বাবাই ছিলেন ফেলুদা

নোট বাতিলের বাজারে ফিরছেন ফেলু মিত্তির। মগজাস্ত্র এ বার আরও প্রখর। রিলিজের দু’ সপ্তাহ আগে সন্দীপ রায়-এর মুখোমুখি স্রবন্তী বন্দ্যোপাধ্যায় বিকেল চারটে। সেই পুরনো টেবিল আর চেয়ারে তিনি। চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বিভিন্ন ভাষায় ফেলুদার বই। মোবাইল নেই। প্রতিদিন এই সময়টায় জরুরি ফোনগুলো সেরে নেন ল্যান্ডলাইনে।

Advertisement
শেষ আপডেট: ৩০ নভেম্বর ২০১৬ ০০:৪৯
Share:

বিকেল চারটে। সেই পুরনো টেবিল আর চেয়ারে তিনি। চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বিভিন্ন ভাষায় ফেলুদার বই। মোবাইল নেই। প্রতিদিন এই সময়টায় জরুরি ফোনগুলো সেরে নেন ল্যান্ডলাইনে। এটাই সন্দীপ রায়ের রোজকার রুটিন। কুকি জারের প্রিয় কেক আর চায়ে চুমুক দিয়ে শুরু করলেন আড্ডা...

Advertisement

২০১৬। সত্যজিৎ রায় ‘ডাবল ফেলুদা’ বানালে কী করতেন?

Advertisement

(মাথা নিচু করে বেশ কিছুক্ষণ ভেবে) এখন বাবা বেঁচে থাকলে ফেলুদা করতেন না। সন্তোষদা (সন্তোষ দত্ত) চলে যাওয়ার পর বাবার ফেলুদা করার ইচ্ছেটাই চলে গেল। জটায়ু ছাড়া বাবা ফেলুদা ভাবতে পারেননি। তাও যদি দর্শকের চাহিদায় ফেলুদা করতেন তা হলে আমার মনে হয়, বাবা ফেলুদাকে আজকের সময়ের মতো করে নিশ্চয়ই বদলাতেন।

মানে ফেলুদার হাতে মোবাইল! হোয়াটসঅ্যাপ করতেন?

(হেসে) এটা বলা খুব মুশকিল।

কিন্তু আপনি জটায়ু ছাড়াই ফেলুদা করলেন। আর আজও ফেলুদাকে মোবাইল দিলেন না...

আমি তো ‘ছিন্নমস্তার অভিশাপ’ করতে চেয়েছিলাম। আজও চাই। কিন্তু বিশ্বাস করুন জটায়ু পাচ্ছি না। খুব সমস্যা এটা নিয়ে জানেন।

জটায়ুর রোলে খরাজ মুখোপাধ্যায়কে মনে হয় না?

না। আমি কনস্ট্যান্টলি জটায়ু খুঁজে বেড়াচ্ছি। নয়তো ফেলুদা আটকে যাবে।

শুধুই জটায়ু খুঁজছেন? সব্যসাচী চক্রবর্তীর পর কে ফেলুদা হবেন ঠিক হয়ে গেছে?

(আবার কিছুক্ষণ ভাবলেন) এখনও কিছু ঠিক হয়নি।

সত্যজিৎ রায়ের ম্যানুস্ক্রিপ্ট (বাঁ দিকে), সন্দেশ-এ প্রথম প্রকাশিত সেই গল্প(ডান দিকে)

ঠিক হয়নি মানে? আবীর চট্টোপাধ্যায় কি আবার ফিরবেন?

আবীর তো ব্যোমকেশ করবে। তাই ওকে আর ফেলুদা ভাবছি না। এটা কখনই হতে পারে না। ব্যক্তিগত ভাবে ফেলুদার জন্য আবীর আমার পছন্দের। ও নিজেও খুব এক্সসাইটেড ছিল। কিন্তু আসলে আমার পছন্দের ওপর সবটা নির্ভর করে না। দর্শক কী চাইছে সেটাই আসল। খেয়াল করে দেখবেন বেণু (সব্যসাচী)কে আজও অনেকে শুধু ফেলুদাই ভাবে। কিন্তু আবীর শুধু ফেলুদা নয়। আবীর ব্যোমকেশও।

তা হলে পরের ফেলুদা সব্যসাচী চক্রবর্তীই?

ওই যে বললাম। দর্শক ‘ডাবল ফেলুদা’য় ওকে কী ভাবে নেয়, সেটা দেখার অপেক্ষায়। তবে এ বার ও অসম্ভব এনার্জি নিয়ে ফিরেছে।

কিন্তু ফেলুদা আর সব্যসাচীর বয়স...

(থামিয়ে দিয়ে) বড় পর্দায় বয়স লুকোনো যায় না। চড়া মেকআপ দিলে বয়স আরও বেরিয়ে আসে। তাই বয়স যা, আমরা সেটাই রেখেছি। কিন্তু সেই পঁচানব্বই সাল থেকে বেণুর সঙ্গে ফেলুদা করছি। আমি হাঁ করলেই ও বুঝতে পারে আমি কী বলতে চাইছি। আমার তো মনে হয় ওর রক্তে ফেলুদা। ওর অ্যাপিয়ারেন্সেও একটা চটক আছে। আর এটা তো জাস্ট ফেলুদা করা নয়। এই ছবিটা একটা ট্রিবিউট হিসেবে আমরা ধরছি।

ট্রিবিউট বলতে?

ফেলুদার সঙ্গে জড়িয়ে আছে এমন পুরোনো মানুষদের আমরা ছবির শেষে ফিরিয়ে আনছি। ছবি শেষের পর নাম দেখানোর সময় লোকে উঠে পড়ে। আমরা এই ধারাটা বন্ধ করতে চাই। ‘ডাবল ফেলুদা’-র শেষে একটা চমক থাকছে। সেটা এখন ভাঙছি না। তবে এটুকু বলি লোকে না দেখে উঠতে পারবে না।

আচ্ছা একটা কথা বলুন, আপনার মতে সেরা ফেলুদা কে?

এই রে! এ বার তো সেফ খেলতে হবে...

সেফ খেলা যাবে না। একজনের নাম বলতে হবে।

(কিছুক্ষণ চুপচাপ) এ ভাবে রেট করতে হলে আমি ফেলুদার রচয়িতাকে গুরুত্ব দেব। আর তার চোখে তো সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ই ফেলুদা। তবে আজকের সময়ে ফেলুদা বললে আমার বেণুকেই মনে হয়।

সেই ডিপ্লোম্যাটিক উত্তরই দিলেন কিন্তু...

না, দিলাম না। ফেলুদা প্রকাশনারই পঞ্চাশ বছর। ভাবুন তো কতটা সময় জুড়ে এই চরিত্রটা আছে। সময় অনুযায়ী তার মুখটা তো বদলাবেই।

কী বলছেন, ফেলুদা বদলাল কই...

শুনুন, শুনুন। এই সময়ের মতো করেই ফেলুদা হয়েছে। অনেকেই আমায় বলেছিলেন যতই গুগল আসুক, ফেলুদা আর সিধু জ্যাঠা একে অন্যের সঙ্গে জড়িয়ে আছে। সময় পাল্টালেও এটা বাদ দেওয়া যায় না।

ছবিতে একটা সংলাপ আছে ফেলুকে বলছেন সিধুজ্যাঠা, ‘আমার আর কী দরকার। এখন তো ইন্টারনেট এসে গেছে।’ ফেলুদা উত্তর দিচ্ছে, ‘নেট-য়ের থেকে আপনার উত্তর তাড়াতাড়ি পাব।’ তবে এই ছবিতে ফেলুদা বা তোপসে কেউ মোবাইল ব্যবহার করেনি। আশপাশের লোক মোবাইল ইউজ করেছে।

শালর্ক হোমস কিন্তু বদলাল...

আরে শার্লক হোমস কবে লেখা হয়েছে দেখুন। সময় দিতে হবে। শার্লকের ফার্স্ট সিরিজ দেখে বেশ লেগেছিল। পরেরগুলো তেমন দাঁড়ায়নি। বদল যেটুকুই হোক এ বারের ফেলুদা রিলিজ নিয়ে বেশ চিন্তা আছে।

কেন?

চিন্তাটা ‘ডাবল ফেলুদা’ নিয়ে নয়। ছবি নিয়ে আমি যথেষ্ট কনফিডেন্ট। একই অভিনেতা ফেলুদা আর ব্যোমকেশ করছে সেই চাপটাও এ বার নেই। সবই ঠিক ছিল। কিন্তু ডিমনিটাইজেশন তো ঝামেলা বাঁধিয়ে দিল! সবাই কি আর অনলাইনে টিকিট কেটে ফেলুদা দেখবে?

অভিনেতা আলাদা হলেও রিলিজটা তো একদিনে।

দেখুন, শাহরুখ খানের ‘ডিয়ার জিন্দেগি’ যত সংখ্যক দর্শকের দেখার কথা, তার চেয়ে অনেক কম দর্শক দেখছে। আসলে সব ছবির ক্ষেত্রে দর্শক কমে যাওয়ায় সমস্যা হচ্ছে। সময়টাই বড্ড গোলমেলে। লোকে পয়সা বাঁচিয়ে রাখছে। সেখানে সিনেমা দেখার বিলাসিতা করবে কী ভাবে? তার ওপর একসঙ্গে দুটো ছবি। লোকে হয়তো যে কোনও একটা দেখতে যাবে। চিন্তা তো থাকছেই।

সব্যসাচী চক্রবর্তী

‘ডাবল ফেলুদা’ কেন দেখতে যাবে লোকে?

বরাবর ফেলুদার একটা নিজস্ব দর্শক আছে। তবে এটুকু বলতে পারি এ বার ‘ডাবল ফেলুদা’ অন্য সব ফেলুদার থেকে আলাদা। এ বছর ফেলুদা নিয়ে কাজ করার আগে প্রচুর চিঠি পেয়েছিলাম আমি। তাতে বেশির ভাগ লি‌খেছিলেন ফেলুদা শেষ কয়েকটা ছবিতে মগজাস্ত্রের চেয়ে অনেক বেশি অস্ত্র ব্যবহার করছেন। ফেলুদাকে ঠিক যেন ফেলুদা মনে হচ্ছে না। তারা মারকাটারি মগজাস্ত্রের খেল দেখতে চান। সেই কথা মাথায় রেখে এ বারের ফেলুদা মগজ নিয়ে লড়াই করেছে। অনেক বেশি ইনটেন্স। এত ফেলুদা করেছি কিন্তু এই প্রথম ‘সমাদ্দারের চাবি’ আর ‘গোলকধাম রহস্য’ এ দু’টো ছোট গল্প নিয়ে ফেলুদা করলাম।

(কথা বলতে বলতে রে সোসাইটির আর্কাইভ থেকে বের করে আনলেন লাল মলাটের ডায়রি। পাতা ওল্টাতেই চমক। কালির পেনে বেরিয়ে এল ‘ফেলুদার গোয়েন্দাগিরি’। সত্যজিৎ রায়ের লেখা ফেলুদার প্রথম ম্যানুস্ক্রিপ্ট।)

‘ডাবল ফেলুদা’য় কি অনেক বেশি করে সত্যজিৎ রায়কে পাওয়া যাবে?

ঠিক তাই। এটা বলতে গেলে কিছু কথা বলতে হয়। বাবা বরাবরই গল্প বা চিত্রনাট্য লিখে তার ফার্স্ট ড্রাফটটা নিজেই লিখতেন। অন্য কারও হাতে কপি করার জন্য ছাড়তেন না। কারণ চিত্রনাট্য ফ্রেশ করার সময় অনেক কিছু বদলাতে বদলাতে যেতেন। ফেলুদার গল্প লেখার সময় প্রথম কপিটা মা (বিজয়া রায়)-র কাছে যেত। মা কিন্তু বাবার চেয়ে
অনেক বেশি গোয়েন্দা সিরিজ পড়তেন। সে কারণে ফেলুদার জন্য বাবা ভীষণভাবে মায়ের ওপর নির্ভর করতেন। মা চিত্রনাট্যটা পড়ার সময় পেনসিল দিয়ে নিজের বক্তব্য লিখে রাখতেন। দু’জনে তর্ক হতো। কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দেখেছি মায়ের যুক্তি মেনে নিয়েছেন বাবা। কিন্তু ‘সমাদ্দারের চাবি’ আর ‘গোলকধাম রহস্য’ এই দু’টো গল্পে মায়ের পেনসিলের আঁচড় পড়েনি। আর বাবাও এই দু’টো গল্প লিখে খুব খুশি হয়েছিলেন।

জেমস বন্ড, ব্যোমকেশ, শবর, কিরীটী — গোয়েন্দাদের আশেপাশে নারী, রোম্যান্স, সেক্স। কিন্তু ফেলুদা বরাবর একা। নারীহীন। তাও এত জনপ্রিয় কেন?

ফেলুদা নারীহীন বলেই জনপ্রিয়। আর বাবার লেখা গল্প আমি বদলাব না। বাবা তো কিশোরদের জন্য ফেলুদা লিখতেন। কিন্তু মজার কথা আগে বড়রা পড়়তেন। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় একবার বাবাকে বলেছিলেন ‘দেশ’ পত্রিকায় সব লেখা ছেড়ে প্রথম ফেলুদাই পড়েন। বাবা খুব অবাক হয়েছিলেন। এক সময় ফেলুদার চাহিদা এমন বাড়়ল ‘দেশ’ পত্রিকার সঙ্গে সঙ্গে ‘আনন্দমেলা’-তেও ফেলুদা লিখতে হল বাবাকে। নারী বর্জিত ক্রাইমের লেখা আর কাঁহাতক লেখা যায়? বাবা ফেলুদা লেখা থামালেন।

যাটের দশকের মাঝামাঝি মধ্যবিত্ত বাড়ির এক গোয়েন্দার ন্যাশনাল লেভেলে আজ আদৌ গ্রহণযোগ্যতা আছে কি?

না থাকলে ইরোস ইন্টারন্যাশনাল-য়ের মতো সংস্থা ফেলুদা প্রযোজনার কথা ভাবতেন না। আর ওড়িয়া থেকে মরাঠি, ভারতের এমন কোনও ভাষা নেই যাতে কি না ফেলুদা অনুবাদ হয়নি! ফরাসি, ইতালিয়ান এবং জাপানিজেও ফেলুদা অনুবাদ হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের বাইরে ফেলুদার গল্প পড়ার চেয়ে বড় পর্দায় ফেলুদাকে দেখে মানুষ বেশি চিনেছে। প্রদীপ সরকার ‘সোনার কেল্লা’র দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে সেটা নিয়ে কাজ করারই কথা ভাবছেন।

সন্দেশে প্রকাশিত ‘সমাদ্দারের চাবি’ ও‘গোলকধাম রহস্য’য়ের প্রথম হেডপিস

অনেকে বলে আপনি বিশ্বভারতী। ফেলুদার কপিরাইট ছাড়ছেন না।

না তো! অন্য ভাষায় হোক না ফেলুদা। দিবাকর বন্দ্যোপাধ্যায় যেমন ব্যোমকেশের প্রায় সব রাইট একসঙ্গে কিনেছেন। হিন্দিতে কেউ রাইটস কিনলে আমি রাজি।

কিন্তু বাংলায় তো রাজি নন।

নাহ!

কীসের ভয়?

ভয় কিছু নেই। দেখুন না, ব্যোমকেশ, কিরীটীর রাইটস বিক্রির ফলে কী হাল হয়েছে। দু’দুটো ব্যোমকেশ, তিনটে কিরীটী...আমি চাই না বাংলায় অনেক অনেক ফেলুদা হোক।

ফেলুদার মতো কোনও মানুষকে সত্যজিৎ রায় কি চিনতেন?

বাবাই ছিলেন ফেলুদা। ফেলুদার অনেস্টি, ডেডিকেশন, বুদ্ধি, জ্ঞান, সবই তো বাবার মতো দেখেছি। এমনকী ফেলুদা যা খেতে ভালবাসত বাবাও তাই খেতে ভালবাসত। যত সময় যাচ্ছে ফেলুদা করতে গিয়ে মনে হচ্ছে বাবাকে নতুন করে খুঁজে পাচ্ছি...

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন