বাড়ি ভর্তি লোকজন। সবাই ভীষণ ব্যস্ত। বাড়ির একমাত্র মেয়ের বিয়ে বলে কথা। আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব, পাড়া-প্রতিবেশীতে মুখরিত বাড়ি। কিন্তু এই বিশাল কর্মকাণ্ড যার জন্য, সেই অরুণিমা অফিসের ঠান্ডা ঘরে বসে পরের পর প্রেজেন্টেশন তৈরিতে ব্যস্ত। মাঝে মাঝেই বাড়িতে ফোন করে প্রস্তুতির আপডেট নিচ্ছেন। বিয়ে নিয়ে কত ভাবনা ভিড় করে ওঁর মনে। সেই স্বপ্নগুলো যার সঙ্গে ভাগ করবেন, সেই সৌগত, ওঁর ভাবী স্বামী ব্যস্ত তাঁর নতুন অ্যাসাইনমেন্ট নিয়ে। অরুণিমা আর সৌগত কি জানেন ওঁরা কী মিস করছেন? বিয়ের আগের এই সময়টাই তো আপনার আগামী দিনের পথচলার প্রথম ধাপ। ভেবে দেখুন, নিজেকে গুছিয়ে নেওয়ার, এমন সুবর্ণ সুযোগ কি হেলায় হারাবেন আপনি?
ছুটি নিন
বিয়ের অনুষ্ঠান তো আর শুধুই ওই দিনটির মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। তার অনেক আগে থেকেই প্রস্তুতির মধ্য দিয়েই বিয়ের আসল আনন্দ। তাই পারলে বিয়ের কয়েকটা দিন আগে থেকেই ছুটি নিন। কেনাকাটির জন্য সময় দিন। ইদানীং কালে হবু বর-কনেরা একদিনেই বিয়ের বাজার সেরে ফেলেন। ষাটোর্ধ্ব মিলি দাস, কিছুতেই বুঝতে পারেন না, কী করে একদিনে সব কিছু করা সম্ভব। তিনি বলছেন “আমাদের সময় কত আগে থেকে কেনাকাটি, গালগল্প হত। কত খুনসুটি, লজ্জা পাওয়া, এ সব না থাকলে কি আর বিয়ে হয়?”
অভিনেত্রী চূর্ণী গঙ্গোপাধ্যায় অবশ্য সেই সময়টুকুও পাননি। “এমএ পরীক্ষা যেদিন শেষ হয়, তার পর দিন বিয়ে করেছিলাম, কেনাকাটির একদম সময় পাইনি। তবে ব্যস্ততা যতই থাক না কেন, তাই বলে কি বিয়ের উত্তেজনা থাকবে না, তা কি করে হয়?” সাহিত্যিক সুচিত্রা ভট্টাচার্য যেমন খেয়াল করেছেন, পার্লারে বসে পাত্র-পাত্রীরা নিজেদের সাজিয়ে নেওয়ার যে আপ্রাণ চেষ্টা করেন, তার মধ্যেই লুকিয়ে তাঁদের বিয়ে নিয়ে উত্তেজনা। ‘চন্দ্রবিন্দু’ ব্যান্ডের অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায় যেমন এই উত্তেজনা তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করেছেন। “আমার যে বিয়ে হবে ভাবিইনি,” স্বভাবসিদ্ধ রসিকতায় বললেন অনিন্দ্য।
মনোবিদ জয়রঞ্জন রাম বলছেন, “যেহেতু বিয়ে একটা সবর্র্জনীন ব্যাপার, আমাদের রীতিনীতি অনুযায়ী, পরিবারই বিয়ের আয়োজন করে, তাই সেই আনন্দ সকলের সঙ্গে ভাগ করে নেওয়া বাঞ্ছনীয়। বিচ্ছিন্ন থেকে লাভ নেই।”
একসঙ্গে শপিং
বিয়ের আগে হবু বর-কনেদের একসঙ্গে সময় কাটানো এবং একে অপরের মন বোঝার ভাল সুযোগ একসঙ্গে শপিং-এ যাওয়া, যা ইদানীং খুবই ইন ট্রেন্ড। একসঙ্গে শপিং করাকে সমাজতত্ত্ববিদ অভিজিত্ মিত্র দেখছেন, দায়িত্ব নেওয়ার অঙ্গীকার হিসেবে। অভিনেতা সোহম যখন বিয়ের জন্য প্রস্তুত হচ্ছেন তখন তিনি টলিউডের ব্যস্ত নায়ক। তারই মাঝে বিয়ের প্রস্তুতির জন্য সময় বের করেছিলেন। সোহম বলছেন, “একসঙ্গে শপিং করার মধ্য দিয়ে, একে অপরের টেম্পারামেন্ট সম্পর্কে ধারনা তৈরি হয়ে যায়। যা পরবর্তী জীবনের জন্য ভাল।”
পরিবারের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়া
সুজাতার বিয়ে হয়েছে, একমাস। স্বামী-স্ত্রী দুজনেই রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ককর্মী। খুব ভাল করে চেনেন একে অপরকে। তবে সুজাতার বুঝতে ভুল হয়েছিল যে বিষয়টি তা হল, বিয়ে কখনও শুধুই দুটি মানুষের মধ্যে হয় না, দুটি পরিবারের মধ্যেও হয়। খুবই চেনা ডায়লগ, কিন্তু ব্যাপারটার গুরুত্ব অনুধাবন করতে পারেননি। সুজাতা স্বাধীনচেতা মেয়ে। ওঁর যে সমস্ত কথায় বাবা-মা প্রশ্রয় দিয়েছেন, শ্বশুরবাড়িতে তা নিয়েই অপ্রীতিকর পরিস্থিতি তৈরি হয়। এ বার শিরে সংক্রান্তি। এহেন পরিস্থিতিতে দায়িত্ব বর্তায় ছেলেটির ওপর, মত মনোবিদ জয়রঞ্জন রামের। “ছেলেটিকেই মেয়েটির কথা বলার জমি প্রস্তুত করে দিতে হবে।” গায়ক অনিন্দ্য, সেই মতেই বিশ্বাসী। তাঁর পরামর্শ, “পরিবারের সকলে তো সমান হয় না, তাই দেখেশুনে ব্যাট করাই ভালো। মেয়েরা এ ব্যাপারে বরাবরই যত্নশীল হন।” কোনও দ্বিমত নেই সুচিত্রা ভট্টাচার্য এবং চূর্ণী গঙ্গোপাধ্যায়ের। “বিয়ের আগে মা বলেছিলেন, মনে রেখো পরিবারের সকলে আগে, স্বামী পরে।” কথাটির সারমর্ম বুঝেছিলেন বলেই চূর্ণী আজও তা মেনে চলেন।
বিয়ে মানে রূপকথা নয়
ছোটবেলা থেকে আমরা যত রূপকথার গল্প পড়েছি, তাতে শেষ লাইনটা কী হত মনে আছে?”... অ্যান্ড দে লিভড হ্যাপিলি এভার আফটার...।”
সত্যিই কি তাই হত?
মানে সিনড্রেলা, রাপুঞ্জেলদের সাংসারিক জীবনটাও কি রূপকথার মতোই? সেটা লেখকই জানেন। বন্ধুত্ব, প্রেম...বিয়ে। এই অবধি রূপকথার মতোই। আর তার পর? ‘...পিকচার আভি বাকি হ্যায় মেরে দোস্ত...।’ এর পর রিয়্যালিটি চেক। এত দিন আপনার বান্ধবীর শ্রেষ্ঠ চাউনিতে অভ্যস্ত ছিলেন আপনি। সেরা কবিতার লাইন আপনার প্রেমিক আপনার জন্য বেছে রাখতেন। এই সব ভারি মিষ্টি ব্যাপারস্যাপারে যখন আপনি অভ্যস্ত তখনই বিয়ে করলেন। তার পর স্বপ্নভঙ্গ হওয়াটাই স্বাভাবিক। গায়ক অনিন্দ্য বলছেন, “অসুন্দর যা কিছু তা তো আপনি লুকিয়ে রেখেছিলেন এত দিন। এ বার সবটাই বেরিয়ে পড়ল। একটু তো কষ্ট হবেই। গোপন কথাটি রইল না গোপনে। কিন্তু তাই বলে আমার সব কিছু অপরের সঙ্গে ভাগ করে নেওয়া কি চাট্টিখানি কথা?”
যেমন, সম্রাট আর জ্যোতি। সুন্দর তালমিল ছিল দুজনের, সেই কলেজের দিন থেকে। কিন্তু বিয়ের এক দুই সপ্তাহ পর থেকেই জ্যোতির নাক গলানো সম্রাটের ভাল লাগছে না। তা হলে বিয়ে করলেন কেন? বিয়ের আগেই বুঝে নিন এই সহজ তত্ত্ব, বিয়ের পর আমার স্পেস চাই মার্কা কথাবার্তা বললে চলবে না। যৌথ বাঁচার শুরুতেই কিছু সমস্যা হবে, সেটাই তো স্বাভাবিক। সমাজতত্ত্ববিদ অভিজিত্ মিত্রর কথায়, “আমি একা বলে কিছু নেই। এই ভাবনা থেকেই স্পেস চাওয়ার প্রবণতার জন্ম।” তখনই আপনার জীবনে এসে পড়ে এক মারাত্মক ক্রাইসিস। ঝগড়া, মনোমালিন্য। আপনি হয়ত ভাবতে বসলেন কী ভুল করে ফেলেছেন। ব্যাপারটা অতটাও সিরিয়াস না, বিশ্বাস করুন। “কোনও দম্পতি যদি বলেন ঝগড়া করেননি, তা হলে খুব মিথ্যে বলবেন,” বলছেন চূর্ণী। ওঁর মতে, “ঝগড়া হবেই, শুধু খেয়াল রাখতে হবে দিনের শেষটা যেন ঝগড়া দিয়ে না হয়। আর কখন সেটা করতে পারবেন? যখন স্বামী-স্ত্রী দুজনেই কিছু কিছু ছাড়তে শুরু করবেন।” সুচিত্রা ভট্টাচার্যের সহজ উত্তর,”শুরুতেই আকাশচুম্বী প্রত্যাশা না রাখা ভাল। এক্ষেত্রে ধীরে চলো নীতিই সঠিক। সময় নেওয়ার পরামর্শ মনোবিদ জয়রঞ্জন রামেরও।
ধৈর্য বাড়ান
আরে মশাই, ধৈর্যের সবচেয়ে বড় পরীক্ষা তো আপনি বিয়ের দিনই দিয়ে ফেলেন। একের পর এক আচার অনুষ্ঠান। তার পর নানা মুনির নানা মত তো আছেই। “বিয়ের দিন কিছু না কিছু গণ্ডগোল হবেই। সেটাই মজা,” বলছেন গায়ক অনিন্দ্য। দেখবেন খেয়াল করে, বিয়ের অনুষ্ঠান চলাকালীন কোনও কিছুই আর আপনার হাতে থাকে না। যে যেমন বলছেন, আপনি তাই করছেন। সাহিত্যিক সুচিত্রা ভট্টাচার্যের মতে, ব্যাপারটা অনেক সময় পুতুল খেলার মতো মনে হলেও, যেহেতু সকলে খুব আনন্দ পান, তাই মেনে নেওয়াই ভালো। এ তো গেল বিয়ের দিনের কথা। বিয়ের পরও একটা বিষয় বদলাবে না, তা হল নানা মুনির নানা মত। এই সময় আপনাকে অনেক বেশি শুনতে হবে, বলবেন কম। সহজ সমাধান মনোবিদ জয়রঞ্জন রামের। যেহেতু জীবনের শুরুর দিনগুলি খুবই সংবেদনশীল, তাই বাড়তি সতর্কতা জরুরি। রজত আর সোমার বিয়ে হয়েছে ছ’ মাস। সল্টলেকে থাকে। দ্বিরাগমনে গিয়ে, সোমার বাড়িতে রজতের কিছু আচরণের জন্য আজও রজতকে সোমার সুমিষ্ট (পড়ুন তেতো) ভাষণ শুনতে হয়। কিন্তু মানুষ মাত্রে ভুল তো হতেই পারে। সেজন্যই সমাজতত্ত্ববিদ অভিজিত্ মিত্র বলছেন, “ক্ষমা করার ক্ষমতার বড়ই প্রয়োজন। ক্ষমা করার মধ্য দিয়ে কেউ বড় ছোট হচ্ছেন না, বরং আপনাদের গ্রন্থি আরও মজবুত হচ্ছে।
শাদি কা লাড্ডু খাবেনই যখন ভেবেছেন, তখন আর ভেবে লাভ নেই। আপনি তো জেনেই গেছেন, লাড্ডু খেয়ে হজমে সমস্যা হলে কী করতে হয়। ব্যস, দুগগা দুগগা করে সেরে ফেলুন বিয়েটা। আর যদি অভয় দেন, তা হলে এই প্রতিবেদনের শেষে হাসি মুখে লিখতে পারি... অ্যান্ড দে লিভড হ্যাপিলি এভার আফটার...।
ভাল থাকবেন।