মঞ্চে রহমত ও মিনির বাবা। রবিবার। — নিজস্ব চিত্র
আমি যখন গোলগাল, হাসিখুশি মিনির জন্য বাদাম, আখরোট, কিশমিশ নিয়ে আসি, সেটা আসলে মিনির জন্য আনি না। নিয়ে আসি সেই মেয়েটার জন্য, যাকে ফেলে এসেছি ওই পাহাড়ের কোলে। কে জানে, কেমন আছে আমার মেয়েটা!
১২৪ বছর, ২৩০০ কিলোমিটার আর দু’টো সম্পূর্ণ আলাদা ভাষা। কিন্তু কলকাতার মঞ্চে যখন রবীন্দ্রনাথের ‘কাবুলিওয়ালা’ নাটক করছেন কাবুল বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়ারা, তখন সেই ব্যবধান মনে থাকে কই!
মাস ছয়েক আগে কলকাতা থেকে একটি আমন্ত্রণ গিয়েছিল কাবুল বিশ্ববিদ্যালয়ের থিয়েটার বিভাগের শিক্ষক আহমেদ শামিম ফরহামান্দের কাছে, কলকাতায় এসে রবীন্দ্রনাটক করুন। ‘টেগোর’ শামিমের কাছে পরিচিত নাম, অনুবাদে কিছু কবিতাও পড়েছেন। কিন্তু কোন নাটক করা যেতে পারে, তা চট করে মাথায় আসছিল না শামিমের। কথা হয় বিভাগীয় প্রধান হুসেন জাদার সঙ্গে। আলোচনায় উঠে আসে ‘কাবুলিওয়ালা’র নাম। ‘‘গল্পটার কথা শুনেছিলাম, কিন্তু পড়া ছিল না’’— নাটকের পরে বলছিলেন শামিম। ‘‘কোথায় পাওয়া যায়, যখন আকাশপাতাল ভাবছি, এক বাঙালি বন্ধুর কথা মনে পড়ে গেল। কর্মসূত্রে কাবুলেই থাকে ছেলেটা। বলা মাত্র বাড়ি থেকে তিন পাতার একটা গল্প এনে দিল আমায়।’’
শামিম জানালেন, বাঙালি বন্ধুটিই ইংরেজিতে অনুবাদ করে দেন গল্পটা। যেটা আবার নিজেরা অনুবাদ করে নেন দারিতে (আফগানিস্তানের দু’টি মূল ভাষার অন্যতম। অন্যটি পুশতু)। এই দারি ভাষাতেই রবি-সন্ধ্যায় আইসিসিআরে মঞ্চস্থ হল ‘কাবুলিওয়ালা’। আয়োজনে কলকাতার সংস্থা ‘হ্যাপেনিংস’। কলকাতার দর্শকদের জন্য ইংরেজিতে ‘সাবটাইটেল’ পড়ল পিছনের স্ক্রিনে।
দশ বছর ধরে রবীন্দ্র উৎসবের আয়োজন করছে এই সংস্থা। গত বছর থেকে বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়কে আমন্ত্রণ জানানো হচ্ছে। এ বছর ঢাকা এবং কলম্বো বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে আমন্ত্রণ জানানো হয় কাবুল বিশ্ববিদ্যালয়কেও। এক ডাকেই সাড়া দেন শামিমরা। চার-পাঁচ মাসের মহড়া। তার পরেই এগারো জনের দলটি সোজা ভারত পাড়ি দিয়েছে। হ্যাপেনিংস-এর পক্ষ থেকে এ বি আয়েঙ্গার বললেন, ‘‘আশা করি, কাবুলিওয়ালার এই নতুন প্রযোজনা আফগানিস্তানেও নাট্যচর্চার নতুন দিগন্ত খুলে দেবে। সেখানকার তরুণ প্রজন্ম নতুন ভাবে রবীন্দ্রনাথকে জানবে, বোঝার চেষ্টা করবে।’’
শামিম-হুসেনরাই জানালেন, নাট্যচর্চা প্রায় ভুলতে বসেছে এখনকার আফগান ছেলেমেয়েরা। কারণ, শুধু কাবুল নয়, গোটা আফগানিস্তানেই নাটক করা বা দেখার রেওয়াজটা একদম বন্ধ হয়ে গিয়েছে। গত কয়েক বছরের তালিবান শাসন এবং তার পরেও দেশজুড়ে ক্রমাগত জঙ্গি হানা মানুষকে গুটিয়ে, বাড়ির ছোট্ট চৌহদ্দিতে পুরে দিয়েছে। তা-ও কাবুলে দু’একটা প্রেক্ষাগৃহে মাঝেমধ্যে নাটক হতো। কিন্তু দু’বছর আগে ‘কালচার সেন্টার অব ফ্রান্স ইন আফগানিস্তান’-এ একটি নাটক চলাকালীন বিস্ফোরণে বহু মানুষ নিহত হন। তার পর থেকেই নাটক বলতে সরকারি প্রযোজনায় নেহাতই রাজনৈতিক নাটক বা কাবুল বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়াদের মতো শখের নাট্যকর্মীদের দু’একটা প্রয়াস।
কাবুল বিশ্ববিদ্যালয়ের থিয়েটার বিভাগের দু’টি শাখা— অভিনয় ও পরিচালনা। যে কোনও একটিতেই স্নাতকস্তরে পড়াশোনা করা যায়। অত্যন্ত জনপ্রিয় এই বিভাগের ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা প্রচুর। তবে মেয়েদের সংখ্যা ‘পরিচালনা’ শাখাতেই বেশি। কারণ বেশির ভাগ মেয়ের অভিভাবকেরাই চান না, তাঁদের মেয়েরা মঞ্চে উঠে অভিনয় করুক।
এমনই রক্ষণশীলতার বেড়া কাটিয়ে কলকাতায় অভিনয় করতে এসেছেন ভেগা মোকারাবি। নাটকে মিনির মায়ের চরিত্রটি তাঁর। রবীন্দ্রগল্পে মিনির মায়ের মতো নেপথ্যচারিণী নন, তাঁর উপস্থিতি বেশ প্রখর এই নাটকে। বেশভূষার দায়িত্বেও তিনি। কাবুলিওয়ালাতে অভিনয় করতে হবে শুনে এক কথায় রাজি হয়ে গিয়েছিলেন। একটাই শর্ত— বাড়ির লোক যেন না জানতে পারেন, তিনি মঞ্চে উঠছেন। তা-ও আবার ভিন্ দেশের মাটিতে!
এ সব প্রতিকূলতার মধ্যে দিয়েই নাটক পড়ছেন, পড়াচ্ছেন, করে যাচ্ছেন শামিমরা। দু’সরকারি-বেসরকারি আনুকূল্যের নামগন্ধ নেই। কোনও স্পনসর জোটে না। তাই নিজেদেরই মাইনে থেকে বইপত্র কেনেন মাস্টারমশাইরা। নাটক ঠিক করার পরে প্রপ্স, কস্টিউমও কেনেন নিজেদের টাকায়। শুধু নাটক করার আনন্দে। ‘‘তবু করি’’, বলছিলেন বিভাগীয় প্রধান হুসেন জাদা। কারণ লোকজনকে বোঝানো দরকার, আফগানিস্তান মানে শুধু জঙ্গি হামলা আর যুদ্ধ নয়। আমরা গান ভালবাসি, কবিতা-নাটকও।’’
বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় এবং ‘কলকাতা লিটারারি মিট’-এ আরও দু’বার ‘কাবুলিওয়ালা’ মঞ্চস্থ করবেন শামিমরা। লিট মিটের তরফে মালবিকা বন্দ্যোপাধ্যায় বললেন, ‘‘এ বছরের অনুষ্ঠানের সূচনা হবে ‘কাবুলিওয়ালা’ দিয়ে।’’ ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের বিস্তৃত সোপানে এই এই অনন্য পরিকল্পনা আলাদা মাত্রা পাবে, আশা মালবিকার।