ইংল্যান্ড আর শ্রীলঙ্কার ম্যাচ চলছে। হঠাৎ দেখি স্টুডিয়োর ক্যাফেতে একা একা বসে আছেন বিশ্ব ক্রিকেটের অন্যতম লেজেন্ড ওয়াসিম আক্রম।
পাশে গিয়ে বসলাম। জিজ্ঞেস করলাম, ‘‘ওয়াসিম ভাই, ক্যয়া হুয়া।’’ আমার কথা শুনে অন্যমনস্ক ভাবেই তাকালেন ওয়াসিমভাই। বললেন, ‘‘কুছ নেহি দীপ। থোড়া ফ্যামিলি কি ইয়াদ আ রাহি থি। বহোত দিন দেখা নেহি বাচ্চো কো।’’ চোখের কোণে জল দেখলাম কি না জানি না, কিন্তু ওই একটা কথা শোনার পর থেকে কোথাও যেন আমি আর ‘দ্য গ্রেট’ ওয়াসিম আক্রম এক হয়ে গেলাম।
আমার বাড়িতেও ছেলেরা রয়েছে, স্ত্রী রয়েছে। বাইরে বাইরে থাকায় তাদেরকে খুব মিস করি। কিন্তু কী আর করা! খেলা চলাকালীন যেমন
আমরা সবাই মিস করতাম ফ্যামিলিকে, আজকে কমেন্টেটরদের পৃথিবীতে এসেও কিছু জিনিস যেন বদলাবার নয়।
হ্যাঁ, আজকে আমাদের এই কমেন্টেটরদের পৃথিবীর কিছু কথা আপনাদের বলতে চাই। এমনিতে মাঠে গেলে আমরা কী করি বা বলি আপনারা জানতেই পারেন। কিন্তু এর বাইরে স্টুডিয়োতেও কিন্তু আমাদের একটা অন্য জগৎ আছে। এবং সেই জগৎটা সম্বন্ধে কেউ বিশেষ জানেও না। স্টার স্পোর্টসের এই স্টুডিয়োতে আমাদের দিনের অধিকাংশ সময় কাটে। লোয়ার প্যারেলের এই স্টুডিয়োতে একটা ক্যাফে আছে। সেখানেই যত গল্প, যত আড্ডা। ঢুকলেই আপনার মনে হবে এটা যেন কোনও ড্রেসিং রুম। শুধু ব্যাট,
প্যাড আর গ্লাভসের বদলে মাইক, টাই আর ব্লেজার।
ওই ক্যাফের একটা টেবিলে দেখবেন কপিল দেব বসে আছেন, তাঁর সঙ্গে রিভার্স সুইং নিয়ে একমনে আড্ডা দিয়ে চলেছেন ব্রেট লি। অন্য দিকে বিরাট কোহালির নতুন স্টান্স নিয়ে ঘরের কোণে আড্ডা চলছে ওয়াসিম ভাই আর গাওস্করের। সহবাগ বসে আইসক্রিম খাচ্ছে আর মুখ ভ্যাঙাচ্ছে ভিভিএস লক্ষ্মণকে দেখে। এ যেন সত্যি এক মায়াবী জগৎ।
তবে আমাদের এই কমেন্টেটরদের পৃথিবীকে যখন ড্রেসিং রুম বলছি, তখন সেই কথাটাও তো বলে রাখতে হয়— ‘হোয়াট হ্যাপেনস ইন দ্য ড্রেসিং রুম, স্টেস ইন দ্য ড্রেসিং রুম’।
‘‘গুড মর্নিং, ওয়াসিম ভাই।’’ কিছু না বলে শুধু বললেন, ‘‘খুব চিন্তা হচ্ছে লাহৌরের জন্য দীপ। কাল সারারাত ছটফট করেছি। এক ফোঁটা ঘুমোতে পারিনি। কবে যে শেষ হবে এই টেররিজম। এরা বাচ্চাদেরও ছাড়ছে না।’’
তাই সবটা হয়তো আপনাদের বলা সম্ভব হবে না। কিন্তু কিছু মুহূর্ত তো আনন্দplus-এর পাঠকদের বলতেই পারি। এই টি২০ ওয়ার্ল্ড কাপ শুরু হওয়ার পর থেকেই একজন কমেন্টেটর, ঠিক তার ব্যাটিংয়ের মতো, উল্কাগতিতে উঠে এসেছে শিরোনামে। তার নাম বীরেন্দ্র সহবাগ। সহবাগের কমেন্ট্রিটা ঠিক যেন ওর ব্যাটিংয়ের মতো। কোনও ম্যারপ্যাঁচ নেই... সি দ্য বল, হিট দ্য বল — হল ওর ফিলোজফি।
কোন কথাটা পলিটিক্যালি কারেক্ট, কোন কথাটা বলা ঠিক না — এ সবের কোনও ধার ও ধারে না। আমাদের ড্রেসিং রুমে সহবাগ তাই সবার প্রিয়। সবচেয়ে বেশি পিছনে লাগে ও শোয়েব আখতারের। ওদের দু’জনের খুনসুটি আর পাঞ্জাবি ভাষায় একে অপরকে সম্বোধন করা শুনলে কিন্তু আপনি হেসে লুটিয়ে পড়বেন।
এখানে আর একটা কথাও বলে রাখি। শোয়েব কিন্তু কমেন্ট্রি বক্সেও সহবাগকে বেশ বুঝে শুনে চলে। ওই যে বললাম, সহবাগ যে কখন কী করবে তার কোনও ঠিক নেই।
এর পাশাপাশি রয়েছেন সুনীল গাওস্কর আর কপিল দেব। ওঁরা দু’জনে একসঙ্গে থাকলে বিশ্বাস করুন আমরা এখনও শুধু তাকিয়েই থাকি। দু’জনেই ছোটবেলার আইডল। এখনও অদ্ভুত লাগে যখন গাওস্কর আমাকে আমার পরিবারের কথা জিজ্ঞেস করেন কিংবা কপিল পাজি ডিআরএস নিয়ে কথা বলেন আমাদের সঙ্গে। মনে হয় একেই বোধ হয় বলে ‘ড্রিম কাম ট্রু’।
কিন্তু এ সবের পরেও বলছি, ক্রিকেট ড্রেসিং রুমে যেমন আমরা সিনিয়র প্লেয়ারদের কাছে বেশি ঘেঁষতাম না, ক্রিকেট কমেন্ট্রির পৃথিবীতেও একই ফর্মুলা। এসএমজি আর কপিল পাজির সঙ্গে আমাদের সবার একটা দূরত্ব থাকেই।
অন্য দিকে রয়েছে ভিভিএস লক্ষ্মণ। সারাটা দিন আমরা লক্ষ্মণের খাবার খাওয়া নিয়ে মজা করি। এর মধ্যেই আমাদের মধ্যে শুরু হয় নানা তর্ক। ডেল স্টেইনের টি২০ খেলা উচিত কি উচিত নয়? ফাইনালে ইডেনের পিচ কেমন হওয়া উচিত, কোনও কিছুই বাদ যায় না। এবং ড্রেসিং রুমের মতো এখানেও কিন্তু সব আলোচনা শুধু ক্রিকেট সংক্রান্ত হয় না। সিনেমা, পলিটিক্স... কিছু বাদ নেই।
কিন্তু কমেন্টেটরদের পৃথিবীর এই লেখাটা যাঁকে নিয়ে শুরু করেছিলাম, তাঁকে দিয়েই শেষ করতে চাই।
এটা ইন্ডিয়া-অস্ট্রেলিয়া ম্যাচের পরের দিন সকালের ঘটনা। আমি সকাল সকাল পৌঁছে গেছি স্টুডিয়ো। পৌঁছে টিভিতে লাহৌর ব্লাস্টের খবর দেখছি, এর মধ্যেই ঘরে ঢুকলেন ওয়াসিম আক্রম। টিভি দেখতে দেখতেই আমার পাশে বসলেন।
আমি বললাম, ‘‘গুড মর্নিং, ওয়াসিম ভাই।’’ কিছু না বলে শুধু বললেন, ‘‘খুব চিন্তা হচ্ছে লাহৌরের জন্য দীপ। কাল সারারাত শুধু ছটফট করেছি। এক ফোঁটা ঘুমোতে পারিনি। কবে যে শেষ হবে এই টেররিজম। এখন এরা বাচ্চাদেরও ছাড়ছে না।’’
বাচ্চাদের মিস করার দিন চোখের জল দেখতে না পেলেও সে দিন কিন্তু স্পষ্ট চোখের জল দেখেছিলাম।
মনে হয়েছিল আমাদের পৃথিবীটাও ঠিক আর দশটা সাধারণ মানুষের মতোই। সেখানে ওয়াসিম আক্রমের চিন্তার সঙ্গে সাধারণ মানুষের চিন্তার কোনও তফাত নেই।
এই যে আমরা কমেন্টেটররা একটা যৌথ পরিবারের সদস্য হয়ে উঠেছি, এটাই বোধহয় আমাদের খেলা ছাড়ার পর সেরা পাওনা। আজ এই শহর, কাল ওই শহর — তারপর আবার ক্যাফেতে ফিরে আড্ডা আর ঠাট্টা। এখানে দুঃখ আছে, আনন্দ আছে, আছে চোখের জলও।
আমাদের নতুন ড্রেসিং রুম।