হাতে কলমে বদলের ক্ষমতা থাকলে শহরটার নাম পাল্টে দিয়ে রোলকাতা রাখতাম। যে শহরের অলি-গলি-পাকস্থলী জুড়ে কুটির শিল্পের মতো রোলের দোকান তাকে খামোকা কোলে করে তুলে রাখার মানেই দেখি না আমি। মুঘলেরা পরোটা বানাতে শিখিয়েছে, বাঙালি সেই পরোটার পাততাড়়ি গুটিয়ে গুটিয়ে বানিয়ে ফেলেছে রোল। হ্যাঁ, সেই রোল কি না রীতিমতো কলকাতা রক করছে বহুদিন হল।
গোলকায়নের বোকাবাস্কে যতই জিঙ্গল বাজুক, ম্যাকের বাবা খ্যাক হয়ে কলকাতার রোলকল চলছে, চলবে! ‘সাবওয়ে’ হোক বা ফ্লাইওভার কলকাতার জিভের থেকে ডাবল আন্ডা, ডাবল চিকেনের স্বাদ ভবি ভোলবার নন। সপ্তাহের যে কোনও দিন পাইকপাড়়া থেকে পাটুলি রাউন্ড মারুন, দেখবেন গ্লোবালকে গোহারা হারাচ্ছে এই লোকাল প্লেয়ারেরা। আসলে, স্বাদের বিশ্বে একনায়কতন্ত্র চলে না, জনগণতন্ত্রের সেখানে একটাই প্রতীক, সেই জিভ চিহ্নে ছাপ রাখতে না পারলে, ব্যান্ড বাজা বারাত হতে বাধ্য। আর, এখন তো দেখি ঠ্যালায় পড়ে পাঁচতারা হোটেলও নাম পাল্টে সেই পাঁচুদার রোল-ই তাদের স্ন্যাক্স মেনুতে রাখছে। অতএব, স্বাদের প্রবেশ অবাধ।
আমাদের ছোটবেলায় কিন্তু রোল ব্যাপারটার নাম-গন্ধ ছিল না। আশির দশকে আমাদের যৌবনে তার সঙ্গে প্রথম অভিসার। মূলত, বেকার যুবকের অন্নসংস্থানের অন্যতম প্রধান হাতিয়ার ছিল এই রোল সেন্টারগুলো। বিহারী ফুচকাওয়ালাকে কম্পিটিশনে ফেলে ভাইরাসের মতো ছড়িয়ে পড়েছিল বাঙালির এই স্ন্যাক্সস বার।লোকজন আমাকে রসনাশিল্পে কৃতীর সম্মান দেন, আমি কিন্তু বাঙালির উদ্যোগপর্বে এই মানুষগুলির কৃতিত্বও কিছু কম দেখি না। এমন ‘স্পেশালিটি’ রান্নায় তাঁরাই বা পিছিয়ে কোথায়?
পাড়ার মোড় থেকে পুজোর প্যান্ডেল অবধি চোখের খিদে মেটাতে এই রোলের কোনও বিকল্প নেই। নিজাম, বাদশা, বা পার্ক স্ট্রিটের কুসুম স্ন্যাক্স বার বা হট কাটি রোল কো কিংবদন্তী। রোলের দুনিয়ায় রকস্টার এরা। পাড়ার আটপৌড়ে রোল শপ গুলোর চেয়ে এদের ভ্যারাইটি ও ভ্যালু কিঞ্চিৎ বেশি। আর সাবেক যমুনা সিনেমা হলের পাশে বিফ রোল? আহা, ডোডো পাখির মতো হারিয়ে গিয়েও আজও তার স্বাদ জিভে লেগে আছে। যতই বুটিক রেস্তোরাঁ হোক, হোক ঝাঁ-চকচকে শপিং মলের সাজানো ফুড কোর্ট, কলকাতা বেঁচে থাকবে তার ‘ফুড’ পাথের রসে ও রসনায়। আসলে, একেকটা শহরের সঙ্গে একেকটা স্বাদ জড়িয়ে থাকে। মুম্বই-এর যেমন বড়া পাও, কলকাতার তেমনই রোল। তাই, দিনে-দিনে শহরটার যতই ভোল বদলাক, রোল বদলাবে না।