মায়ামি মডেলে রাইমা

ডিজনিল্যান্ডে ওয়ালেট হারালেন রাইমা। মায়ামি বিচে বাংলা ছবির প্রথম শ্যুটিংয়েই কি না অ্যাক্সিডেন্ট। পরমব্রত-র এক্সক্লুসিভ মায়ামি ডায়েরি১৪ মে, মায়ামি। ‘মি আমোর’য়ের শ্যুটের ষষ্ঠ দিন। সময় তখন বিকেল ৬টা। পরিচালক সুমন ঘোষের কালো গাড়িটা সমুদ্রমুখী পার্কিং লট থেকে বের করে আউটগেটে আনতেই দেখি, স্ত্রী বিধির মার্সেডিজটা ততক্ষণে সুমন নিজে গ্যারেজ থেকে বের করে ফেলেছে। পেছনের দরজাটা খুলে আমাদের মার্কিন চিত্রগ্রাহক এড টালাডেরা উঠে পড়েছেন বুট স্পেসে।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২০ মে ২০১৬ ০০:০০
Share:

ছবি: টম ডুকোউই়়ট্জ

১৪ মে, মায়ামি। ‘মি আমোর’য়ের শ্যুটের ষষ্ঠ দিন। সময় তখন বিকেল ৬টা।

Advertisement

পরিচালক সুমন ঘোষের কালো গাড়িটা সমুদ্রমুখী পার্কিং লট থেকে বের করে আউটগেটে আনতেই দেখি, স্ত্রী বিধির মার্সেডিজটা ততক্ষণে সুমন নিজে গ্যারেজ থেকে বের করে ফেলেছে। পেছনের দরজাটা খুলে আমাদের মার্কিন চিত্রগ্রাহক এড টালাডেরা উঠে পড়েছেন বুট স্পেসে। হাতের অসমো ক্যামেরা আমার গাড়ির দিকে তাক করা। এই অবধি ঠিক ছিল সব কিছু। বিপত্তি ঘটল এ অবস্থায় বিধির গাড়িটাকে এক্সিট গেট দিয়ে বের করতে গিয়ে। পেছনের গাড়ি থেকে আমি বুঝতেও পারলাম কী হতে চলেছে। কেননা রিঅ্যাক্ট করার আগেই সিনেমার নেশায় মত্ত সুমনদা গাড়িটা চালিয়ে দিল পার্কিং লটের স্বয়ংক্রিয় গেটের নীচ দিয়ে। সুমন কিংবা এড কেউই খেয়াল করলেন না যে পেছনের বুট স্পেসটা উঠে থাকার ফলে গাড়ির উচ্চতা এখন প্রায় দেড় গুণ। তাই বেরোবার সময় গেটের সঙ্গে ধাক্কা। হলও তাই। পেছনের গাড়ি থেকে দেখলাম বিধি-র মার্সেডিজের পেছনের কাচ ঝনঝন করে ভেঙে পড়ে গেল।

অল্পের জন্য আহত হওয়া থেকে বাঁচলেন এড। সিকিওরিটি ছুটে এল। সঙ্গে টিমের বাকি সদস্যেরাও। অতঃপর গাড়ি থেকে অবতরণ ঘটল সুমন ঘোষের। অর্থনীতির অধ্যাপনা কিংবা সিরিয়াস ছবিকরিয়ের আপাত গাম্ভীর্যের নীচে যে আসল শ্রীরামপুরের স্বভাব-ফাজিল সুমনকে আমরা চেনা লোকেরা দেখতে পেয়ে থাকি, সে কিন্তু সেই মুহূর্তে বেমালুম উধাও। ফ্যাকাশে মুখে বউয়ের গাড়ির ক্ষয়ক্ষতি পরীক্ষা করার সময় মনে হল যেন অকালে কালীপুজো দেখছি। জিভ এতটাই বেরিয়ে এল সুমনদার অনুশোচনার জেরে। এদিকে এডের ক্যামেরা যেহেতু চালু ছিল তাই পুরো ঘটনাটাই আমার উল্টো অ্যাঙ্গেল থেকে রেকর্ড হয়েছে ক্যামেরায়। পরে সেই দৃশ্য দেখে রাইমার কী হাসি!

Advertisement

সুমনদা অবশ্য খুব একটা হাসতে পারছিল না সেই সময়। স্বাভাবিক ভাবে এই ঘটনায় বিধি খুশি হয়নি। সুমনদা বাড়িতে ভাল ম্যানেজ দিলেও গচ্চা গেল বেশ কয়েকশো ডলার।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এই রকম একটা দুর্ঘটনার গল্প দিয়ে কেন শুরু করলাম মায়ামিতে ‘মি আমোর’? সিনেমা জগতে একটা প্রবাদ চালু আছে, শ্যুটিং চলাকালীন কোনও অ্যাক্সিডেন্ট ঘটলে, কাচ ভাঙলে, সেটা ছবির জন্য পয়া মনে করা হয়। কলকাতায় শটের সময় কাচ ভাঙলে সবাই সমস্বরে চেঁচিয়ে ওঠে— ‘ছবি হিট’। এই সংস্কার কলকাতা থেকে আমদানি করার চেষ্টা আর কি! কারণ যে ভাবনা বা যে উদ্দেশ্য নিয়ে ‘মি আমোর’ তৈরি করা হচ্ছে, সর্বোপরি যে মডেলটা ফলো করা হচ্ছে সেটা সফল হওয়া বাংলা বা বাঙালির সিনেমার ভবিষ্যতের জন্য বিশেষ প্রয়োজন। তাই একটু সংস্কারী হয়ে পড়ছি আর কি!

আমরা যদি এই নতুন মডেলটাকে মায়ামি মডেল বলে ডাকি তা হলে এই মডেলের প্রাসঙ্গিকতা কোথায়? বা এটা আসলে কী?

মায়ামি মডেলের ক্ষেত্রে প্রথমেই বলে রাখা ভাল যে, এতে অনেকগুলো ‘প্রথম’ আছে। এই প্রথম একটা ছবি আদ্যোপান্ত বিদেশে শ্যুট হচ্ছে। বাঙালিরা তৈরি করলেও ছবির ভাষা ইংরেজি। ছবির প্রযোজক ইউনিভার্সিটি অব মায়ামি। এই প্রথম তারা কোনও নন- আমেরিকান ছবির পুরোভাগে। মায়ামি মডেলে তৈরি ‘মি আমোর’ ছবির মুখ্য অভিনেতা অভিনেত্রীরা ছবির স্টেক হোল্ডার। মূলত প্রবাসী। তাই ছবিটার মধ্যে দারুণ ভাবে কলকাতার ছাপ আছে।

মায়ামির সমুদ্রে ইয়টে পরিচালক সুমন ঘোষের সঙ্গে রাইমা। ছবি: সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়

বাঙালির বুদ্ধিমত্তার ছাপ ও আছে। আর একটা ‘প্রথম’ হল, ছবিটা শুধুমাত্র অনলাইনে মুক্তি পাবে। অনেকটা নেটফ্লিক্স-য়ের মতো বংফ্লিক্স বলে এক প্ল্যাটফর্মে দর্শক এই ছবি দেখতে পাবেন। এই বংফ্লিক্সের কর্ণধার অনি শীল। তিনিও মায়ামিতেই থাকেন। অনি শীল, ইউনিভার্সিটি অব মায়ামির স্কুল অফ কমিউনিকেশনের এক গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকা সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়, অঞ্জন ঘোষাল এবং বলাই বাহুল্য পরিচালক সুমন ঘোষ—এঁরা সবাই মিলে এই পরিকল্পনা করেছেন। এই প্ল্যাটফর্মে আমাদের মতো অভিনেতারাও কোপ্রোডিউসর।

এই মডেলের দরকারটা কী? এটা পাইরেসি ঠেকানোর এক অসম্ভব ভাল উপায়। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের মানুষ নামমাত্র টাকার বিনিময়ে ছবি দেখতে পারবেন, পাইরেসির দরকার হবে না। বিভিন্ন জায়গায় যখন যাই সেখানকার বাঙালিদের কাছে অভিযোগ শুনি যে, বাংলা সিনেমার কেন কোনও অনলাইন প্রেজেন্স নেই? বংফ্লিক্সকে সফল করে তুলতে পারলে এই অভিযোগ অনেকটাই কমানো যাবে। পাইরেসি হঠিয়ে লাভ করতে পারবেন প্রযোজকরাও। সারা পৃথিবী জুড়েই শুধু সিনেমা হল থেকে টাকা রোজগারের মডেলটা উধাও হয়ে গিয়েছে। সুতরাং ইন্টারনেটের দিকে তাকাতেই হবে। সেটা নেটফ্লিক্স তো চার বছর আগে চোখে আঙুল দিয়ে করে দেখিয়েছে। সিনেমা হল নিশ্চয়ই থাকবে, কারণ ওর সঙ্গে জড়িয়ে আছে নস্টালজিয়া। ‘সিনেমাওয়ালা’তে যেটা দেখানো হয়েছে। কিন্তু ছবির রাজস্বের ক্ষেত্রে ইন্টারনেটের দিকে আমাদের তাকাতেই হবে।

এই সময় বাণিজ্যিক বাংলা ছবি বলে যে ছবিগুলোকে চালানো হচ্ছে তার বক্স অফিস কালেকশন দেখে বোঝা যাচ্ছে, এই ছবিগুলো বাংলা ছবির ভবিষ্যৎ নয়। বরং অন্য ধারার ছবির দিকে আমাদের তাকাতে হবে। এই ছবির দর্শক কিন্তু সারা বিশ্বে ছড়িয়ে আছে। আর এঁদের কাছে পৌঁছানোর জন্য বংফ্লিক্সের মতো প্ল্যাটফর্ম একান্ত দরকার।

আর একটা অ্যাক্সিডেন্টের প্রসঙ্গে আসি। আমরা অরলান্ডোতে যখন যাই, রাইমা বায়না ধরে ডিজনি ওয়ার্ল্ড যেতে হবে। আমি আবার থিম পার্ক গোছের লোক নই। তবু যেতে হল। বেরিয়ে আসার সময় গাড়ির ওপরে রাইমা ওর ওয়ালেটটা রেখেছিল। ওর ভেতর ভোটার আইডি, প্যানকার্ড— সব কিছু ছিল। আমি অনেকবার বললাম, রাইমা ওয়ালেটটা নিজের কাছে রাখ। এর পরে আমরা বাড়ি ফিরছি, পেছন থেকে দেখি একটা গাড়ি হর্ন দিচ্ছে। আমরা গাড়ি থামলে, বলল আমাদের গাড়ির ছাদ থেকে কিছু একটা উড়ে যেতে দেখেছে তারা। রাইমা বুঝতে পেরেছে যে ওটাই ওর ওয়ালেট। সেটা তখন হাইওয়ের পাশের কোনও জঙ্গলে হয়তো পড়ে আছে। রাইমা তো তখনই গাড়ি থেকে নেমে ওটা খুঁজবে। কোনও মতে থামালাম। হাইওয়েতে নামা মানে নির্ঘাৎ অ্যাক্সিডেন্ট। ফিরে গেলাম ডিজনি ওয়ার্ল্ডের পার্কিং লটে। ওয়ালেটের দেখা সেখানেও নেই। রাইমা উল্টে আমাদের ওপরই মেজাজ নিচ্ছে। পরে ওইদিনের সব অনুষ্ঠান বাতিল করতে হল। রাইমা লস্ট অ্যান্ড ফাউন্ড ডিপার্টমেন্টে গিয়ে অভিযোগ জানাল। বললে বিশ্বাস করবেন না পাঁচ মিনিটের মধ্যে পাওয়াও গেল ওয়ালেটটা।

মায়ামিতে বসে ‘মি আমোর’ নিয়ে কথা বলছি, আর আমার কো-স্টার নিয়ে আরও কিছু গল্প বলব না তাই কি হয়? কলকাতায় কৌশিকদার (গঙ্গোপাধ্যায়) সঙ্গে হোক কি মায়ামিতে সুমনদার সঙ্গে, আলোচনায় রাইমা ঠিকই উঠে আসবে। রাইমার ভক্তরা রেগে যেতে পারেন। কিন্তু কথাটা এখানে বলেই ফেলি। রাইমা প্রতিটা চরিত্র নিয়ে দারুণ তলিয়ে ভাবে এমনটা নয়। এটাই হয়তো ওকে ইন্টারেস্টিং করে তুলেছে। ও কখনই জীবনকে সিরিয়াসলি নেয় না। আমরা যারা সেটা করি তারা একটু বেশি ভেবে ফেলি। তার ফলে ইগোয়িস্টিক হয়ে পড়ি। সংকীর্ণমনা হয়ে যাই। কিন্তু রাইমা যেহেতু অন্যরকম ভাবে, তাই হয়তো ওর মতো করে জীবনটাকে দেখে। তার জন্য ওর ইগো ব্যাপারটা কম। ও অসাধারণ অভিনেত্রী এ কথা আমি বলব না, সব থেকে বড় কথা হল ও খুব ভাল মানুষ। রাইমা সেটে থাকলে খুব সুন্দর একটা পরিবেশ তৈরি হয়। যে পরিবেশে সবাই খুব রিল্যাক্সড, যা মনে আসে তা বলা যায়, টেনশন করতে হয় না। ও যে পরিবার থেকে এসেছে অনেকে ভাবতে পারেন ওর মধ্যে বোধ হয় ট্যানট্রাম আছে। সেটা কিন্তু একেবারেই নয়। এই সব কারণগুলোর জন্যই বোধ হয় রাইমা পরিচালকের কাছে এত প্রয়োজনীয়। তবে এই ছবিটা শুরুর সময় আমাকে বেশ টেনশনে ফেলেছিল রাইমা। প্রথমে এক কথায় রাজি হয়ে গেল। পরে এক দিন বলল এই মডেলে করবে কিনা ও শিওর নয়। হঠাৎ করে এক দিন বলল সাউথ বিচে লোকজন যে জামাকাপড় পরে ঘোরে সেটাতে ও স্বচ্ছন্দ নয়। সেই সময় আমাদের বেশ টেনশনে ফেলেছিল। কিন্তু মজাটা হল মায়ামিতে এসে ওর মত পুরো ঘুরে গেল। দিব্যি হেসে খেলে মজা করে শ্যুটিং এগোতে থাকল। সুমনদা মাঝে মাঝে বলে, ‘‘মেয়েটা হেবি মাই ডিয়ার মাইরি।’’ রাইমার ব্যাপারে এক কথায় বলতে গেলে সুমনদার কথাটাই বলতে হয়।

গত বছর আনন্দplusয়ের জন্য একটা লেখা লিখেছিলাম। তাতে লিখেছিলাম আমেরিকা আমার খুব একটা প্রিয় জায়গাগুলোর মধ্যে পড়ে না। ইউরোপ আমার বেশি ভাল লাগে। কিন্তু মায়ামির সঙ্গে একটা অন্য রকম সম্পর্ক তৈরি হয়েছে।

মায়ামি অন্য রকম। বেশ মায়াবী। মায়ামি আমার কাছে একটা অন্য রকম অভিজ্ঞতা হয়ে থাকল। এখানকার ওয়ার্ক কালচার, সামাজিক বিন্যাস, এখানকার লোকজন—সব মিলিয়ে খুব অন্য রকম একটা অনুভূতি দিল আমাকে।

এ বার বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের বাঙালিদের কাছে বাংলা সিনেমাকে পৌঁছে দিতে হবে। ‘কনটেন্ট ইজ কিং’—এটা ধ্রুব সত্য। তাই আমাদের কাজকে যেমন উন্নত মানের করতে হবে তেমনই সেই কনটেন্টকে লোকের কাছে পৌঁছেও দিতে হবে। সিনেমা হলকে তো বাঁচিয়ে রাখতেই হবে। সঙ্গে খুঁজে নিতে হবে সিনেমা দেখানোর নতুন পথও। বংফ্লিক্স বা মায়ামি মডেলটাকে সফল করতে হবে। সেটার জন্য সকলের সহযোগিতা কাম্য।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন