খরাজ
খরাজ মুখোপাধ্যায়, এই মুহূর্তে বাংলা ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির অপরিহার্য একটা নাম। শুধু বাংলা নয়, ‘যুবা’, ‘কহানি’, ‘কহানি টু’, ‘মেরে পেয়ারি বিন্দু’...ক্রমশ হিন্দি ছবিতেও খরাজ জায়গা করে নিচ্ছেন। মে-জুন মাসে দিল্লিতে শেখর পাঠক পরিচালিত হিন্দি ছবি ‘গুঞ্জ’-এর শ্যুটিং শুরু হবে। এই ছবিতে একজন সিবিআই অফিসারের চরিত্রে অভিনয় করবেন খরাজ। এর পরেও কি তিনি কলকাতায় আটকে থাকবেন? ম্যাডক্স স্কোয়্যারের বাড়িতে বসে খরাজ মুখোপাধ্যায়কে এই প্রশ্ন করতেই লাজুক হেসে বললেন, ‘‘বলিউডে ছবির অফার পাচ্ছি, তাই করছি। কিন্তু মুম্বই চলে যাওয়ার কোনও পরিকল্পনা নেই। যদিও ‘বিসর্জন’ দেখার পর পরিচালক কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়কে বলেছি, ‘কেন তুমি যে এখানে পড়ে আছ? মুম্বই পালিয়ে যাও’।’’
তাঁর কথাতেই ইঙ্গিত পাওয়া গেল বলিউড-টলিউডের কাজের মধ্যে ফারাকের। কেমন সে ফারাক? ‘‘তখন প্রদীপ সরকারের ছবি
‘লাগা চুনরি মে দাগ’-এ কাজ করছি। চার লাইনের সংলাপ পেয়ে অনুপম খের পরিচালককে বললেন, ‘এত বড় সংলাপ!’ এরা চার লাইনের সংলাপকে বড় বলছে! বেজায় অবাক হয়েছিলাম। প্রশ্নটা কিন্তু অভিনয় ক্ষমতা নিয়ে নয়, প্রশ্নটা কমফোর্ট জোনের। মুম্বইয়ে শিল্পীদের সব ব্যাপারে এত সুবিধে দেওয়া হয় যে, তাঁদের কাছে চার লাইনই বিরাট! এখানে ভাবা যায় না। ‘কহানি টু’-এর সেই দৃশ্য, যেখানে বিদ্যা আমাকে জ্বালিয়ে দেওয়ার ভয় দেখাচ্ছে। ঘরটার মধ্যে প্রবল গরম। কিন্তু ঘরের বাইরে ছ’টা কুলার দেওয়া হয়েছিল। যাতে জানালা-দরজা দিয়ে ঠান্ডা হাওয়া ঘরে ঢোকে। এটা কিন্তু এখানে ভাবা যায় না।’’ কমফোর্ট যখন বেশি পাচ্ছেন তখন আপনিও নিশ্চয় অভিনয়ের ক্ষেত্রে বেশি গুড় ঢালছেন? ‘‘পড়াশোনায় ভাল ছিলাম না। মাধ্যমিক পরীক্ষার আগে বাবা বলেছিলেন, ‘পরীক্ষাটা যখন দিবিই ঠিক করেছিস, তখন একটু ভাল করেই দে।’ কথাটা মাথায় ঢুকে গিয়েছে। তাই বাংলা-হিন্দি-লো বাজেট-হাই বাজেট-সিরিয়াস-এলেবেলে যাই আসুক, সব ক্ষেত্রেই আমি সিরিয়াস না হয়ে পারি না,’’ একগাল হেসে বললেন তিনি। শোনা যায়, ‘কহানি টু’র পর অর্জুন রামপাল নাকি আপনার ফ্যান হয়ে গিয়েছেন? ‘মেরি পেয়ারি বিন্দু’-তে আপনার সঙ্গে শট দিতে গিয়ে আয়ুষ্মানকে ১৫ বার টেক দিতে হয়েছে? লাজুক হাসি খরাজের মুখে, ‘‘শ্যুটিং প্যাকআপের পর অজুর্ন নিজে থেকে এসে জড়িয়ে ধরে বললেন, ‘দাদা আপনার ফোন নম্বরটা পেতে পারি?’ ওর জন্য একদিন বেকড রসগোল্লা নিয়ে গিয়েছিলাম। চোখের সামনে প্রায় ১২টা সাবাড় করে ফেলল! হ্যাঁ ঠিকই, ‘মেরি পেয়ারি বিন্দু’তে আয়ুষ্মানের ১৫ বার টেকের পর ও.কে হল। ওর অভিনয় ক্ষমতা নিয়ে কিছু বলব না, কিন্তু এত বার টেক দেওয়াতেও কোনও বিরক্তি নেই। প্রতিবারই একই এনার্জি। এই এনার্জি বোধহয় বিদ্যার মধ্যে সবচেয়ে বেশি। ওর তুলনা ও নিজেই,’’ কথা শেষ করে সিগারেট ধরালেন তিনি। কিন্তু এত কিছুর পরও কি খরাজ মুখোপাধ্যায় একটু প্রচারবিমুখ নয়? থিয়েটার থেকে যাঁর জন্ম, তাঁকে আজকাল মঞ্চে সেভাবে দেখাই যায় না! গানের অ্যালবামই বা কই! সোশ্যাল মিডিয়া থেকেও ভ্যানিশ! ‘‘দেখুন, আমি মোটেও প্রচারবিমুখ নই। যদি উপযুক্ত হই, তা হলে লোকে আমার খোঁজ নেবেই। যেমন আপনি এলেন! ফেসবুকে এই একগাদা মেসেজ জমে গিয়েছিল। ব্যস্ততার জন্য দেখা হয় না। লোকে ভাবে আমি উন্নাসিক। তাই দিলাম সব ডিলিট করে।’’ কিন্তু গান, থিয়েটার কেমন চলছে? ‘‘১৬ বছর বয়স থেকে ‘ভুশুণ্ডির মাঠ’ করছি অযান্ত্রিক’-এ। এখনও করি। নাটকটা যাতে বেঁচে থাকে তাই বেশ কিছু শিল্পীকে নিয়ে একটা অ্যালবাম করে রেখেছি। চেনামুখ-এ এখনও ‘প্রথম পাঠ’ করি। ইচ্ছে আছে, কিছু দিন পরে নিজের পরিচালনায় একটা নাটক মঞ্চস্থ করব। এ ছাড়া ‘হায় বাঙালি হায়’-এর পরও অনেক অ্যালবাম করেছি। কিন্তু ভিডিয়ো করিনি। তাই কেউ মনে রাখেনি। এখন তো লোকে দেখে, শোনে না। ’’
সাক্ষাৎকারের ফাঁকে উঠে এল এমন অনেক গল্প। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, রবি ঘোষ যখন মেকআপ করতেন, তিনি মেকআপ রুমে গিয়ে চুপটি করে বসে তাঁদের কথা শুনতেন। ‘‘শুধু সিনেমা নয়, সাহিত্য, রাজনীতি, দর্শন, ধর্ম সব কিছু নিয়ে আলোচনা করতেন তাঁরা। সমৃদ্ধ হওয়া যেত সেই সব শুনলে। এখন আমি, কাঞ্চন, বিশ্বনাথ, শান্তিলাল, রাজেশ, রুদ্র... ওই রকম আড্ডা দিই। আগে কাউকে একটা মেকআপ রুম আলাদা করে দেওয়া হলে, সে চিন্তায় পড়ে যেত। ভাবত, আলাদা করে দেওয়া হল। এখন তো উলটো। এখন তো এসি মেকআপ রুম, এসি ফ্লোর, কী নেই! ভাবি সিনিয়রদের কথা। ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়, তুলসী চক্রবর্তী কোন পরিবেশে কাজ করতেন, তার পরেও ওঁরা এক-একটা ক্লাসিক দিয়ে গিয়েছেন।’’
অভিনয়ই খরােজর শেষ কথা। আত্মজীবনী লেখা শুরু করবেন কবে? প্রশ্ন শুনে হেসে ফেললেন তিনি। ‘‘ইচ্ছে আছে, কিন্তু এই ব্যাপারে আমি অলস,’’ অকপট স্বীকারোক্তি খরাজের।