ছবিমুক্তি নিয়ে বিতর্কে মুখ খুললেন অনীক দত্ত, প্রদীপ্ত ভট্টাচার্য, পরমব্রত ও মানসী। গ্রাফিক: আনন্দবাজার ডট কম।
‘দি অ্যাকাডেমি অফ ফাইন আর্টস’ ছবি নিয়ে তরজা চলছে। প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পাওয়ার কথা ছিল ১৪ নভেম্বর। কিন্তু ফেডারেশনের ও ইম্পা-র বাধায় ছবিটি মুক্তি পায়নি। তারকাখচিত এই ছবি আদৌ মুক্তি পাবে কি না, সেই প্রশ্নও উঠেছে। ইতিমধ্যেই ছবির পরিচালক জয়ব্রত দাসের সঙ্গে বৈঠক হয়েছে ফেডারেশনের। কিন্তু মেলেনি কোনও সমাধানসূত্র। ছবির পোস্টারে উল্লিখিত প্রযোজনা সংস্থা প্রমোদ ফিল্মস্-এর সঙ্গে বৈঠকের পরেই কোনও একটা সিদ্ধান্তে আসা যাবে বলে জানিয়েছে ফেডারেশন। কিন্তু এখনও পর্যন্ত সেই বৈঠকই হয়ে ওঠেনি। এর ফলে আটকে ছবির মুক্তি। এই বিষয়ে কী বলছে টলিপাড়া?
ছবির পোস্টার ও ঝলক সাড়া ফেলেছিল দর্শকের মধ্যে। ধুমধাম করে ছবির গানও প্রকাশ করা হয়েছে। প্রচারও চলছিল জোরকদমে। এত জোরদার প্রচার কি স্রেফ ‘স্টুডেন্টস ফিল্ম’-এ সম্ভব? প্রশ্ন উঠেছে। যে প্রযোজনা সংস্থার নাম উঠে আসছে তাঁদের আগের ছবির টাকা বকেয়া রয়েছে বলেও শোনা গিয়েছে। অভিনেতা তথা পরিচালক পরমব্রত চট্টোপাধ্যায় এই প্রসঙ্গে বলেছেন, “কোনও প্রযোজকের যদি আগের ছবির টাকা বাকি থাকে, তা হলে সেটা না মিটিয়ে তাদের পরবর্তী ছবি মুক্তি দেওয়া উচিত নয়। এই ছবির ক্ষেত্রে যে প্রযোজকদের নাম উঠে আসছে, তাদের ব্যাপারে এমনই শোনা যাচ্ছে। আমিও তেমনই জানি।”
অভিনয়ের পাশাপাশি তিনি এখন পরিচালকও। তবে এখনও প্রযোজনা সংস্থা ও ফেডারেশনের নিয়মকানুন স্পষ্ট বোঝেন না বলে জানান মানসী সিংহ। কিন্তু প্রমোদ ফিল্মস-এর বকেয়া টাকা নিয়ে তিনিও একই বিষয় শুনেছেন। মানসী বলেন, “এখন অনেকে বলেন, ‘ফেডারেশন ও শাসকদলকে তৈলমর্দন করছে’। আমি সেই দলে পড়ি না। আমি সত্যিই এই প্রযোজক সংক্রান্ত নিয়মকানুন বুঝি না। শুনতে পাচ্ছি, প্রমোদ ফিল্মস-এর জন্যই ফেডারেশন ছবিটি আটকে দিয়েছে। এই প্রযোজনা সংস্থার অন্য কাজের টাকা নাকি এখনও বাকি আছে। তা হলে তো ছবিটা আটকাবেই।”
তা হলে কি কোনও সমাধানসূত্র নেই? ছবিমুক্তির কি কোনও আশা দেখা যাচ্ছে না? অনবরত সমাজমাধ্যমে নবাগত পরিচালক জয়ব্রত দাস ছবি মুক্তির জন্য সরব হচ্ছেন। ছবির অভিনেতা রুদ্রনীল ঘোষ, রাহুল অরুণোদয় বন্দ্যোপাধ্যায়রাও ছবি মুক্তির উদ্দেশ্যে গলা চড়াচ্ছেন। অভিনেতারা এই ছবির জন্য একটি টাকাও পারিশ্রমিক নেননি বলেও জানা গিয়েছে। অভিনেতাদের অনেকের বক্তব্য, আসলে বাংলা সিনেমার উন্নতির কথা ভেবেই বিনা পারিশ্রমিকে কাজ করেছেন তাঁরা। কিন্তু ফেডারেশনের সভাপতি স্বরূপ বিশ্বাসের দাবি, বিশ্বাসঘাতকতার উদাহরণ এই ছবি। একটি বাণিজ্যিক ছবিকে ‘স্টুডেন্টস ফিল্ম’ হিসাবে চালিয়ে দেওয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ তাঁর। আর তাতেই আপত্তি। ছবিটি নিয়ে ধোঁয়াশার কথা বলেছেন পরমব্রতও। তাঁর কথায়, “প্রত্যেক জায়গায় কিছু নিয়ম থাকে। সেই নিয়ম অনুযায়ী কাজ হয়, তার মধ্যেই হয়তো মাঝেমধ্যে বোঝাপড়া করে নিতে হয়। আমি একটা বিষয় দেখেছি, কোনও ছাত্রছাত্রী যখন স্বল্প দৈর্ঘ্যের ছবি বা ইউটিউবের জন্য ছবি বানায়, তখন ফেডারেশনের তরফ থেকে একটা মানানসই নিয়মাবলি তৈরি করে দেওয়া হয়। যেমন মাইক্রো-ড্রামার জন্য একটা নতুন ধরনের ইউনিট তৈরি করা হয়েছে। এই ছবিটাকে এখন ‘স্টুডেন্টস ফিল্ম’ বলা হচ্ছে, যার ফলে ধোঁয়াশা জন্ম নিচ্ছে। প্রথম থেকে ছবিটি নিয়ে স্বচ্ছতার প্রয়োজন ছিল।”
পরিচালক অনীক দত্ত বলেছেন, “অল্পবয়সি ছেলেমেয়েরা কষ্ট করে ছবিটা বানিয়েছে। তাই ছবির মুক্তি আটকে থাকা কাম্য নয়। কেউ ভাঁওতা দিয়ে ‘স্টুডেন্টস ফিল্ম’ বলে চালিয়ে দিলে অবশ্য অন্য বিষয়। আর প্রমোদ ফিল্মস তো মুম্বইয়ের। এটা নিয়ে আমার বিশেষ কিছু জানা নেই। এর ফলে বাংলা ছবির উপরে তো প্রভাব পড়ছেই। কাজ যত হবে ততই তো মঙ্গল।” বাংলা ছবি হয়েও মুম্বইয়ে কেন ছবির রেজিস্ট্রেশন হল, সেই প্রশ্ন তুলেছেন পরমব্রতও।
টলিপাড়ায় এই গুঞ্জনও ছড়িয়েছে, টাকাপয়সার বিনিময়ে বিষয়টির নিষ্পত্তির চেষ্টা হয়েছে। যদিও ফেডারেশনের সভাপতি এই অভিযোগ সম্পূর্ণ অস্বীকার করেছেন। তাঁদের দাবি, প্রমোদ ফিল্মস-এর সঙ্গে আগে আলোচনায় বসতে হবে। এই গুঞ্জন প্রসঙ্গে মুখ খুলেছেন পরমব্রতও। একসময় ফেডারেশন বনাম পরিচালক বিতর্কে তাঁর অবস্থান ফেডারেশনের বিপক্ষে ছিল। এই প্রসঙ্গে পরমব্রত বলেছেন, “অতীতে আমার সঙ্গে ফেডারেশনের যা-ই হয়ে থাকুক, আমি একটা বিষয় স্পষ্ট করে দিয়েছি। ভবিষ্যতে আবার কোনও বিষয়ে বিশদে কথা বলতে হলে, তা বৃহত্তর পরিবারের মতো নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সমাধান হবে। আইনি পথে হবে না। এক জায়গায় পড়লাম, ফেডারেশনের তরফ থেকে নাকি টাকা চাওয়া হয়েছে। আমি জোর দিয়ে বলতে পারি, কাজ না করে টাকা চাওয়ার মতো বিষয় ফেডারেশনের তরফ থেকে হতে পারে না। আমার সঙ্গে যখন মতবিরোধ চলছিল, তখনও একই কথা বলতাম। এটা অন্যায় অভিযোগ ফেডারেশনের বিরুদ্ধে।”
গিল্ডের কাউকে এই ছবিতে না নেওয়াও নাকি এই ছবির মুক্তির পথে বাধা বলে শোনা গিয়েছে। অনীক দত্ত বলেছেন, “কোনও ছবি আটকে দেওয়া উচিত নয়। সেন্সর বোর্ডের ছাড়পত্র যদি থেকে থাকে, তা হলে কোনও ভাবেই আটকানো যায় না। আর এত অনুমতি নেওয়ার বিষয় থাকলে ‘পথের পাঁচালী’-কেও তো মুক্তি দেওয়া যেত না। তাই আমার মনে হয়, সমাধান খুঁজে দ্রুত ছবিটা মুক্তি পেলেই ভাল।”
এই তরজার ফলে কষ্ট করে তৈরি করা একটি ছবি মানুষ দেখতে পাচ্ছেন না বলে আক্ষেপ করেছেন মানসী সিংহ। প্রায় একই মত প্রদীপ্ত ভট্টাচার্যেরও। সম্প্রতি তাঁর ছবি ‘নধরের ভেলা’ প্রশংসিত হয়েছে চলচ্চিত্র উৎসবে। ছাত্র বনাম ফেডারেশন বিতর্কে তিনি বলেছেন, “আমার একটাই বক্তব্য, আমি ছবিটা প্রেক্ষাগৃহে দেখতে চাই। প্রযোজক ও ফেডারেশনের বিতর্কে যাতে পরিচালক ও ছবিটার অশান্তি ভোগ না করতে হয়, সেটাই কাম্য। ‘স্টুডেন্টস ফিল্ম’ কি না, সেটা আমি জানি না। কিন্তু ছবিটা যেন শেষ পর্যন্ত মুক্তি পায়। একটা ছবি বানানো খুবই কষ্টকর। সেটা মুক্তি না পাওয়া খুবই দুঃখের।”
মানসী সিংহও ছবি দেখার আশায় বলেছেন, “একটা ভাল বাংলা ছবি ভাল ভাবে তৈরি হয়েছে। সেটা দর্শকের দেখতে পাওয়া উচিত। আমি জানি না, সমস্যা পরিচালক, প্রমোদ ফিল্মস না কি ফেডারেশন তৈরি করেছে। কিন্তু আলোচনার মাধ্যমে এই সমস্যার দ্রুত সমাধান করা উচিত। এতগুলো ছাত্রছাত্রী কষ্ট করে ছবিটা বানিয়েছে। অভিনেতারাও অনেক সময় দিয়েছেন। এমন ছবি এই ধরনের সমস্যার জন্য দর্শক দেখতে পাবে না, তা মেনে নেওয়া যায় না।”
ছবির পরিচালক ও অভিনেতারা এখনও মুক্তি নিয়ে আশাবাদী। তাঁরা অনবরত চেষ্টা করে যাচ্ছেন। তবে প্রমোদ ফিল্মস-এর তরফ থেকে এখনও কোনও কিছু স্পষ্ট করা হয়নি। তাই ফের কবে ফেডারেশনের সঙ্গে প্রযোজকেরা আলোচনায় বসবেন, তা এখনও ধোঁয়াশায়।