Nirmala Mishra

Nirmala Mishra: জিভের নীচে সর্বিট্রেট! টানা ২ ঘণ্টা গাইলেন পিসি: দিলীপ মিশ্র

ঝামেলা পিসি। ডাকাবুকো। অন্যায়ের প্রতিবাদী। অসহায়দের প্রতি দরদি। রক্তমাংসের নির্মলা মিশ্র ভাইপো দিলীপের কলমে।

Advertisement

দিলীপ মিশ্র

কলকাতা শেষ আপডেট: ৩১ জুলাই ২০২২ ১০:৩৯
Share:

নির্মলা পিসির গল্পে ভাইপো দিলীপ মিশ্র

আমাদের গানবাজনার পরিবার। আমার পিসি নির্মলা মিশ্র ছোট বেলায় নাড়া বেঁধেছিলেন ওঁর বাবা পণ্ডিত মোহিনীমোহন মিশ্রের কাছেই। পিসি তখন জোরকদমে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত শিখছেন। আচমকাই টাইফয়েড হল। সেই সময়ে দুরারোগ্য ব্যাধি। পিসির চিকিৎসা করেছিলেন বিধানচন্দ্র রায়। ওঁর চিকিৎসায় পিসি সুস্থ হলেন। কিন্তু পার্শ্ব প্রতিক্রিয়ায় অত ছোট বয়স হৃদ্‌রোগ দেখা দিল!

Advertisement

বিধান রায়ের কড়া নির্দেশ, আর গান শেখা চলবে না। বিশেষ করে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত। কিন্তু আমার নির্মলা পিসিকে দমায় কে? সবাইকে লুকিয়ে আধুনিক গান শিখতে আরম্ভ করলেন! শেষে দাদু ওঁকে এই ধরনের গান গাওয়া বা শেখার অনুমতি দিলেন। এর পরেই একাধিক ব্যক্তিত্বের কাছে গান শেখা। প্রথম রেকর্ড ১৯৫৭-এ।

এ ভাবেই গানের দুনিয়ায় নির্মলা মিশ্রের যাত্রা শুরু। মণি-মুক্তোর মতো মূল্যবান আধুনিক গান তো গেয়েছেন। আর গেয়েছেন ছায়াছবির গান। বিশেষ করে ওড়িয়া ছায়াছবিতে নির্মলা মিশ্রের আলাদা জায়গা ছিল। জনপ্রিয়তার কারণে ওই রাজ্যে পিসির নামের পাশে জ্বলজ্বল করত ‘ফিল্ম কুইন’ তকমা!

Advertisement

গানের পাশাপাশি আমাদের ঝালা পিসি খুব ভাল তবলাও বাজাতে পারতেন। পিসিকে কেন ‘ঝালা পিসি’ বলতাম? আসছি সেই গল্পে। তার আগে বলি, ওঁর ঈশ্বর ভক্তির কথা। স্বামী বিবেকানন্দের অন্ধ ভক্ত ছিলেন পিসি। আমরা তখন ছোট। পিসি পাগড়ি আর গেরুয়া বসনে নিজেকে সাজাতেন। তার পর আমাদের সামনে এসে বলতেন, দেখ, ‘আমি স্বামীজি সেজেছি।’ গোপাল ঠাকুরের বড় ভক্ত ছিলেন। রোজ ঠাকুর পুজো করে তার পর জল খেতেন।

নির্মলা মিশ্রর গান নিয়েও অনেক গল্প আছে। ‘ও তোতাপাখি রে’ গানের ইতিহাস আছে। ওই গানটি প্রথমে আকাশবাণীতে গেয়েছিলেন পূরবী দত্ত। গান শুনেই পিসি ছুটে গিয়েছিলেন ওঁর কাছে। আবদার, দিদি, আমি গানটি রেকর্ড করব? সঙ্গে সঙ্গে পূরবীদি রাজি। এর পর প্রবীর মজুমদারের থেকে গান তুলে পুজোর রেকর্ড করেন। সেই গান আজও শ্রোতারা কান পেতে শোনেন!

জয়দেব সেনের কথায়, সুরে ‘এই বাংলার মাটিতে’ গানটিও জনপ্রিয়। প্রথমে গানটি রেকর্ড হয়েছিল এইচ.এম.ভি থেকে। রেকর্ডিংয়ের পরে সংস্থা সেই গান বাতিলও করেছিল। কেন? ওদের মনে হয়েছিল, গানটি নাকি দেশাত্মবোধক। শুনে পিসি রেগে আগুন। আগের সংস্থা থেকে সরে এসে চলে যান ভি বালসারার কাছে। তাঁর সহযোগিতায় গানটি আবার রেকর্ড হয়। শ্রোতাদের এই গানটিও খুব প্রিয়।

সেই পিসি গত ছ’ বছর ধরে শয্যাশায়ী! অথচ উনিই ২০০১-এ কলকাতা দূরদর্শনের বিশেষ অনুষ্ঠানে টানা গেয়েছিলেন জিভের তলায় দুটো সর্বিট্রেট বড়ি রেখে! তার পরেই ওঁর বাইপাস সার্জারি হয়। বরাবরই পিসি এমন ডাকাবুকো। তাই তাঁর আদরের ডাক নাম ‘ঝামেলা’! আমাদের আরও ছোট্ট ডাক, ‘ঝালা’ পিসি। বাংলায় তখন কংগ্রেস আমল। বেলেঘাটার রতন ঘোষ একই সঙ্গে বিখ্যাত, কুখ্যাতও। তিনি তখনকার তাবড় শিল্পীদের বলে পাঠাতেন, চলে আসবেন অনুষ্ঠানে। তাঁরাও ভয়ের চোটে উপস্থিত হতেন। ব্যতিক্রম আমার পিসি। মুখের উপরে সটান বলেছিলেন, পারিশ্রমিক দিন। নিশ্চয়ই গাইব। বিনা পারিশ্রমিকে নয়! ওই রতন পরে পিসিকে মা বলে ডাকতেন। আবার এই পিসিই কত জনকে অনুষ্ঠানে গান গাওয়ার সুযোগ করে দিয়েছেন!

শনিবার রাত ১২টায় মিশ্র পরিবারের শেষ স্তম্ভও বিদায় নিলেন। নিজের বাড়িতে হৃদ্‌রোগ এবং সেরিব্রালে আক্রান্ত হন। ওঁর একটা ঘর নানা জায়গা থেকে পাওয়া পুরস্কারে বোঝাই। রাজ্য সরকার ওঁকে ‘বঙ্গবিভূষণ’ সম্মান দিয়েছে। রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় ওঁকে ডক্টরেট উপাধি দেওয়া হয়েছিল। পিসির সঙ্গে একই সম্মান পেয়েছিলেন অমল পালেকর, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়। ওড়িশা সরকার পিসিকে দিয়েছিল ‘গান গান্ধর্বী’ পুরস্কার। আরও কত সম্মান, মানপত্র। সব ফেলে রেখে নির্মলা মিশ্র সত্যিই দিনের শেষে ঘুমের দেশে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন