জগা ও খিচুড়ি

আর কী! বর্ষা তো এসেই গেল! জীবনে রান্নাঘরে যে ঢোকেনি, সেই আনাড়িও আর কিছু না পারুক খিচুড়ি বানাতে পারবে। লিখছেন অঞ্জন চট্টোপাধ্যায়শ্যামপুকুর স্ট্রিট যেখানে এসে ভূপেন বোস এভিনিউতে মিশছে, সেখানে দাঁড়িয়ে সাইকেল বিড়িতে শেষ সুখটান দিচ্ছিল জগা। হঠাৎ আমাকে দেখে যেন ভূতের মতো চমকে উঠল। ওকে না দেখার ভান করে আমি যেই রাস্তা পার হতে যাব, অমনি দিব্যি ঝকঝকে আকাশ থেকে ঝমঝম করে বৃষ্টি নামল। জগা তো তাই দেখে পড়ি-কি-মরি করে দুদ্দাড় ছুট।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২১ জুন ২০১৬ ০৬:০৭
Share:

শ্যামপুকুর স্ট্রিট যেখানে এসে ভূপেন বোস এভিনিউতে মিশছে, সেখানে দাঁড়িয়ে সাইকেল বিড়িতে শেষ সুখটান দিচ্ছিল জগা। হঠাৎ আমাকে দেখে যেন ভূতের মতো চমকে উঠল। ওকে না দেখার ভান করে আমি যেই রাস্তা পার হতে যাব, অমনি দিব্যি ঝকঝকে আকাশ থেকে ঝমঝম করে বৃষ্টি নামল। জগা তো তাই দেখে পড়ি-কি-মরি করে দুদ্দাড় ছুট। মাঝরাস্তায় দাঁড়িয়ে কাকভেজা ভিজতে ভিজতে চেঁচিয়ে উঠলাম, ওরে জগা! পালাস না বাপ আমার! তোকে আমি আর খিচুড়ি রাঁধতে বলব না।

Advertisement

বিশ্বাস করুন, বর্ষাকাল এলেই খিচুড়ি নিয়ে এই স্বপ্নটা জগা-খিচুড়ি হয়ে আমাকে তাড়া করে বেড়ায়। আসলে, সেই হাফপ্যান্ট পরা বয়স থেকেই আকাশ থেকে দু’এক ফোঁটা জল ঝরল কি ঝরল না, অমনি রোজকার মেনুতে ভাতের বদলে খিচুড়ি হয়ে যায় আপনাআপনি। আপনি অবশ্য বলতেই পারেন, এতে অবাক হওয়ার মতো আছেটা কী? এই রোগ তো বাঙালি মাত্রের ঘরে ঘরে। সত্যিই বৃষ্টি নামলে বাঙালির জীবনে ভাতডালের সঙ্গে মেলামেশাটা যেন হঠাৎ করেই একটু বেড়ে যায়। আজকাল তো আবার ফেসবুকে স্টেটাসও হয়—আয় বৃষ্টি ঝেঁপে, খিচুড়ি দেব মেপে।

তো, এই খিচুড়ি বাতিক হল বাঙালির বাপের সম্পত্তি। যুগ যুগ ধরে পুরুষানুক্রমে এই মিক্সচার বাংলার ঘরে ঘরে চলে আসছে। তেলেজেলে মিশ না খেলেও, চালডালের এই মিলমিশ সেই ঈশ্বরী পাটনির আমল থেকেই বহাল।

Advertisement

কিন্তু শুধুই কি খিচুড়ি? সঙ্গতে আছে পাঁপড়ভাজা থেকে ডিমের অমলেট হয়ে ঐশ্বরিক ইলিশ! কাকে ছেড়ে কার কথা বলি! আর খিচুড়িও কি এক রকমের? রকমফেরে সেও তো রকমারি। আমিষ-নিরামিষ, ভাগাভাগির কি শেষ আছে? পুজোর খিচুড়ি ভোগ এক রকম, ভুনিখিচুড়ি আরেক রকম। মা-মাসিমার হাতবদলে খিচুড়়ির স্বাদও বদলে যায়। ঠিক যেমন চাল বা ডাল বদলালে খিচুড়ির আস্বাদ পাল্টে যায় নিমেষে। মুসুরি ডালের খিচুড়ির যে টেস্ট, মুগডাল হলে সেই খিচুড়ির স্বাদ আবার অন্য রকম। তাই, খিচুড়ি চালে-ডালে এক হলেও, রসনাবৈচিত্রে রীতিমত একাধিক।

আর একটা ব্যাপার। এত সহজ রেসিপি আর ক’টা খাবারের হয় বলুন? চিন দাবি করে, বিশ্বের সবচেয়ে সহজ রেসিপির ফর্মুলা হল চাইনিজ খাবারের। আমি তো বলব খিচুড়ির ধারেকাছে কেউ নেই। জীবনে রান্নাঘরে যে ঢোকেনি, সেই আনাড়িও আর কিছু না পারুক খিচুড়ি বানাতে পারবে। আজকাল খুব ফিউশন রেসিপির কথা শোনা যায়, খিচুড়ি হচ্ছে সেই ফিউশনের আদি সংস্করণ। ইতালিয়ানরা যে রিসেত্তো রাঁধে, সেও তো মশাই বাংলা খিচুড়ি।

তা, এখন তো বৃষ্টিও ভূগোলবিশেষে ভ্যারি করে। এই ধরুন, হাতিবাগানে বৃষ্টি হচ্ছে, তো গড়িয়াহাটে খা-খা রোদ্দুর। লোকাল ওয়ার্মিং-এর চোটে বাঙালির আজ ত্রাহি মধুসূদন কেস। আলিপুর যদি বলে আকাশ অংশত মেঘলা থাকবে, তো সেদিন দেখবেন মেঘটেঘ কোনও সিনেই নেই। তাই, আপনি যে ওয়েদার ফোরকাস্ট দেখে গিন্নিকে খিচুড়ি রিকোয়েস্ট দেবেন, সেটা হওয়ার জো নেই। আর বৃষ্টি না হলে শুকনো দিনে খিচুড়ি একেবারেই যায় না।

শুধু খিচুড়ির কথা বললে আমার এই গল্পটি অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। অতএব সঙ্গতকারীদের প্রসঙ্গে আসা যাক। আর এই ব্যাপারে আমার এবং আপামর বাঙালির লিস্টিতে প্রথমেই যার নাম আসে, সে হল মাছের রাজা ইলিশ। ভেবে দেখুন ইলশেগুড়ি বৃষ্টি শুরু হতে-না-হতেই খবরের কাগজে শিরোনাম : বাংলাদেশ থেকে ঢুকছে ইলিশ বোঝাই ট্রাক। এমন পরমাস্বাদনীয় বস্তুটির কথা ভাবতেও ভাল লাগে, কী বলুন! তো, খিচুড়ির সঙ্গে ইলিশমাছ ভাজা দিয়ে, অফিস ডুব মেরে, রেনি ডে এনজয় করতে ভালবাসেন না, এমন প্রজাতির বাঙালি বিরল। আমার এক বন্ধুকে জানি, যে ফি-বছর তার বসের বাড়িতে ইলিশ মাছ পাঠিয়ে রেনি ডে-র ছুটির জন্য অ্যাপ্লাই করে। ছুটি মঞ্জুর না করে উপরওয়ালা যায় কোথায়!

অবশ্য শুধু ইলিশের কথা বললে অন্য ভাজাগুলোর প্রতি অন্যায় করা হবে। সামান্য ডিমভাজাও যে খিচুড়ির সঙ্গে কত ভাল যায়, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। আর পাপড়, যাকে কিনা প্রায় খিচুড়ির অর্ধাঙ্গিনীই বলা যায়। এমন লং লাস্টিং মানিকজোড়, সুখাদ্যের ইতিহাসে পাকা জায়গা নিয়ে বসে আছে বছরের পর বছর। পাপড় আবার ভাজা ও স্যাঁকা—দুয়েতেই সমান উপভোগ্য। এ ছাড়া বেগুন, পটল, আলু ইত্যাদি-প্রভৃতির ভাজা তো আছেই।

আরেকটা জিনিসের কথা না বললেই নয়। খিচুড়ির সঙ্গে যেটা মাস্ট। সেটা হল ঘি। গাওয়া হলে তো কথাই নেই। ওটি ছাড়া, বস্, আর যাই হোক খিচুড়ি জমে না। গরম গরম খিচুড়িতে দু’চামচ গব্য ঘৃত! আহা!!! এমন স্বাদ জন্মজন্মান্তরেও ভুলিব না।

শেষ পাতে, আমার গুরুস্থানীয় খিচুড়ি-শেফ জগাদার কথায় ফিরে আসি। শুনছি, সে নাকি আজকাল লন্ডনের বাঙালিপাড়ায় একটা নতুন দোকান করেছে। সাহেবসুবোরা নাকি লাইন দিয়ে সেই রেস্তোরাঁয় ভিড় জমাচ্ছে। দোকানের মাথায় জ্বলজ্বল করছে মস্ত নিয়ন সাইন : জগা’স খিচুড়ি, হোয়্যার এভরি ডে ইজ রেনি ডে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন