রাস্তার নাস্তা

স্ট্রিট ফুড ব্যাপারটা একটা আর্ট। যে কোনও স্বীকৃত-স্বাধীন শিল্পমাধ্যমের মতো এও চরিত্রে মৌলিক — লিখছেন অঞ্জন চট্টোপাধ্যায়ছোটবেলায় আমাদের সবার মা-ই পইপই করে পাখি পড়াতেন : ‘‘খবরদার! রাস্তায় কেউ কিছু দিলে খাবি না।’’ যে কোনও নিষিদ্ধ জিনিস অমান্য করতে পারলে আমাদের তৃপ্তি ষোলো আনা। আজও, সেদিনও।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৮ নভেম্বর ২০১৬ ০০:৪৮
Share:

চাউমিন

ছোটবেলায় আমাদের সবার মা-ই পইপই করে পাখি পড়াতেন : ‘‘খবরদার! রাস্তায় কেউ কিছু দিলে খাবি না।’’ যে কোনও নিষিদ্ধ জিনিস অমান্য করতে পারলে আমাদের তৃপ্তি ষোলো আনা। আজও, সেদিনও। তাই, অবলীলায় স্কুলফেরত পেটে ঢুকেছে ফুচকা, আলুকাবলি, কাঠি আইসক্রিম, বু়ড়ির চুল ও আরও অখাদ্যবিশেষ। রাস্তার নাস্তার সঙ্গে, তাই অনেকের মতোই সেই কবেকার ছেটবেলায় আমার আলাপ, এবং সত্যি বলছি, আজও আমার নিয়মিত যোগাযোগ আছে। তবে এখন অথরিটিটা বদলে গেছে। মায়ের জায়গায় বউ, এমনকী মেয়েও। আজও আমাকে তাদের দৈববাণী শুনতে হয়, বাড়ির বাইরে পা রাখলেই।

Advertisement

স্ট্রিট ফুড ব্যাপারটা একটা আর্ট। যে কোনও স্বীকৃত-স্বাধীন শিল্পমাধ্যমের মতোই এও চরিত্রে মৌলিক। পাড়ার মোড়ে যেভাবে চাউমিন তৈরি হয়, চিনেরা তা কল্পনাও করতে পারবে না। আর কলকাতার রোল তো রীতিমতো রকিং! যে কোনও টাইমে হারুদা-নাড়ুদারা এর পেটেন্টের জন্য অ্যাপ্লাই করতে পারেন। পার্ক স্ট্রিটের কুসুম স্ন্যাক্স বার, বা হট-কাটি-রোল ওয়ার্ল্ড ফুড ম্যাপে সামনের সারিতে আসার যোগ্য। বিবেকানন্দ পার্কের দই-ফুচকা হোক, বা ডেকার্স লেনে চিত্তদার ফিশফ্রাই, কিংবা মুক্তারামবাবু স্ট্রিটের গরম গরম জিলিপির স্বাদ—আই বেট, পৃথিবীর কোনও শেফ অ্যাচিভ করতে পারবেন না। উত্তর কলকাতার প্যান্থেরাস যিনি না খেয়েছেন, তিনি কী করে বুঝবেন যে, পৃথিবীর কোনও ম্যানেজমেন্ট স্কুলে এই বিদ্যে আয়ত্ত হওয়ার নয়।

ঠিক সে কারণেই, বাংলার বাইরে, আমার সুইট বেঙ্গল কনফেকশনারি চেনের জন্য হালুইকরদের আমি উত্তর কলকাতার টিমটিমে মিষ্টির দোকান থেকে নিজে হাতে তুলেছি। অমন পরমান্ন তাঁরা ছাড়া আর কে বানাবেন? আবার ঠিক সে জন্যই সাহস করিনি মেনল্যান্ড চায়নায় চাইনিজ ব্রেকফাস্ট ইন্ট্রোডিউস করতে! বেন্টিঙ্ক স্ট্রিটের সেই সব মায়াময় ওরিয়েন্টাল ডেলিকেসি তো জন্ম থেকেই স্পেশাল। তাকে আর পাঁচতারা স্পেশালিটি রেস্তোরাঁর ছাতার তলায় নাই বা আনলাম!

Advertisement

স্ট্রিট ফুডের আর একটা ভাল দিক আছে। রাস্তার খাবার খেয়ে শরীরের রেজিস্টান্স পাওয়ার বাড়িয়ে ফেলেছেন, এমন রসিকের সংখ্যা নেহাত কম নয়। ছোটখাটো অসুখ-বিসুখ তাঁদের আর গায়েই লাগে না।

লাহোর-পেশোয়ারের কাবাব সরণি থেকে বউবাজার-শেয়ালদার মাংসের ঘুগনি— স্ট্রিট ফুডের জয় তাই সর্বত্র। হাইওয়ের ধারে, ধাবার বদলে চাইনিজ রেস্তোরাঁ খুললে, অটোমেটিক সিগনাল রেড হয়ে যাবে, এ কথা আমি হলফ করে বলতে পারি। তড়কা-রুটি ছেড়ে যাত্রীরা যেদিন পিৎজা-পাস্তা খাওয়া ধরবে, কে জানে, জনগণ তাকে উন্নয়ন বলবে কি না! ভয় হয়, পথের শিকড় যেন আমাদের উপড়ে না যায়।

তবে পথের থেকে বিপথের পথ্যেই বাঙালিদের সর্বসম্মতি। বাড়িতে তৈরি ফুচকার সত্যিই কি মজা আছে, বলুন তো! রাস্তার মামলেটে যে ধুলোমাখা স্বাদ, বাড়ির হাইজিন ওমলেট কি কোনও দিন তা দিতে পেরেছে, না পারবে? পুজোর আগে কুমোরটুলিতে ঠাকুর আনতে যাঁরা গেছেন, তাঁরা কি জীবনেও ভুলতে পারবেন সেই খিদে-পেটে দুর্গতিনাশিনী মামলেটের সৌরভ?

উত্তর-আধুনিক কলকাতার শ্যামপুকুর স্ট্রিটের এক রসিক-পথিকের কথা দিয়ে এই পথ-রসনার যবনিকা টানি। পাড়ার মোড়ে যে দোকান চিরকাল এগরোল আর চাউমিন করে এসেছে, রিসেন্টলি তারা পাস্তাও পরিবেশন করছে। সেটা খেয়ে ওনার রিঅ্যাকশন কলকাতার স্ট্রিট ফুড রেসিপিকে অন্য হাইটে নিয়ে গেছে—‘‘আহা! সেদিন পাড়ার মোড়ে যা রাস্তা খেলাম না, অনেকটা ইতালিয়ান পাস্তার মতো খেতে!’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন