বিয়াল্লিশেও মনের মোমবাতিটা জ্বলছে

নিছক বড় টেনিস প্লেয়ার আর নন। আপাতত ভারতীয় টেনিসের চিরবিস্ময় মধ্যবয়সী। সেই লিয়েন্ডার পেজ-কে বড় হতে দেখার অভিজ্ঞতা বর্ণনায় বরাবরের ঘনিষ্ঠ সাংবাদিক রোহিত ব্রিজনাথ। সিঙ্গাপুরে তাঁর সঙ্গে ফোনালাপে ইন্দ্রনীল রায়নিছক বড় টেনিস প্লেয়ার আর নন। আপাতত ভারতীয় টেনিসের চিরবিস্ময় মধ্যবয়সী। সেই লিয়েন্ডার পেজ-কে বড় হতে দেখার অভিজ্ঞতা বর্ণনায় বরাবরের ঘনিষ্ঠ সাংবাদিক রোহিত ব্রিজনাথ। সিঙ্গাপুরে তাঁর সঙ্গে ফোনালাপে ইন্দ্রনীল রায়

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৭ জুলাই ২০১৫ ০০:০২
Share:

...কলকাতাতে তখন নিয়মিত লোডশেডিং হয়। সত্যজিৎ রায় ছবি বানান, আর ‘স্পোর্টসওয়ার্ল্ড’ ম্যাগাজিনে আমি চাকরি করি।
আশির দশক শেষ হতে তখনও বেশ কিছু বছর দেরি।
এমনই এক সন্ধ্যায়, স্যাটারডে ক্লাবে গিয়েছি নতুন এক টিনএজ টেনিস প্লেয়ারকে দেখব বলে। সেই সময়কার টেনিস সার্কিটে প্রায়ই শুনছিলাম এই ছেলেটার কথা।
পৌঁছানো মাত্রই সাঙ্ঘাতিক জোরে বৃষ্টি শুরু। ভাবলাম, ইস্ আজকে আর দেখাই হবে না ছেলেটার সঙ্গে। কিন্তু কোথায় কী, বৃষ্টিতে ভিজে ভিজেই প্রায় দেড় ঘণ্টা একমনে ফুটওয়ার্কের প্র্যাকটিস করল। কখনও ফরোয়ার্ড। কখনও সাইডওয়েজ।
সে দিন স্যাটারডে ক্লাব থেকে বেরোতে বেরোতে ভাবছিলাম, কী অসম্ভব ফিটনেস আর অ্যাথলেটিসিজম এই ছেলেটার! এমনিতে তো জাতি হিসেবে আমরা ভারতীয়রা ন্যাচারাল অ্যাথলিট নই। কিন্তু এই ছেলেটা সে দিনও ব্যতিক্রম ছিল।
আজ বিয়াল্লিশ বছর বয়সেও সে ব্যতিক্রম।
লিয়েন্ডার পেজ।
ব্যতিক্রম না হলে বিয়াল্লিশ বছর বয়সে উইম্বলডন জেতা যায় নাকি?

Advertisement

রক্তটা তো এক

Advertisement

লিয়েন্ডার পেজকে নিয়ে স্টোরি লিখলে একজন মানুষের কথা বারবার উঠে আসে। ভেস পেজ। লিয়েন্ডারের বাবা।

ছেলে-বাবা দু’জনকে খুব কাছ থেকে জানা সত্ত্বেও বলছি, আমরা এটা ভুলে যাই লিয়েন্ডারের মা-ও কিন্তু দুর্দান্ত অ্যাথলিট ছিলেন। ওঁর খেলোয়াড় জীবনে হয়তো মা সামনে আসেননি সে রকম ভাবে, কিন্তু তাঁর অবদানও অনস্বীকার্য।

আর সেই সময়কার লিয়েন্ডার আর ভেস-এর কথা বলতে গেলে একটু তখনকার ভারতবর্ষটাকেও জানা দরকার। সেই সময় কিন্তু ভারতে কেউ জানতই না, প্রোফেশনাল স্পোর্টসের কী ডিম্যান্ড। না ছিল ইন্টারনেট, ডলারের জন্যও পারমিশন দরকার হত সরকারের কাছ থেকে।

ওই রকম একটা সময়ে ভারত থেকে বিশ্বমানের টেনিস প্লেয়ার বানানোটা সত্যিই বড় কঠিন ছিল। আর এই কঠিন কাজটাই কলকাতায় বসে করেছিল ভেস পেজ।

এ রকম একটা সময়ে কে কোচ হবে, কোন কোন টুর্নামেন্টে লিয়েন্ডারের খেলা উচিত, কোথায় কোন হোটেলে কত খরচ— সব কিছু একা সামলাত ভেস।

আবার বলছি তখন কিন্তু ইন্টারনেট ছিল না। ছিল না ট্রাভেলের নানা ওয়েবসাইট। এই অসম্ভব শক্ত কাজটা কী ভাবে ভেস করত, কে জানে?

আজকে অনেকেই লিয়েন্ডারের লড়াইয়ের ক্ষমতা নিয়ে অনেক শব্দ খরচ করে। অনেকেই বলে লিয়েন্ডারের মতো ফাইটিং স্পিরিট বাকিদের মধ্যে নেই। তাদের আমি জিজ্ঞেস করতে চাই, কোনও দিন ভেবে দেখেছেন এই ফাইটিং স্পিরিটটা লিয়েন্ডার পেল কোথা থেকে?

আশির দশকে এই প্রতিকুল পরিস্থিতি থেকে একটা চ্যাম্পিয়ন তৈরি করতে গিয়ে ভেস কিন্তু একদিনের জন্যও দমে যায়নি। ভেসই যদি না দমে, তা হলে লিয়েন্ডার দমবে কী করে? রক্ত তো এক।

কোর্টে আমিই জিতব

মনে আছে সেই বছর আমি স্পোর্টসওয়ার্ল্ডের হয়ে উইম্বলডন কভার করতে গিয়েছি। ১৯৯০। মেন’স ফাইনাল দেখছি। বেকার বনাম এডবার্গ। হঠাৎ খবর এল বয়েজ ফাইনালে দারুণ খেলছে লিয়েন্ডার।

তড়িঘড়ি মেন’স ফাইনাল ছেড়ে ছুটলাম লিয়েন্ডারের কোর্টের দিকে। বাকিটা তো ইতিহাস। সে দিনও দেখছিলাম লিয়েন্ডারের মধ্যে কোনও ভয় ছিল না।

তুমি বিদেশি, তুমি আমার থেকে লম্বা, তোমার গায়ে জোর বেশি — তাতে কী! কিছুতেই লিয়েন্ডারকে কেউ কোনও দিন ভয় পাওয়াতে পারেনি। পরে লিয়েন্ডারের কাছে শুনেছিলাম পুরো টুর্নামেন্ট চলাকালীন বেশ কিছু প্লেয়ার লকার রুমে লিয়েন্ডারের জুতো দেখলেই লাথি মেরে অনেক দূরে পাঠিয়ে দিত।

পরে শুনেছিলাম এই ‘বুলি’দের লিয়েন্ডার নাকি কিছুই বলত না। ধীরে ধীরে গিয়ে জুতোটা নিয়ে আসত। জিজ্ঞেস করেছিলাম, রাগ হত না? জবাবে বলেছিল, ‘‘রাগটা তো কোর্টে দেখাতাম। ওখানে তো আমিই জিতব, ওরা লকার রুমে আমার জুতোটা যতই লাথি মারুক।’’

এই স্পিরিটটার জন্যই লিয়েন্ডার, লিয়েন্ডার।

শোম্যান

তিরিশ বছর স্পোর্টস জার্নালিজম করছি। আমাকে যদি কেউ জিজ্ঞেস করে, স্পোর্টস জার্নালিস্ট হিসেবে দেখা, প্রথম পাঁচটা ‘ইন্সপায়ারিং’ ঘটনা র‌্যাঙ্ক করুন তা হলে হয়তো খুব উপরের দিকে থাকবে, ডেভিস কাপে লিয়েন্ডার পেজকে দেখাটা।

আজকে বেকবাগানের ছেলেটার কথা বলতে গেলে আমরা মাঝে মধ্যে ভুলেই যাই লিয়েন্ডার আর ডেভিস কাপের সেই নিবিড় সম্পর্কের কথা। ফিরে তাকালে মনে হয়, সেগুলো প্রায় কুড়ি বছর আগের ঘটনা বলে অনেকেই ভুলে যায় সেই ম্যাচগুলো।

গোরান ইভানেসেভিক, অঁরি লাকোন্তে, ওয়েন পেরেইরা— কাদের না হারিয়েছে লিয়েন্ডার ডেভিস কাপে।

গোরানের সঙ্গে দু’সেটে পিছিয়ে পড়ে জিতেছে, ওয়েন পেরেইরা সেই সময় অন্যতম সেরা প্লেয়ার ছিল, তাকে হারিয়েছে। লাকোন্তের মতো প্লেয়ারকে হারিয়েছে ক্লে কোর্টে।

ডেভিস কাপে ওকে দেখার সময় একটা কথা আমার সব সময় মনে হত। মনে হত কী অসম্ভব শোম্যান লিয়েন্ডার!

কোর্টে অঙ্গভঙ্গি, দর্শককে তাতানো— লিয়েন্ডার এগুলো দুর্দান্ত জানত।

তা হলে ও কি ইন্ডিয়ার শ্রেষ্ঠ টেনিস প্লেয়ার?

সেরা কিন্তু রমানাথন

কোনও মতেই ও ভারতের শ্রেষ্ঠ টেনিস প্লেয়ার নয়। সেই মুকুটটা আজও রমানাথন কৃষ্ণনের। ষাটের দশকের ওই লেজেন্ডারি অস্ট্রেলিয়ান প্লেয়ারদের সঙ্গে খেলে দু’বার উইম্বলডনের সেমিফাইনালে পৌঁছনো কোনও কালেই সহজ হত না। সিঙ্গলসের ফর্মের জন্যই রমানাথন এগিয়ে থাকবেন লিয়েন্ডারের থেকে।

আর আজ তো টেনিসটাই পুরোটা পাল্টে গিয়েছে। অনেকেই জিজ্ঞেস করে, ভেস পেজ যে প্রেসক্রিপশন মেনে লিয়েন্ডার তৈরি করেছিল, যদি আজকে কেউ সেটা ফলো করে তা হলে কি আর একটা লিয়েন্ডার বানানো সম্ভব হবে?

আমার কাছে এই প্রশ্নটা ফ্যাসিনেটিং। আমার মনে হয় ভেসের প্রেসক্রিপশনের সবথেকে বড় ওষুধের নাম ছিল হার্ড ওয়ার্ক। সেই হার্ড ওয়ার্কের জন্য যে কেউ একটা লেভেল অবধি পৌঁছবেই। কিন্তু তার সঙ্গে সঙ্গে আধুনিক টেনিসে আরও কিছু নতুন জিনিস যোগ হয়েছে।

আজকে সিঙ্গলস খেলতে হলে মিনিমাম উচ্চতা হয়ে দাঁড়িয়েছে ছ’ফুট এক ইঞ্চি। সঙ্গে থাকতে হবে চূড়ান্ত ফিটনেস। তাই ভেস পেজের ফর্মুলা মানলেও বাকি দু’টো জিনিস যদি আপনার না থাকে তা হলে খুব বেশি সাফল্য হয়তো নাও আসতে পারে।

কিন্তু চ্যাম্পিয়নরা তো এই সব হিসেব উল্টে দেন বলেই চ্যাম্পিয়ন। খুব কাছ থেকে সচিন, সৌরভ, লিয়েন্ডাদের দেখে বুঝেছি এদের ওয়ার্ক এথিকটা একই রকম।

এত দিন স্পোর্টস নিয়ে লেখালিখির পর এটা বুঝেছি, চূড়ান্ত ওয়ার্ক এথিকের সঙ্গে চ্যাম্পিয়নদের আরও একটা জিনিস থাকে যা তারা সচরাচর কাউকে দেখায় না।

তা হল নিজের ক্ষমতার উপর অন্ধ বিশ্বাস এবং সযত্নে লুকিয়ে রাখা এক ঔদ্ধত্য।

অত ঝামেলার পর দাদার কামব্যাকের পিছনে ওই ঔদ্ধত্য ছিলই। সচিন যদি নিজে না বিশ্বাস করত ও গ্রেট প্লেয়ার তা হলে শারজাতে ওই ইনিংস খেলা সম্ভব হত না।

লিয়েন্ডার যদি মনে মনে নিজের ক্ষমতা নিয়ে কলার না তুলত, তা হলে কোনও মতেই বিয়াল্লিশে সেন্টার কোর্ট মাতাতে পারত না। এখানেই লেজেন্ডরা একসূত্রে গাঁথা হয়ে যায়।

আজকে এত বছর পর একটা কথা খুব মনে পড়ছে।

লিয়েন্ডার সেই সময় ব্রিটানিয়া অমৃতরাজ টেনিস অ্যাকাডেমিতে থাকে। সারাদিনের খেলার পর আমি আর ও আড্ডা মারছি। কথা বলতে বলতে জিজ্ঞেস করলাম, সেই বছরে ওর সবচেয়ে মনে রাখার মতো ঘটনা কোনটা?

টেনিস প্লেয়াররা সাধারণত এই প্রশ্নগুলোর এক রকম উত্তর দেয়। ‘‘সেই ম্যাচটা যখন দু’সেট ডাউন উইথ আ ব্রেক ছিল আর তার পর আমার সেই ব্যাকহ্যান্ডটা’’— এ জাতীয় কথা বলে ।

এ রকমই এক উত্তরের আশা করেছিলাম। কিন্তু লিয়েন্ডার আমাকে সে দিন যা বলেছিল তা প্রায় চমকে দেওয়ার মতো।

বলেছিল, প্রতিদিন শুতে যাওয়ার আগে ও হোস্টেলের ঘরে ‘শ্যাডো প্র্যাকটিস’ করত আয়নার সামনে। সে দিন ডিনার শেষ করে ও হোস্টেলে নিজের ঘরে ফিরেছে। ফিরে চেঞ্জ করে আয়নার সামনে শ্যাডো প্র্যাকটিস করবে, ঠিক এমন সময় লোডশেডিং ।

একবার নাকি ভেবেছিল গিয়ে শুয়ে পড়বে, কেউ তো জানতেও পারবে না। কিন্তু লিয়েন্ডার শোয়নি।

দেশলাই জোগাড় করে সে দিন একটা মোমবাতি জ্বালায় আয়নার সামনে। তার পর ওই মোমবাতির আলোতেই শ্যাডো প্র্যাকটিস করে বহু রাত অবধি। ‘‘সে দিন বুঝেছিলাম, হার্ড ওয়ার্কটা করতে আমার গর্ববোধ হচ্ছে,’’ ধীরে ধীরে বলেছিল লিয়েন্ডার।

আজ এত বছর পরে, সিঙ্গাপুরে বসে, ওর সঙ্গে কাটানো সেই সন্ধেটার কথা খুব মনে পড়ছে।

আমি নিশ্চিত, লিয়েন্ডারের মনে সেই হোস্টেলের মোমবাতিটা আজও জ্বলছে...

রোহিত ব্রিজনাথ,
সিঙ্গাপুরের দ্য স্ট্রেটস টাইমস-এর কলামনিস্ট

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন