মায়ের গল্প শোনালেন রূপা গঙ্গোপাধ্যায়। গ্রাফিক: সনৎ সিংহ।
মাকে আমার বড্ড মনে পড়ে! ইদানীং, কথায় কথায় চোখ ভিজে উঠছে। কিন্তু এই অনুভূতিকে প্রশ্রয় দিতে চাই না। শ্রাদ্ধশান্তি মিটতেই তাই কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েছি। মায়ের কথা মনে পড়লে চোখ মুছে কাজে বসে যাই।
জানেন, আমি সহজ দুটো পন্থা বের করেছি। রোজ কয়েক মুহূর্তের মায়ের সঙ্গে কথা বলি। বাবা চলে যাওয়ার পর প্রথম এই পন্থা বের করেছিলাম। খুব বোকা কিছু কথা হয় না? যা মনে হয় বলে যাই। রাগ হলে হয়তো কড়া কথা বললাম। যে দিন মন ভাল থাকে, সে দিন আমার কণ্ঠস্বর নরম। আর বেরোনোর আগে ঈশ্বরের পাশাপাশি মাকেও ধূপ দেখাই।
মা তো আমার হারায়নি! আমায় ছেড়েও যায়নি কোথাও।
মহালয়ায় সকলে পিতৃপুরুষকে জল দেন। এ বছর আমি কিছুই করতে পারব না। পরের বছরের অপেক্ষায় রইলাম। হ্যাঁ, আমি তর্পণ মানি। মায়ের কাজ মিটে গেলেও যেমন রোজ একটু পেঁপে, উচ্ছে, আলু সেদ্ধ দিয়ে ভাত খাই। যেন আমার হবিষ্যি এখনও মেটেনি। হয়তো কালাশৌচ চলছে বলে মন থেকে এই আচার পালনের তাগিদ পাচ্ছি। ইচ্ছে, আগামী বছর গয়া বা বারাণসীতে গিয়ে মায়ের তর্পণ করব।
আমার মা সত্যিই দশভূজা। অদৃশ্য আরও আটটা হাত যেন ছিল তার। সেই হাত দিয়ে আমায় সামলেছে, সংসার আগলেছে। কী কষ্টই না করেছে! মাকে একটা সময় পর্যন্ত খুব পরিশ্রমও করতে হয়েছে। তখন আরাম কাকে বলে জানত না। আমার বাবাও তা-ই ছিল। দু’জনের থেকে পরিশ্রম করার গুণটা আমি পেয়েছি। যেমন, ওঁদের রাগ আমার শরীরে প্রবল পরিমাণে। এই মা একা হাতে সেলাইয়ের কাজ করে আমায় বড় করেছে। ছোট থেকেই খুব সাহসী করে দিয়েছে। আমি তখন তৃতীয় শ্রেণি। মা আমায় একা ছেড়ে দিলেন! বললেন, ‘রানিকুঠিতে জেঠুর বাড়ি চিনে যেতে পারবি না’? ঘাড় নেড়ে বলেছিলাম, পারব। প্রথম প্রথম মা রাস্তা চিনিয়ে দিয়েছিল। যে দিন প্রথম একা গেলাম, সে দিন ঠাকুমার কী রাগ! ‘এতটুক মাইয়্যা রে ছেড়ে দিল’! গজগজ করছে রাগে! মা পরে হেসে ফেলে বলেছিল, ওকে তো একাই চলতে হবে। তাই ছোট থেকেই অভ্যাস করতে হবে।
অনেক ছোট থেকেই তাই অনেক বড় আমি। তৃতীয় শ্রেণির মেয়েটিকে একা ছাড়তে হবে। ওই বয়সেই মা নারীশরীরের সমস্ত খুঁটিনাটি জানিয়ে রেখেছিলেন, যাতে একলা পথে বিপদ না আসে। ওই বয়সেই খাটে উঠে মশারি ভাঁজ করতে পারতাম। বাথরুম, রান্নাঘর পরিষ্কার, বাসন মাজা— সব গুছিয়ে করতে পারি। সপ্তম শ্রেণিতেই মায়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে শায়া, ব্লাউজ মেশিনে সেলাই করতে পারতাম।
রাগের পাশাপাশি আমার মায়ের খুব জেদ। ভীষণ তেজি, কড়া ধাঁচের এক নারী। যার থেকে শক্তি পাওয়া যায়। যার দুটো চোখ সারা ক্ষণ ‘সার্টলাইট’ হয়ে মেয়ের উপরে ঘুরছে! কোনও ছেলের দিকে বেশি বার তাকাতে পর্যন্ত পারতাম না! ওমনি মা বলে উঠত, “তুই যেন বড় বেশি ওর দিকে দেখতাসস!” এই মাকে খুব মনখারাপে জড়িয়ে ধরা যায় না! আমি মাকে কখনও, কোনও দুর্বল মুহূর্তে জড়িয়ে ধরতে পারিনি। আমার ওই আশ্রয়স্থল বাবা। তার পরেও বলব, স্বামী বাংলাদেশে। এ পার বাংলায় একা এক মা মেয়েকে মানুষ করছেন সেলাই-ফোঁড়াই করে। আমার জেঠু খুবই সাহায্য করতেন মাকে। আমার মা বলেই হাসিমুখে লড়তে পেরেছে।
আমার মায়ের একটাই শখ, ওঁর লম্বা চুল কেউ আরাম করে আঁচড়ে দেবে। বলত, “রূপা, তোর যখন অনেক পয়সা হবে, সে দিন এক সহকারী রেখে দিস। আরাম করে চুল আঁচড়ে দেবে।” আমিই মায়ের চুল আঁচড়ে দিতাম। যখন মাথায় হাত দিতাম, আরামে মা চোখ বুজে ফেলত। বলত, “তোর হাতে বড্ড মায়া রে রূপা! তোর শরীরটাই মায়ায় গড়া।” মাকে নিয়ে আমার কোনও আক্ষেপ নেই। আমার যতটা ক্ষমতা ততটা দিয়ে মায়ের সেবা করেছি।