Home Delivery

নেশা নাটকে অভিনয়, পেশা খাবারের হোম ডেলিভারি, গতির দৌড়ে প্রথা ভাঙছেন সঙ্গীতা

‘শিক্ষিত মেয়ে রাতের বেলা অন্য লোকের বাড়ি খাবার পৌঁছে দিতে যান’! এমন কথাও শুনতে হয়।

Advertisement

স্রবন্তী বন্দ্যোপাধ্যায়

কলকাতা শেষ আপডেট: ০২ জুন ২০২১ ১২:১৬
Share:

পেশা খাবারের হোম ডেলিভারি, গতির দৌড়ে প্রথা ভাঙছেন সঙ্গীতা

শিক্ষিত মেয়ে রাতের বেলা অন্য লোকের বাড়ি খাবার পৌঁছে দিতে যান! এটাই তাঁর পেশা।

Advertisement

এ-ও কখনও হয়!

হয়। হচ্ছে। এই শহরে। উত্তর ২৪ পরগনার বেলঘরিয়ায়। রবীন্দ্রভারতীর নাট্য বিভাগের স্নাতকোত্তরের ছাত্রী সঙ্গীতা সেই কাজই করছেন। যাঁকে প্রত্যহ শুনতে হয়, “এই নাটক-ফাটক করে মাথাটা একেবারেই গিয়েছে! পরিবারে তো কোনও অভাব নেই। তা-ও কেন রাস্তায় নেমে বাড়ি বাড়ি খাবার দিয়ে আসার কাজ করতে হচ্ছে!” সঙ্গীতা জবাব দেন, ‘‘আমি থিয়েটার থেকে নৈতিক শিক্ষা পেয়েছি। সেই শিক্ষা আমায় বলে, লোক না ঠকিয়ে যে পেশায় অর্থ উপার্জন করা যায় সেটাই সম্মানের। আমরা খাবার দিয়ে আসি। টেবিলের তলায় টাকা দিয়ে আসি না।’’

Advertisement

ছোট থেকেই বিকল্পের খোঁজে তিনি। পুতুল খেলা নয়। বাবার হাত ধরে খেলার মাঠে গিয়ে একটানা দৌড়ে যেতেন। থামতে একটুও ভাল লাগত না। শুধু দৌড় আর দৌড়। এখন ওই খেলার মাঠটাই বড় হয়ে গিয়েছে সঙ্গীতার জীবনে। এক দিকে নাটক নিয়ে পড়াশোনা। অন্য দিকে অনলাইন খাদ্য সরবরাহকারী সংস্থার হয়ে বাড়ি বাড়ি খাবার পৌঁছে দেওয়া। গতিহীন লকডাউনে তাঁর গতিময় জীবন। গতির সঙ্গে প্রথাও ভাঙছেন তিনি। নিয়ম চুরমার করে প্রবল ভাবে বেঁচে আছেন সঙ্গীতা। সঙ্গীতা। ঠিকই পড়লেন। শুধুই সঙ্গীতা। কোনও পদবি নেই। কারণ, ব্যবহার তাঁর পছন্দ নয়। বেড়াতে যাওয়ার সময়েও যেমন কোনও সঙ্গী পছন্দ নয়। আনন্দবাজার ডিজিটালকে তিনি বলছিলেন, “একা ঘুরতে যাব। অপেক্ষায় আছি।” আশুতোষ কলেজে ইংরেজি নিয়ে পড়তে পড়তে মাঝপথে ছেড়ে দিয়েছিলেন। কারণ, “একদম ভাল লাগত না। বাবার জন্য ভর্তি হয়েছিলাম। তার পর সোজা রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্য বিভাগে যোগ দিই। কী মজা লাগত। জীবনে যা করছি পড়ছিও তাই। মঞ্চ নিয়ে কথা। আলো নিয়ে গল্প।”

বাবা পুলিশকর্মী। যৌথ পরিবারে অধিকাংশই সরকারি চাকুরিজীবী। সঙ্গীতা তো সে দিকে গেলেনই না। উল্টে বুঝিয়ে দিলেন, তিনি নাটক নিয়ে থাকবেন। সে যত অনিশ্চয়তাই থাকুক নাট্য জগতে। নাটক না হয় হল। তা বলে বাড়ি বাড়ি গিয়ে খাবারের হোম ডেলিভারি? অতিমারির সময় ক্লাস বন্ধ। বাড়িতে চুপ করে বসে থাকতে পারছিলেন না সঙ্গীতা। দমবন্ধ হয়ে আসছিল। নামছিল হতাশার মেঘ। খুঁজতে খুঁজতে সেই খেলার মাঠে পৌঁছে গেলেন তিনি। এ খেলা অন্যরকম। অনলাইনে খাদ্য সরবরাহকারী সংস্থার কর্মী হিসেবে বাড়ি বাড়ি খাবার পৌঁছে দিতে লাগলেন সঙ্গীতা। বলছিলেন, ‘‘বাবা-মা আপত্তি করবেন এমন পরিস্থিতি তৈরি হতে দিইনি। পরিবারের সকলে প্রথমে আপত্তি জানালেও শেষে আমার কাজকে সমর্থনই করেছিলেন।’’

যৌথ পরিবার তাঁদের। কন্যাসন্তানই বেশি। একটাই ভাই। ফলে বাড়িতে ছোটবেলায় কোনও দিন ছেলে-মেয়ে ভাগাভাগি দেখেননি তিনি। ছেলে বলে এই পোশাক, মেয়ে বলে অন্য রকম পোশাক বা ছেলে-মেয়েরা একই কাজ করতে পারে না, এমন কথাও শোনেননি। স্কুটি চালিয়ে বাড়ি বাড়ি খাবার পৌঁছে দেওয়ার পেশায় থাকলেও সঙ্গীতা স্বপ্ন দেখেন মোটরবাইক নিয়ে পাহাড়ে যাওয়ার। সঙ্গীতার পারিবারিক শিক্ষাই তাঁকে জীবনকে অন্য রকম ভাবে ভাবতে শিখিয়েছে। কিন্তু আত্মীয়স্বজন বা পরিচিতদের থেকে ছাড় পাননি। নানা কথা ভেসে এসেছে। কেউ বলেছেন, “ওসব ছেলেদের কাজ!’’ কেউ বলেছেন, ‘‘এসব কাজ মেয়েরা করে নাকি!’’ আবার অনেকে বলেছেন, ‘‘শিক্ষিত মেয়েরা এই কাজ কখনও করে না!’’ তবে ও সব ‘একঘেয়ে’ বক্তব্যে সঙ্গীতা অভ্যস্ত। তাঁর কথায়, “এই ধরনের মতামত দেওয়ার মানুষ সংখ্যায় অনেক বেশি। এরা আদ্যিকালের ধারণাই গেয়ে যাবে। আমি এ সব শুনলে মজাই পাই।” বস্তুত, ওই মানুষগুলোর বক্তব্য নিমেষে হারিয়ে যায় যখন হোম ডেলিভারি করতে গিয়ে বাড়ানো হাতের সঙ্গে চোখে প্রাপ্তির ঝিলিক দেখতে পান। খানিকটা উত্তেজিতই শোনায় তাঁকে, যখন বলেন, “এক বৃদ্ধ দম্পতির কাছে যখন খাবারের প্যাকেট নিয়ে হাজির হই, তখন তাঁদের আশ্চর্য চোখগুলো আমাকে কাজটা করার অনুপ্রেরণা দেয়। ওই রাতে ওই দম্পতির কাছে আমি যেন তাঁদেরই দূরে-থাকা পুত্র বা কন্যা হয়ে যাই।”

বেশিরভাগ সময়েই রাতে কাজ করতে হয় সঙ্গীতাকে। কোনও পরিবারের সদস্যরা অবাক হন। কেউ বলেন, “এই কাজ মেয়েরাও করছে! চমৎকার।” সঙ্গীতার মনে আছে দশম শ্রেণির এক ছাত্রী তাঁকে বলেছিল, “ধন্যবাদ দিদিভাই। এই সময়েও তুমি আমার জন্য খাবার নিয়ে এলে।” সঙ্গীতা মনে করেন, চিকিৎসক-পুলিশ যে ভাবে এই অতিমারির সময় কাজ করছে, বাড়ি বাড়ি খাবার পৌঁছে দেওয়া মানুষেরাও তেমনই ঝুঁকি নিয়ে কাজ করছেন। বলেন, “আমি এই পেশায় যুক্ত সকলকে কুর্নিশ জানাই!” অনলাইনে খাদ্য সরবরাহকারী সংস্থার কাছ থেকে পাওয়া প্রথম উপার্জনের টাকা এক বন্ধুর হাতে দিয়ে দিয়েছিলেন। কারণ, শুনেছিলেন বন্ধু এবং তাঁর পরিবার লকডাউনে একেবারে নিঃস্ব হয়ে গিয়েছে। সেই পরিবার নির্ভরশীল ছিলসেন নাটকের উপর। উত্তেজিত সঙ্গীতা বলছিলেন, “অতিমারির জন্য যেমন মানুষ সব হারাতে বসেছে, তেমনই লকডাউনের জন্যও মানুষ উপার্জন হারাচ্ছে। এ তো জলে কুমির ডাঙায় বাঘ! আমরা থিয়েটারের বন্ধুরা একজোট হয়ে একটা তহবিল তৈরি করেছি। থিয়েটারের সঙ্গে যুক্ত কর্মীদের পাশে দাঁড়াব।”

একটা সময়ে নিয়মিত বহুরূপীতে নাট্যচর্চা করতেন। এখন হোম ডেলিভারির কাজ করতে গিয়ে মনে হয়, নাটকের জগতেই আছেন। প্রতিদিন শেখেন। বলেন, ‘‘যে মানুষগুলোর কাছে খাবার পৌঁছে দিই, দেখতে পাই তাঁদের চোখগুলো আনন্দে চকচক করে উঠছে। একটু আগেই হয়ত তাঁরা ওই খাবারের ছবিটা দেখেছেন। সেটা হাতে পেয়ে তাঁদের অনুভূতিটা লক্ষ্য করি। করতেই থাকি। কারণ, আমার নাটক শিখিয়েছে অন্য মানুষকে লক্ষ্য করা মঞ্চের অভিনেতার প্রথম কাজ।’’ জনান, যাঁরা তাঁকে টিপ্পনি করেন, তাঁরা বুঝতেই পারেন না, প্রথম যে দিন একটি মেয়েকে সাইকেলে চেপে খাবার দিতে দেখেছিলেন বা এক দম্পতিকে অর্থের জন্য অনলাইন খাদ্য সরবরাহকারী সংস্থায় কাজ করতে দেখেছিলেন, সেদিনও সঙ্গীতার মধ্যে তাঁর নাটক-সঞ্জাত পর্যবেক্ষণের অভ্যাস কাজ করেছিল। আত্মবিশ্বাসী মেয়ে বলছিলেন, “এই কাজটা এক দিকে যেমন অন্যকে সাহায্য করার অস্ত্র হিসেবে আমার সামনে এসেছে, তেমনই এত মানুষকে দেখতে দেখতে ক্রমাগত নাটকের পর্যবেক্ষণের কাজটা করারও সুযোগ দিয়েছে। মজাই লাগে আমার।”

নজরুলের কবিতার বই আর উত্তম-সুচিত্রার সাদা-কালো রোমাঞ্চের মাঝে সঙ্গীতা অপেক্ষা করেন সেই দিনের, যে দিন মানুষ হইহই করে টিকিট কেটে নাটক দেখতে আসবেন। আলোয় ভরে যাবে মঞ্চ। শোনা যাবে মানুষের করতালির উচ্ছ্বাস। ততদিন এবং তার পরেও চলতেই থাকবে সঙ্গীতার প্রথা-ভাঙা দৌড়।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন