Jeet Ganguly

Bappi Lahiri Death: নারী চরিত্র বেজায় জটিল.... প্রথম বুঝেছিলাম বাপ্পিদার ‘ওগো বধূ সুন্দরী’র গান শুনে

এই মানুষগুলো চলে গেলে আমরা কী নিয়ে বাঁচব বলতে পারেন? বাঙালিই বা আর কী নিয়ে গর্ব করবে?

Advertisement

জিৎ গঙ্গোপাধ্যায়

কলকাতা শেষ আপডেট: ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২২ ১২:০১
Share:

প্রয়াত বাপ্পি লাহিড়ি।

বলিউডের ‘বেতাজ বাদশা’। বাপ্পি লাহিড়ী বাংলাকেও দু’হাত ভরে দিয়ে গিয়েছেন। আরতি মুখোপাধ্যায়ের গাওয়া ‘তখন তোমার একুশ বছর বোধহয়’ যেন নতুন প্রজন্মের কথা ভেবেই তৈরি। সময়ের বেড়া ডিঙিয়ে যে গান আজও সমসাময়িক। নারী চরিত্র যে বেজায় জটিল, তা আমি অন্তত জেনেছিলাম বাপ্পিদার সুর করা গান থেকেই। উত্তমকুমারের শেষ ছবি ‘ওগো বধূ সুন্দরী’। অদ্ভুত ভাবে ছবির প্রতিটি গান জনপ্রিয়। ‘আমি একজন শান্তশিষ্ট’, ‘শুধু তুমি নয় অবলাকান্ত’, ‘এই তো জীবন’, ‘দেখো বাবু খেলা দেখো রে’, ‘নারী চরিত্র বেজায় জটিল’--- কোনটা ছেড়ে কোনটা বলব?

Advertisement

একই কাণ্ড ঘটেছে ‘অমরসঙ্গী’, ‘গুরুদক্ষিণা’, ‘মঙ্গলদীপ’ ছবিতেও। আজও প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায় মঞ্চ বা মাচা যেখানেই যান, নেপথ্যে বাজবেই ‘চিরদিনই তুমি যে আমার...আমরা অমরসঙ্গী।’ বুম্বাদা নিজেও সেই ছন্দে পা মেলান। গেয়ে ওঠেন নিজেও। একই ভাবে পুজো প্যান্ডেল থেকে বিয়েবাড়িতে হইহই করে বেজেছে ‘এ আমার গুরুদক্ষিণা’। প্রভাত রায়ের ছবি ‘প্রতিদান’-এর প্রার্থনা সঙ্গীত ‘মঙ্গলদীপ জ্বেলে অন্ধকারে দু’চোখ আলোয় ভরো প্রভু’ বহু অনুষ্ঠানের প্রার্থনা গান হিসেবে আজও ব্যবহৃত হয়।

Advertisement

বাবার সঙ্গে বাপ্পি লাহিড়ী।

অপরেশ লাহিড়ি-বাঁশরী লাহিড়ির সন্তান বাপ্পিদা ছিলেন এমনই। ভীষণ দিলখোলা, আমুদে, আড্ডাপ্রিয় এক মানুষ। ১৯৫২ সালের ২৭ নভেম্বর জলপাইগুড়িতে জন্ম। ছোট থেকে সব রকম বাজনা বাজাতে পারতেন। তবলা, জ্যাজ, বঙ্গো, পিয়ানো তাঁর হাতে যেন প্রাণ পেত। আমার সুরে বাংলা এবং হিন্দি ছবিতে গানও গেয়েছেন। অতি সম্প্রতি ‘বাবলু ব্যাচেলর’ ছবির গানে বাপ্পিদা আমার সুরেই গেয়েছেন। খুব মিঠে গলা ছিল ওঁর। আমি, মিঠুন চক্রবর্তী, বাপ্পিদা মিলে বাংলায় অনেক কাজ করেছি। নিজের সুরের গানগুলো যখন পরে স্বকণ্ঠে গাইতেন, শ্রোতারা মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনতেন। মঞ্চে ‘এ আমার গুরুদক্ষিণা’ গানের টান যেই দিতেন, হাততালিতে ফেটে পড়ত চার দিক। স্বয়ং কিশোরকুমারও নাকি কোনও রোম্যান্টিক গান গাওয়ার পরে অনেক সময়ে বাপ্পিদাকে বলতেন, ‘‘বাপ্পি তুই এক বার গেয়ে শোনা তো!’’ দাদা গাইতেন। কিশোরজি মন দিয়ে শুনতেন। গান ফুরোলে আফশোস করতেন, ‘‘তোর মতো মিঠে করে কেন গাইতে পারি না বল তো!’’ নিখুঁত সুর, নিখুঁত উচ্চারণ। রেকর্ডিংয়ের পরে কোনও দিন আমাদের তাঁর গান কারেকশন করতে হয়নি।

বিশ্বজুড়ে তাঁর খ্যাতি। বহু যুগ ধরে মুম্বই নিবাসী। তার খোঁজ কিন্তু বাপ্পিদা মনেপ্রাণে বাঙালি। বলিউডের বাঙালিদের, মানে আমাদের তিনিই ছিলেন প্রধান স্তম্ভ। সবসময় একটাই কথা বলতেন, "যে ভাষায় যা কাজই কর, বাঙালিয়ানাকে ভুলো না।" দাদা নিজেও চূড়ান্ত ভাবে বাঙালি ছিলেন। খাওয়া দাওয়ায়, আড্ডায়, পরিবারকেন্দ্রিক মানসিকতায়, সবাইকে নিয়ে চলার অভ্যাসে। কাকভোর পর্যন্ত আড্ডা দিতে পারতেন অনর্গল। যেটা একমাত্র বাঙালিরাই পারে। সারা ক্ষণ কলকাতার কথা বলতেন।

বাপ্পিদা যে ঘরে বসে রেওয়াজ করতেন, সেই ঘরেও আমায় অনেক বার নিয়ে গিয়েছেন। বসিয়ে গান সম্পর্কে অনেক কিছু শিখিয়েছেন। জীবন সম্পর্কেও। বাপ্পিদা খুব বড় দার্শনিক ছিলেন। ওঁর জীবনবোধ অনুসরণ করার মতোই। যা দেখে আমি উদ্বুদ্ধ হয়েছি। তাই বাপ্পিদা আমার অভিভাবকও।

গয়না নিয়ে, বিশেষত সোনার গয়নার প্রতি অদ্ভুত মোহ ছিল তাঁর। দশ আঙুলে আংটি। গলায় নানা রকমের হার। কব্জিতে মণিবন্ধ। সব মিলিয়ে এক নতুন স্টাইল স্টেটমেন্ট। সঙ্গে লম্বা চুল। ‘ডিস্কো কিং’ আখ্যাটাকে এ ভাবেই প্রতি মুহূর্তে বয়ে বেড়াতেন যেন। আর ভালবাসতেন রুপোর থালায় ভাত খেতে। থালার পাশে সারি দিয়ে সাজানো রুপোর বাটি। তাতে পঞ্চব্যঞ্জন। একেবারে সাবেক বাঙালিয়ানা। আসলে বাপ্পিদা যেটাই করতেন, ভীষণ ভালবেসে করতেন।

রাহুল দেববর্মণের একমাত্র সার্থক উত্তরসূরী বাপ্পিদা। বাপ্পিদা মানে শুধু ডিস্কো নয়। বাপ্পিদা মানে ফিউশনও। তাঁর ‘নমকহালাল’ ছবির ‘কে পগ ঘুঙরু বান্ধ’ গানটাই ধরুন। ডিস্কোর মধ্যেই সরগম মিশিয়ে দিয়েছেন অনায়াসে। সেই গানের ছন্দে দুলেছে আসমুদ্রহিমাচল। ঠিক একই ভাবে ‘গুন্ডে’ ছবির ‘তুনে মারি এন্ট্রিয়া’ গান। যে গান এখনও বিসর্জনের নাচ থেকে সরস্বতী পুজোর প্যান্ডেল মাতায়।

বাপ্পিদার ‘ডিস্কো ড্যান্সার’ দেশ ছেড়ে রাশিয়ার মাটিতেও জনপ্রিয়। রাজ কপূরের পরে রাশিয়ায় মিঠুনদা কিংবদন্তি হয়েছেন এই ছবি, ছবির সমস্ত গানের দৌলতে। কতটা দক্ষ হলে ‘ওগো বধূ সুন্দরী’র গান আগে লেখা, পরে তাতে সুর বসাতে পারেন তিনি! এই মানুষগুলো চলে গেলে আমরা কী নিয়ে বাঁচব বলতে পারেন? বাঙালিই বা আর কী নিয়ে গর্ব করবে?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন