‘ছুপা’ রুস্তম

মুম্বই পুলিশের ক্রাইম ব্রাঞ্চে হঠাৎ হাজির অক্ষয়কুমার। সামনে শীর্ষ পুলিশ কর্তা। লিখছেন সায়ন আচার্য“আই হ্যাভ শট আ ম্যান, মিস্টার লোবো। হি ইজ ডেড…” কথাগুলো বলেই চেয়ারের ও প্রান্তের ভদ্রলোকের দিকে একবার তাকালেন অক্ষয়কুমার।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৫ অগস্ট ২০১৬ ০০:০০
Share:

“আই হ্যাভ শট আ ম্যান, মিস্টার লোবো। হি ইজ ডেড…”

Advertisement

কথাগুলো বলেই চেয়ারের ও প্রান্তের ভদ্রলোকের দিকে একবার তাকালেন অক্ষয়কুমার।

চেয়ারের উল্টো দিকে মুম্বই পুলিশের ডেপুটি কমিশনার। নাম, জন লোবো।

Advertisement

লোকেশন—মুম্বই পুলিশের ক্রাইম ব্রা়ঞ্চ। পাশের ক্রফোর্ড মার্কেট থেকে ভেসে আসছে নানা শব্দ। অক্ষয় চুপচাপ। একটু আগেই সার্ভিস রিভলভারের গুলিতে ঝাঁজরা করেছেন এক সময়ের ঘনিষ্ঠ বন্ধু প্রেম আহুজাকে। বলিউড সুপারস্টারের চোখ মুখ থমথমে। পরনে ভারতীয় নৌ-বাহিনীর ইউনিফর্ম, উস্কো-খুস্কো চুল। “খুনটা করলেন কেন?” প্রশ্ন লোবোর।

“প্রেম আমার স্ত্রীর সঙ্গে প্রতারণা করেছিল। এত দিন সম্পর্ক রাখার পর বলেছিল যে আমি ডিভোর্স দিলেও ওকে বিয়ে করবে না। হাউ কুড হি ডু দ্যাট?” কঠিন দৃষ্টিতে বললেন অক্ষয়।

…ক্রাইম ব্রাঞ্চে যিনি লোবোর মুখোমুখি, বাস্তবে তাঁর নাম অক্ষয়কুমার নয়, কাওয়াস মানেকশাহ নানাবতী। ভারতীয় নৌ বাহিনীর কমান্ডার। আর সালটাও ২০১৬ নয়, ১৯৫৯!

১২ অগস্ট, বড় পর্দায় এই নানাবতীর গল্প বলতেই ‘রুস্তম’ নিয়ে হাজির হচ্ছেন অক্ষয়কুমার। ছবিতে এক নৌ-সেনা অফিসারের কথা বলছেন অক্ষয়, যাঁর সমর্থনে এক সময় পথে নেমেছিল গোটা দেশ।

এত বছর পর, বলিউড যখন আবার পর্দায় আনছে প্রয়াত এই অফিসারকে, মুম্বইয়ের বান্দ্রার ফ্ল্যাটে বাস্তবের মানেকশাহ-র স্মৃতি আঁকড়ে বসে আছেন ৯৫ বছরের বৃদ্ধ—জন লোবো!

ওই কেসের মুখ্য চরিত্র নানাবতী এখন বেঁচে নেই। ২০০৩য়ে কানাডায় মৃত্যু হয় তাঁর। তবু আজও ওই ঘটনা নিয়ে কৌতূহল কমেনি। ‘‘এখনও যেন স্মৃতিগুলো টাটকা। বিধ্বস্ত অবস্থায় আমার কাছে এলেন নানাবতী সাহেব, মুখ চোখ থমথমে। এসেই বললেন আত্মসমর্পণ করতে চান,’’ মুম্বই থেকে আনন্দplusকে বলছিলেন লোবো।

দিনটা স্পষ্ট মনে আছে। ১৯৫৯-এর ২৭ এপ্রিল। নিজের অফিসে বসে কাজ করছেন, নৌ-বাহিনীর আরেক অফিসার কমান্ডার স্যামুয়েলের ফোন। ‘‘স্যামুয়েল বললেন কোনও এক নানাবতী আসছেন আমার কাছে। একটু আগেই তিনি নাকি শহরের এক শিল্পপতি প্রেম আহুজাকে গুলি করেছেন। এখন আত্মসমর্পণ করতে চান। তবে, আমার জীবনে নানাবতীর মতো মানুষ খুব বেশি দেখিনি,’’ বলছিলেন লোবো।

মুম্বইতে থাকলেও তিনি জানতেন না যে সাতান্ন বছরের পুরোনো সেই কেস নিয়ে আবার সিনেমা বানাচ্ছে বলিউড। আনন্দplusয়ের কাছ থেকে শুনে অবশ্য কাস্টিং নিয়ে কিছুটা সন্দিহান। “অক্ষয় ভাল অভিনেতা, কিন্তু নানাবতীর চরিত্রে কতটা সাবলীল হবেন, তা নিয়ে আমি নিশ্চিত নই,” বলছিলেন লোবো।

অবশ্য শুধু তিনি নন, কলকাতার এক প্রাক্তন নৌ-সেনা অফিসারেরও একই মত। “ওই ব্যক্তিত্ব সিনেমায় তুলে ধরা কঠিন,” বলছিলেন প্রাক্তন ওই অফিসার।

এর আগেও নানাবতীর জীবন নিয়ে ছবি হয়েছে বলিউডে। ১৯৬৩তে সুনীল দত্ত-লীলা নায়ডুকে নিয়ে তৈরি হয় ‘ইয়ে রস্তেঁ হ্যায় প্যার কে’। বছর দশেক পর, ১৯৭৩-এ বিনোদ খন্নাকে নিয়ে ‘অচানক’ তৈরি করেন গুলজার। স্ত্রী সিলভিয়ার চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন লিলি চক্রবর্তী।

নৌ-বাহিনীতে নানাবতী জনপ্রিয় ছিলেন তাঁর মার্জিত ব্যবহারের জন্য। তিনি তখন আই এন এস মাইসোরের উচ্চপদে কর্মরত। বাড়িতে ইংরেজ স্ত্রী সিলভিয়া, তিন ছেলে-মেয়ে, তবে কর্মসূত্রে তাঁর অধিকাংশ দিনই কাটে মাঝসমুদ্রে। এরই ফাঁকে প্রেম-এর প্রেমে পড়েন সিলভিয়া, হঠাৎ বদলে যায় নানাবতীর পৃথিবী!

রাকেশ মারিয়া (প্রাক্তন পুলিশ কমিশনার, মুম্বই)

একাধিক মহিলার সঙ্গে সম্পর্ক ছিল শিল্পপতি প্রেম আহুজার। ‘‘নানাবতীর স্ত্রী অত্যন্ত সুন্দরী ছিলেন। জাহাজেই স্ত্রীর সম্পর্কের কথা জানতে পারেন। শহরে ফিরে জানতে চান স্ত্রীর কাছে। স্বীকার করেন সিলভিয়া। মানতে পারেননি নানাবতী...,’’ ফোনের ওপ্রান্তে কিছুটা নস্টালজিক লোবো, যিনি পরবর্তী কালে সিবিআই ডিরেক্টর নিযুক্ত হন।

‘‘প্রথমে স্ত্রীর সঙ্গে কথা বলতেন না। জেলে থাকাকালীন রোজ আসতেন সিলভিয়া। নানাবতী শুধু একদৃষ্টে তার দিকে তাকিয়ে থাকতেন,’’ বলছিলেন লোবো। অক্ষয়ের ‘রুস্তম’য়ে এই প্রেম-এর চরিত্রে হাজির হচ্ছেন অর্জন বাজওয়া। আর সিলভিয়া—ইলিয়ানা ডি ক্রুজ। “কাউকে খুন করার পরেও ওই রকম জনসমর্থন, ভাবা যায় না! বোম্বে হাইকোর্টে শুনানি চলছে, আর বাইরে শ’য়ে শ’য়ে লোক জড়ো হয়েছে একবার নানাবতীকে দেখবে বলে,” বলছিলেন লোবো। কখনও স্লোগান দিচ্ছে জনতা। কখনও সংবাদপত্রে নানাবতীর মুক্তির দাবি উঠছে। ‘‘যখন মুক্তি পেলেন, সে দিন ওঁকে বাড়ি নিয়ে যেতে হাজির হয়েছিল কয়েক হাজার মানুষ,’’ একটু থেমে বললেন লোবো।

জন লোবো (প্রাক্তন ডেপুটি কমিশনার, মুম্বই পুলিশ)

প্রাথমিক ভাবে মুক্তি দিলেও মুম্বই হাইকোর্ট নানাবতীর যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের নির্দেশ দেয়। তবে, শাস্তি মকুব করেন মহারাষ্ট্রের তৎকালীন রাজ্যপাল বিজয়লক্ষ্মী পণ্ডিত। ওই রায়ের পরই দেশজুড়ে বন্ধ হয়ে যায় জুরি প্রথা। এবং মাসকয়েক বাদে, পরিবার নিয়ে কানাডা পাড়ি জমান নানাবতী। ‘রুস্তম’য়ে অক্ষয়ের ভুল ইউনিফর্ম নিয়ে ইতিমধ্যেই হয়েছে বিতর্ক, তবুও লোবো বা কলকাতার প্রাক্তন নৌ-সেনা অফিসার, স্মৃতির সরণিতে খুঁজছেন এক দাপুটে কমান্ডারকে, কিন্তু সামনে যিনি হাজির হচ্ছেন তাঁর নাম—অক্ষয়কুমার!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন