সেতারের সঙ্গে তাঁর নামটা সমার্থক। রবিশঙ্কর, বিলায়েৎ, কিংবা এনায়েৎ খানের আগের যুগের সেই সেতারি আজও সঙ্গীতের জগতে এক বিস্ময় আর কিংবদন্তি। মৃত্যুর ৯৬ বছর পরেও সেই ‘ইমদাদখানি বাজ’ যখন ঝঙ্কৃত হচ্ছে তাঁর উত্তরসূরিদের সেতারে, তখন শুধু একটি নাম হয়েই স্মৃতির অতলে রয়ে গিয়েছেন প্রবাদপ্রতিম সেতারি ইমদাদ খান। তবে শুধু সেতার নয়, তিনি ছিলেন সুদক্ষ সুরবাহার বাদকও।
ওয়ার্ল্ড মিউজিক ডে উপলক্ষে যখন দেশে-বিদেশে এত অনুষ্ঠান, এত আয়োজন তখন অনেকটাই বিস্মৃতির অন্তরালে রয়েছেন ভারতের সেই সব সঙ্গীতগুণী যাঁদের অবদান স্বরূপ সঙ্গীতের ধারাটা আজও অবিচ্ছিন্ন। ইমদাদ খান তাঁদেরই এক জন।
ইমদাদের জন্ম ১৮৪৮-এ উত্তরপ্রদেশের আগরার কাছে এটাওয়া-য়। ছোটখাটো চেহারার মানুষটির গায়ের রং ছিল মাজামাজা। মাথায় রাজপুত দোপাট্টা পাগড়ি, দাড়ি-গোঁফে ছিল সাদা, বাদামি আর খয়েরির সংমিশ্রণ। পরনে চুড়িদার, পাজামা আর আঙরাখা। তাঁর বাবা সাহাবদাদ খান ওরফে হদ্দু সিংহ ছিলেন প্রখ্যাত ধ্রুপদী তথা দিল্লি দরবারের সভাগায়ক। তিনি গ্বালিয়র ঘরানার হস্সু খান ও হদ্দু খানের শিষ্য ছিলেন। পরে তিনি ইসলামধর্ম গ্রহণ করায় তাঁর নাম পরিবর্তন হয়।
ইমদাদের সঙ্গীতের তালিম শুরু তাঁর বাবার কাছেই। এবং সেটা ছিল কণ্ঠসঙ্গীতের। পরবর্তী কালে সেতার ও সুরবাহার শিক্ষায় মনপ্রাণ নিয়োগ করেছিলেন তিনি। তালিম পেয়েছিলেন কিরানা ঘরানার বান্দেআলি খান, সেনিয়া ঘরানার সাজ্জাদ মহম্মদ খান এবং জয়পুর ঘরানার রজব আলি খানের কাছে। সেতার-সুরবাহারে কোনও বিশেষ ঘরানার তালিম না থাকলেও তাঁর সৃষ্ট ধারাই এক বিশেষ ঘরানা। গবেষকদের মতে, ‘পাঁচ বাগিচার ফুলে তিনি তাঁর সুরের ডালি ভরিয়েছিলেন।’ পণ্ডিত বিষ্ণু নারায়ণ ভাতখণ্ডে রচিত হিন্দুস্থানী সঙ্গীত পদ্ধতি (চতুর্থ খণ্ড) থেকে জানা যায় যে এক সময় ইমদাদও শৌরীন্দ্রমোহন ঠাকুরের অধীনে চাকরি করেছিলেন। সেখানেই স্বনামধন্য সাজ্জাদ মহম্মদের কাছে শিক্ষালাভ করেন।
ইমদাদের আসরের সেই সব কাহিনি আজও জলসাঘরের ইট কাঠ পাথরের আনাচেকানাচে কান পাতলে শোনা যায়। মহিষাদলের কুমার দেবপ্রসাদ গর্গের একটি লেখা থেকে জানা যায় ইমদাদ খানের আসরের বিচিত্র অভিজ্ঞতার কথা। ছেলেবেলার স্মৃতি হাতড়ে দেবপ্রসাদ লিখেছিলেন, এক সন্ধ্যার আসরে বেহাগ ধরেছিলেন ইমদাদ। কিছুক্ষণ বাজানোর পরে তাঁর মনে হয়েছিল খাঁ সাহেব যেন যন্ত্রণায় কাঁদছেন। এতটাই মর্মস্পর্শী ছিল সেই বেহাগের সুর। ‘‘আসরের মধ্যেই আমি ডুকরে কেঁদে উঠলুম,...পিতৃদেব কোনও উত্তর দিলেন না, তাঁর চোখেও তখন দেখি জল টল-টল করছে। তাড়াতাড়ি রুমালে চোখ মুছে বেচারাম খানসামাকে আদেশ করলেন আমাকে মার কাছে নিয়ে যেতে।’’ পর দিন সকালে ইমদাদ পিতৃদেবকে বলেছিলেন, ‘‘মুঝে ইস বেহাগকে লিয়ে বহুত ভারি কুরবানি দেনা পড়া।’’
এই নিয়ে শোনা যায় আর এক কাহিনি। সেই সময় ইমদাদের মেয়ে গুরুতর অসুস্থ ছিলেন। এক দিন অবস্থার আরও অবনতি ঘটলো। এ দিকে ইমদাদ রেওয়াজে মগ্ন। তাঁর স্ত্রী মেয়ের অসুস্থতার খবর জানিয়ে এক বার আসতে বললেও, ইমদাদ ডাক্তারকে খবর দিতে বলেছিলেন। যথাসময়ে ডাক্তার এলেও মেয়েটিকে বাঁচানো সম্ভব হয়নি। সেই মৃত্যু সংবাদ যখন ইমদাদের কাছে পৌঁছলো তখনও তিনি রেওয়াজ ছেড়ে ওঠেননি। বলেছিলেন লোক ডাকিয়ে মেয়ের দাফনের ব্যবস্থা করতে। মেয়ের মৃত্যুও এই সুরসাধকের রেওয়াজে বিঘ্ন ঘটাতে পারেনি। ইমদাদ ছিলেন সাধক স্বভাবের মানুষ। যখন রেওয়াজ করতেন তখন সেটাই হয়ে উঠত তাঁর ধ্যান-জ্ঞান সবকিছু।
ভারতে রেকর্ডিং-এর আদিযুগে ইমদাদ খানের সেতার বাদনের বেশ কিছু রেকর্ড করা হয়েছিল। দুর্লভ সেই সব রেকর্ড আজও খুঁজে ফেরেন সঙ্গীত রসিক থেকে রেকর্ড সংগ্রাহকরা। সেই সব রেকর্ডগুলিতে ছিল জৌনপুরি, বেহাগ, ভৈরবী, আশাবরী, দরবারী-কানাড়া, কাফি, সোহিনী ইত্যাদি রাগ। সেগুলি শুনলে অনুমান করা যায় কোন স্তরের শিল্পী ছিলেন ইমদাদ।
ইমদাদখানি ঘরানার সেতারকে বলা হয় ‘গায়কি অঙ্গ’। ঠিক কণ্ঠসঙ্গীতের মতোই এতে থাকে সুরের, তানের, নিবিড়তা এবং একাত্মতা। আবার ইমদাদ খান সেতারের আলাপে খেয়াল গায়কির বেশ কিছু বিষয়বস্তু প্রয়োগ করেছিলেন। তার ফলে তার সৃষ্ট ঘরানার সুরে মাদকতার পাশাপশি অলঙ্করণও ছিল বিশেষ আকর্ষণীয়। খুব অল্প বয়স থেকেই ইমদাদ তাঁর পুত্রদের একটানা বারো ঘণ্টা রেওয়াজ করাতেন। ইমদাদ ছিলেন তবলিয়াদের যম। আর যাঁরা সঙ্গত করতেন তাঁরা বড়জোর ঠেকা দিতেন।
ইমদাদ খান জীবনের শেষ বয়স ইনদওর দরবারে কাটালেও জীবনের প্রায় ২০ বছর কলকাতায় কাটিয়েছিলেন। মেটিয়াবুরুজে অবস্থিত লখনউয়ের নির্বাসিত নবাব ওয়াজিদ আলি শাহের দরবারে, পাথুরিয়াঘাটার মহারাজ যতীন্দ্রমোহন ঠাকুরের সভায় এবং শেষ জীবনে ইনদওরের হোলকরদের সভাশিল্পী হিসেবে নিযুক্ত ছিলেন। ক্রমেই এই ঘরানা এটাওয়া থেকে কলকাতা হয়ে ইনদওর এবং হায়দরাবাদে ছড়িয়ে পড়েছিল।
১৯২০ সালে, ৭২ বছর বয়সে ইমদাদ খানের মৃত্যু হয়। তাঁর সৃষ্ট ‘ইমদাদখানি বাজ’-এর ঐতিহ্যবাহী ধারাটা এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন তাঁর সুযোগ্য পুত্র তথা আরও এক প্রবাদপ্রতিম ওস্তাদ এনায়েৎ খান ও ওয়াজিদ খান। এবং পরবর্তী কালে তাঁর নাতি ওস্তাদ বিলায়েৎ খান এবং ওস্তাদ ইমরাত খান। এখনও থেমে নেই সেই ধারা। তাঁদেরই উত্তরসূরিদের সেতারে বেঁচে আছে সেই অদ্বিতীয় ‘বাজ’।
আরও খবর...