা জীবন ওই ধাঁচের অজস্র ছবিতে কাজ করেছেন। কিন্তু সেখানেও তাঁর নজর পড়েছে স্বাভাবিক মানুষের মনস্তাত্ত্বিক জটিলতা ও তাঁদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের উপরে। একটা উদাহরণ দিলে বোধকরি বক্তব্যটি স্পষ্ট হবে। অশোককুমারের অ্যান্টি হিরো অথবা ভিলেন চরিত্র কিন্তু কখনওই একমাত্রিক নয়। এ প্রসঙ্গে বিশেষ ভাবে উল্লেখ্য জ্ঞান মুখোপাধ্যায়ের ‘সংগ্রাম’ (১৯৫০) ও দেব আনন্দের ‘জুয়েল থিফ’ (১৯৬৭) ছবি দু’টি। আবার, এম ভি রামনের ‘ভাই-ভাই’ (১৯৫৬), ফণী মজুমদারের ‘আরতি’ ও কালিদাসের ‘ভিগি রাত’-এর মতো (১৯৬৫) ছবিতে অশোককুমার যে-ভাবে তাঁর অভিনীত চরিত্রগুলিকে ফুটিয়ে তুলেছেন, সেগুলি আক্ষরিক অর্থেই ধূসর, দ্ব্যর্থব্যঞ্জনায় পরিপুষ্ট।
তপন সিংহ পরিচালিত বাংলা ছবি ‘হাটেবাজারে’র একটি দৃশ্যে অশোককুমার ও অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়। ছবি: সংগৃহীত।
নড়ে বসেছিল পুলিশও!
একটা মজার ঘটনার উল্লেখ করা যেতে পারে। নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু এবং আইএনএ-র যুদ্ধের সূত্র ধরে রমেশ সায়গলের স্পাই থ্রিলার ‘সমাধি’ (১৯৫০) ছিল সে-সময়ের সুপার-সুপারহিট ছবি। ছবির মুখ্য ভূমিকায় ছিলেন অশোককুমার। ছবিতে অভিনেতা অশোকের হাতে পুলিশবাহিনীকে বার বার নাস্তানাবুদ হতে দেখা যায়। ফলে, বাস্তবেও পুলিশের কর্মদক্ষতা নিয়ে শুরু হয়ে যায় কটাক্ষ। সেটা এমন পর্যায়ে পৌঁছোয় যে, বম্বের তদানীন্তন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মোরারজি দেশাইয়ের নির্দেশে পুলিশের সমন যায় অশোককুমারের কাছে! তাঁকে বলা হয়, ছবিটি প্রেক্ষাগৃহ থেকে অবিলম্বে প্রত্যাহারের ব্যবস্থা করতে হবে। এমনকি, এও বলা হয়, পরের ছবিতে তাঁকে একজন সাহসী, দায়িত্ববান পুলিশ অফিসারের ভূমিকায় অভিনয় করতে হবে! সরকারি নির্দেশে ‘সমাধি’ ছবিটি মহারাষ্ট্রে নিষিদ্ধ করা হয়।
অন্য অশোককুমার
শুধু অসামান্য অভিনেতা নন, দক্ষ চিত্রশিল্পী ছিলেন অশোককুমার। তাঁর আঁকা ছবি জাহাঙ্গির আর্ট গ্যালারি-সহ একাধিক জায়গায় প্রদর্শিত হয়েছে। শোনা যায়, হিন্দি, ইংরেজি, বাংলা, উর্দু-সহ মোট আটটি ভাষা তিনি জানতেন। দাবা খেলোয়াড় এবং হোমিয়োপ্যাথি চিকিৎসক হিসাবেও তাঁর সুনাম ছিল। আবার তাঁর সম্পর্কে অনেকের স্মৃতিচারণায় জানা য়ায়, আদ্যন্ত জীবনরসিক মানুষটি ছিলেন অতিশয় বদমেজাজিও! এ নিয়ে তাঁর কনিষ্ঠ কন্যা প্রীতি গঙ্গোপাধ্যায় এক বার মন্তব্য করেন, ‘এক দিন বাবা মায়ের উপরে রাগ করে ঘরের জিনিসপত্র ছুড়ে-ছুড়ে ভাঙছিলেন। ভাঙার জন্য একটা ফুলদানি হাতে নিতেই আমি পাশ থেকে বলে উঠি, এটা কিন্তু খুব দামি। বাবা সঙ্গে-সঙ্গে সেটা নামিয়ে রেখে নিচু গলায় জিগ্যেস করলেন, তা-হলে সস্তার কি ভাঙা যায় বল তো?’
দাদামণি হয়ে ওঠা
অশোককুমারের বিখ্যাততম ছবিগুলির মধ্যে রয়েছে প্রথম হিন্দি ‘হরর’ ছবি কামাল আমরোহি’র ‘মহল’ (১৯৪৯), রমেশ সায়গলের ‘সমাধি’ (১৯৫০) বিমল রায়ের ‘পরিণীতা’ (১৯৫৩), সত্যেন বোসের ‘চলতি কা নাম গাড়ি’ (১৯৫৮), শক্তি সামন্তের ‘হাওড়া ব্রিজ’ (১৯৫৮), বিলি ওয়াইল্ডারের ‘উইটনেস ফর দ্য প্রসিকিউশন’-এর আদলে বি আর চোপড়ার ‘কানুন’ (১৯৬০), বি আর চোপড়ার ‘গুমরাহ’ (১৯৬৩), বিমল রায়ের শেষ ছবি ‘বন্দিনী’ (১৯৬৩), অসিত সেনের ‘মমতা’ (১৯৬৬), কামাল আমরোহির ‘পাকিজা’ (১৯৭২), বাসু চট্টোপাধ্যায়ের ‘শওকিন’ (১৯৮২)।
‘চলতি কা নাম গাড়ি’ ছবিতে অশোককুমার, কিশোরকুমার ও অনুপকুমার। ছবি: সংগৃহীত।
বাংলায় হাতেগোনা কয়েকটি ছবিই করেছেন অশোক কুমার। তাঁর অভিনীত প্রথম বাংলা ছবি দেবকী বসুর ‘চন্দ্রশেখর’ (১৯৪৭)। এর প্রায় ১৩ বছর পর তাঁর দ্বিতীয় বাংলা ছবি সুচিত্রা সেনের সঙ্গে সুশীল মজুমদারের ‘হসপিটাল’ (১৯৬০)। বনফুলের কাহিনি অবলম্বনে তপন সিংহের ‘হাটে বাজারে’ (১৯৬৭)। তবে এটি শুধু অশোককুমারের অভিনয় নয়, বৈজয়ন্তীমালা, ছায়া দেবী এবং অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়ের অভিনয়ের কারণেও স্মরণীয়। ১৯৮০ এবং ১৯৯০-র দশকে বেশ কয়েকটি হিন্দি টিভি সিরিয়ালে তাঁর কাজ যাঁরা দেখেছেন, তাঁরা নিশ্চয়ই আজও ভোলেননি। প্রথম হিন্দি সিরিয়াল ‘হমলোগ’ ও রামানন্দ সাগরের ‘রামায়ণে’র প্রথম এপিসোডের ভাষ্যকার ছিলেন অশোককুমার। ১৯৯০-র দশকের গোড়ায় বাসু চট্টোপাধ্যায়ের পরিচালনায় কনিষ্ঠ ভ্রাতা অনুপকুমারের সঙ্গে ‘ভীম ভবানী’ ছিল কৌতুকমিশ্রিত গোয়েন্দা কাহিনির ধাঁচে জনপ্রিয় সিরিয়াল।
১৯৩৬ সালে শুরু করে ১৯৯৭ সালে অবসর নেওয়া পর্যন্ত প্রায় ৬৩ বছর টানা কাজ করেছেন অশোককুমার। বয়স বাড়লেও তার ছাপ অভিনয়ে কখনওই পড়তে দেননি। বরং সেই অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে আরও বেশি পরিণত করে তুলেছেন নিজের ক্র্যাফ্ট-কে। পৌত্র-দৌহিত্রদের বয়সি অভিনেতা-অভিনেত্রীদের সঙ্গে কাজ করেছেন তাঁদের সঙ্গে পা মিলিয়ে। একটা সময়ে সবচেয়ে বর্ষীয়ান, অথচ সবচেয়ে সক্ষম অভিনেতা হিসাবেই ভারতীয় চলচ্চিত্রের এই অগ্রপথিক হয়ে উঠেছিলেন সহশিল্পী ও অনুরাগীদের ‘দাদামণি’।
আজও তিনি প্রবলভাবে প্রাসঙ্গিক
অশোককুমার যে-সময়ে কাজ শুরু করেছিলেন, সে আমলের অধিকাংশ ছবিই আজকের দিনে সাধারণ ভাবে দর্শকের পক্ষে উপভোগ করা কঠিন। তার একটি বড় কারণ অভিনয়ের ধরনে পরিবর্তন। থিয়েটারের মতো তখনকার সিনেমার অভিনয়ের ধারাতেও ছিল চড়া দাগের নাটকীয় ভাব। দক্ষ অভিনেতাদের হাতে সেটা এক রকম মানিয়ে গেলেও অধিকাংশের হাতে সেটা হ্যাম অ্যাক্টিং-এর স্তরেই আটকে থাকত। ভারতীয় চলচ্চিত্রে যাঁরা স্বাভাবিক অভিনয়ের সূচনা করেছিলেন, অশোককুমার সেই বিরল প্রতিভাদের একজন। এই স্বাভাবিক অভিনয়ের অনেকগুলি বৈশিষ্ট্য রয়েছে, যার একটি মূল্যবান বৈশিষ্ট্য হল সংলাপ। এ বিষয়ে অশোককুমারেরই এক সাক্ষাৎকারে শুনি, ‘নতুন অভিনেতাদের অনেককেই বলি সংলাপ মুখস্থ করে আউড়ে যেয়ো না। সেটা আত্মস্থ করে নিজের করে তোলো। নিজের স্বাভাবিক বাচনভঙ্গির মধ্যে নিয়ে এসো’। একজন অভিনেতার পক্ষে তার ‘নিজস্ব ভাষা’য় কথা বলতে শেখা খুবই জরুরি শিক্ষা।
সিনেমা-অনুরাগী আধুনিক দর্শকের কাছে অশোককুমারের কাজ আজও উপভোগ্য। পাশাপাশি, ভারতীয় চলচ্চিত্র শিল্পের বিবর্তনের ধারা বুঝতে গেলেও তাঁর কাজের সমগ্রতাকে এড়িয়ে যাওয়ার কোনও উপায় নেই। তবে, আজকের দিনেও অশোককুমার নামে অভিনেতাটি বোধকরি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অভিনয়ের শিক্ষার্থীদের কাছে। যে কোনও শ্রেষ্ঠ অভিনেতার কাজের মধ্যেই আত্মগোপন করে থাকে তাঁর শৈল্পিক প্রয়োগপদ্ধতির প্রকৌশল। তার নানা প্রকোষ্ঠ, নানান স্তর। অতীতের কাছে আধুনিককে সেটাও শিখতে হয়, আপন সমকালীন প্রাসঙ্গিকতা ধরে রাখার জন্য।
তথ্যসূত্র: অশোক ভালিচা, ‘দাদামণি: দ্য অথরাইজ়ড বায়োগ্রাফি অফ অশোককুমার’; নবেন্দু ঘোষ, ‘অশোককুমার: হিজ় লাইফ অ্যান্ড টাইমস’; সাদাত হাসান মান্টো, ‘স্টারস ফ্রম অ্যানাদার স্কাই: দ্য বম্বে ফিল্ম ওয়ার্ল্ড অফ দ্য ১৯৪০-স’। ইউটিউবে অশোক কুমারের সাক্ষাৎকার এবং কিছু পুরনো পত্রপত্রিকা।