লেক গার্ডেন্স-গল্ফগার্ডেন-আনোয়ার শাহ রোডের পাকা ঠিকানা বদলে এবার লক্ষ্য মুম্বই।
এই মুহূর্তে টলিউডের শিল্পী-কলাকুশলীদের মনে ধাক্কা দিচ্ছে আরব সাগরের ঢেউ।
আর সেই ঢেউয়ের দোলায় সওয়ার হয়ে বঙ্গসন্তানেরা পাড়ি দিচ্ছেন পশ্চিমে। দক্ষিণ কলকাতার মায়া কাটিয়ে তাঁরা এখন কেউ আড্ডা মারছেন লোখন্ডওয়ালার কফি শপে, কেউ বা ঘরবাড়ি সাজিয়ে বসত শুরু করেছেন আন্ধেরি ওয়েস্টের সাত বাংলোয়। কলকাতার ঠিকানা বদলে মুম্বইয়ে পাড়ি দিয়েছেন পরিচালক সৃজিত মুখোপাধ্যায়, অনিরুদ্ধ রায় চৌধুরী, সুমন মুখোপাধ্যায়, স্বস্তিকা মুখোপাধ্যায় এবং আরও অনেকে।
কেন?
বড় ক্যানভাস
একেকটা সময় আসে যখন শিল্পীরা একই রকম ভাবে ভাবতে থাকেন তাঁদের সৃষ্টি নিয়ে। এটাও তেমনই এক সময়। পরিচালক সুজিত সরকার যেমন বলছিলেন, ‘‘এর আগেও বহু বাঙালি কলকাতা ছেড়ে
মুম্বই গিয়েছেন। বিমল রায়-সলিল চৌধুরী-হেমন্ত মুখোপাধ্যায়-শচীন দেব বর্মন-মান্না দে... কত বাঙালিই তো বলিউডে এসে চূড়ান্ত সফল হয়েছেন। আবারও সেই রকম একটা ঝোঁক দেখা দিচ্ছে।’’ সুজিত এবং রণি লাহিড়ির প্রযোজনায় হিন্দি ছবি ‘পিঙ্ক’ করলেন পরিচালক অনিরুদ্ধ রায় চৌধুরী।
‘অনুরনণ’, ‘অন্তহীন’ থেকে ‘বুনো হাঁস’ — এত সব ছবির পর বলিউডে কেন পাড়ি দিলেন? ‘‘না, পাকাপাকি মুম্বই থাকার কোনও প্ল্যান নেই। যখন ‘পিঙ্ক’য়ের গল্পটা সুজিতকে শোনালাম, ও বলল ছবিটা হিন্দিতে করো। আমার মনে হল ছবি নিয়ে একটা এক্সপেরিমেন্ট করা যাক তা হলে। হিন্দি ছবিতে কাজ করা মানে ক্যানভাসটা বড় হয়ে যাওয়া। সেই সঙ্গে অমিতাভ বচ্চনকেও পেলাম আমার ছবিতে, এর পর কেউ ছাড়ে?’’ বলছিলেন অনিরুদ্ধ।
একা তবু একা নয়
শান্তনু মৈত্র, অনুরাগ বসু, সিনেমাটোগ্রাফার সুদীপ চট্টোপাধ্যায় — সকলেই অনিরুদ্ধর মুম্বইয়ের বন্ধু। ভাল আড্ডাও জমে। তবে সৃজিত মুখোপাধ্যায়ের অবস্থাটা ঠিক তেমন নয়। খুব বেশি বন্ধু নেই মুম্বইতে। কলকাতায় যাঁর চারপাশে সর্বদা দেখা যেত নায়িকাদের, তিনি বোম্বেতে একা? বললেন, ‘‘এই মুহূর্তে কার্টার রোডের বাড়িতে আমি বেশ একাই। কিন্তু আমার বন্ধু এখন সমুদ্র। সমুদ্রর কত রূপ। তাই দেখেই সময় কাটছে।’’ দাবি করলেন, বান্ধবী-টান্ধবী এখনও মুম্বইতে হয়নি।
সৃজিতের মুম্বই অভিযানের কারণ একটাই। তিনি চান বেশি দর্শকের কাছে ছবির গল্প বলতে। বললেন, ‘‘বেঙ্গালুরুতে নাটক করা ছেড়ে কলকাতায় এসে বাংলা ছবি করেছিলাম বেশি সংখ্যক দর্শককে গল্প বলব বলে। আবার কলকাতা ছেড়ে মুম্বই এলাম আরও বেশি সংখ্যক দর্শককে গল্প বলতে। এখানে এসে নতুন শিল্পী, নতুন কলাকুশলীদের সঙ্গে পরিচয় হচ্ছে, এটা আমার ভাল লাগছে।’’
মহেশ ভট্টের বিশেষ ফিল্মস প্রোডাকশনের হয়ে জুন মাস থেকে সৃজিত শুরু করছেন তাঁর ছবি ‘বেগমজান।’
ফিরে তাকাব না
সৃজিত যখন বেঙ্গালুরু ছেড়ে কলকাতায় এলেন, সঙ্গে এনেছিলেন অনুপম রায়কে। বেঙ্গালুরু ছেড়ে কলকাতায় চলে আসা অনুপম কি ‘পিকু’র সাফল্যের পর মুম্বইয়ের বোর্ডিং পাস নেওয়ার কথা ভাবছেন? অনুপম পরিষ্কারই বলছেন, কাজের সুযোগ বেশি পেলে মুম্বই চলে যাবেন। পিছন ফিরে তাকাবার কোনও ব্যাপারই নেই। বাংলায় লাইভ শো থাকলে মুম্বই থেকে এসে করে যাবেন।
বলিউডে জায়গা করার কথা ভাবছেন সঙ্গীত পরিচালক ইন্দ্রদীপ দাশগুপ্তও। কেন?
তিনি তো এই মুহূর্তে বাংলা ছবির অত্যন্ত সফল সঙ্গীত পরিচালক। ইন্দ্রদীপ বললেন, ‘‘কলকাতা আমাকে যতটা স্বীকৃতি দিয়েছে, তার চেয়ে বেশি স্বীকৃতি তো আর দিতে পারবে না। সব শহরেরই একটা স্যাচুরেশন পয়েন্ট আছে। কলকাতারও সেটা আছে। এর পর নতুন কিছু করতে চাইলে শহর বদল করতেই হবে। সেই জন্যই মুম্বই যাচ্ছি।’’ কিন্তু সেখানে তো অনেক প্রতিযোগিতা। যদি সফল হওয়া কঠিন হয়ে দাঁড়ায়? ‘‘আমি এই সব নেগেটিভ চিন্তা করতে চাই না,’’ বলছেন ইন্দ্রদীপ।
ভোজনরসিক ইন্দ্রদীপের লেক গার্ডেন্সের বাড়িতে যে খানাপিনার আড্ডা হয়, সেটা তো মুম্বইতে গিয়ে হবে না? ‘‘ আমার ওই শহরেও নতুন বন্ধু হবে। আবারও আড্ডা বসবে। খানাপিনা হবে। এই আশা রাখি,’’ বলছেন ইন্দ্রদীপ।
পরিচালক কিউ জানালেন তিনিও একটি হিন্দি ছবি করছেন। অনুরাগ কাশ্যপ পরিচালিত ফ্যান্টম ফিল্মসের সঙ্গে যুগ্ম প্রযোজনায় এই হিন্দি ছবির শ্যুটিং হচ্ছে দেশ বিদেশের নানা জায়গায়। কিউও কি তা হলে লেক গার্ডেন্সের বাড়ি ছেড়ে মুম্বইবাসী হতে চলেছেন? উত্তরে বললেন, ‘‘কাজের সুবাদে নানা জায়গায় ঘুরে বেড়াই। যেমন কাজ আসবে তেমন সিদ্ধান্ত নেব। এখনও পর্যন্ত কলকাতাই আমার বেস। পরে কী হবে জানি না।’’
মুম্বইয়ে না গেলেও বলিউড থেকেই শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় ও নন্দিতা রায়ের ছবি ‘বেলাশেষে’ এবং ‘প্রাক্তন’ ছবির বিশ্বজোড়া পরিবেশনা করছে ইরোস ইন্টারন্যাশনাল। ছবির বিপণন ও পরিবেশনার জন্য প্রায়ই মুম্বই যেতে হয় শিবপ্রসাদকে। অদূর ভবিষ্যতে হিন্দি ছবিও করবেন এমনটাও জানালেন। ‘‘কিন্তু হিন্দি ছবি করলেও আমরা কলকাতা থেকেই করব। এ শহর ছেড়ে যাচ্ছি না,’’ বলছেন শিবপ্রসাদ।
ওখানে সুস্থ প্রতিযোগিতা আছে
গত বছর মুম্বই শহরে পাকাপাকি বসবাস করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন নাটক ও সিনেমা পরিচালক সুমন মুখোপাধ্যায়। মুম্বইতে আন্ধেরি ওয়েস্টের সাত বাংলোয় সংসার সাজিয়ে তোলা সুমন বলছেন, ‘‘শুধু যে রাজনৈতিক কারণে আমি মুম্বই চলে আসি তা নয়। কলকাতায় নাটক বা সিনেমা করতে গেলে অনেক সমস্যা। পশ্চিমবঙ্গ বা কলকাতায় সাংস্কৃতিক জগতের এক ধরনের একাধিপত্য আছে। তার সঙ্গে রাজনৈতিক দলের সরাসরি যোগাযোগ আছে। কলকাতায় থাকতে হলে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের অনুগামী হতে হবে।’’
মুম্বইয়ে এখন থিয়েটারকে ফিল্মে শ্যুট করার কাজে ব্যস্ত সুমন। উষা গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘রুদালি’, ডলজ হাউজের হিন্দি ভার্সান ‘গুড়িয়া ঘর’য়ের ফিল্ম শ্যুট হয়ে গিয়েছে। ‘‘বিরাট বড় প্রোজেক্টের কাজ এটা। আর্থিক দিকটাও ভাল। এ ছাড়া সিনেমা বানানোর অফারও পাচ্ছি।’’ কলকাতায় কাজ করার সময় যে সমস্যাগুলো হচ্ছিল, সেই সমস্যা কি মুম্বইতে নেই? সুমন বলছেন, ‘‘বলিউডে একাধিক ক্যাম্প আছে ঠিকই। কিন্তু সেখানে সংকীর্ণতা নেই।’’
সুমন মুখোপাধ্যায় মুম্বই যাওয়ার পর স্বস্তিকা মুখোপাধ্যায়ও মুম্বই পাড়ি দিয়েছেন। তিনি ‘ডিটেকটিভ ব্যোমকেশ বক্সী’র পর আর কোনও হিন্দি ছবি না করলেও নাটকে অভিনয় করছেন। এবং সেই নাটক থেকে ছবিও শ্যুট করা হচ্ছে। তবে স্বস্তিকাই যে হাল আমলের প্রথম নায়িকা মুম্বই গেলেন এমন নয়। তাঁর আগে ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত এবং পাওলিও বলিউডে গেছেন। কিন্তু পাকাপাকি ভাবে থাকেননি। কলকাতায় ফিরে এসেছেন।
বাঙালি চরিত্রাভিনেতাদের কদর দিনকে দিন বাড়ছে বলিউডে। অপরাজিতা আঢ্য যশরাজ ফিল্মসের ‘মেরি পেয়ারি বিন্দু’ ছবিতে অভিনয় করতে চলেছেন। এই ছবির শ্যুটিং কলকাতায় শুরু হবে আগামী কাল থেকে। এর আগে রজতাভ দত্ত অভিনয় করতে গিয়েছিলেন মুম্বই। এই বছর আবারও যাচ্ছেন ‘মেরি পেয়ারি বিন্দু’তে অভিনয় করতে। তার পর শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়। ‘কহানি’ ছবিতে অভিনয়ের পর সম্প্রতি তিনি অনুরাগ বসুর পরিচালনায় ‘জগ্গা জাসুস’ ছবিতে অভিনয় করে এলেন। সুযোগ পেতে চলেছেন বিশ্বজিৎ চক্রবর্তী দুটো ছবিতে। বললেন, ‘‘সুজয় ঘোষের ‘কহানি টু’তে পুলিশ কমিশনারের ভূমিকায় অভিনয় করছি তো বটেই। সেই সঙ্গে যশরাজ ফিল্মসের ছবি ‘মেরি পেয়ারি বিন্দু’তে বাবার রোল করছি।’’ ‘কহানি টু’ আর ‘মেরে পেয়ারি বিন্দু’তে অভিনয় করছেন খরাজ মুখোপাধ্যায়ও।
কাজ শিখে যাচ্ছেন সকলেই
এই ভাবে বলিউডে পাড়ি জমানোর দলে ঢুকে পড়ছেন চলচ্চিত্র সম্পাদক বোধাদিত্য বন্দ্যোপাধ্যায়। সৃজিত মুখোপাধ্যায়, কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়, রাজ চক্রবর্তী, অঞ্জন দত্তের মতো পরিচালকের একাধিক বাংলা ছবিতে সম্পাদনার কাজ করার পর এখন বলিউডে অনিরুদ্ধর ‘পিঙ্ক’ ছবির সম্পাদনা করার কাজ নিয়ে এগোচ্ছেন বোধাদিত্য। বললেন, ‘‘মুম্বইয়ে এখন অনেক কাজের কথা হচ্ছে। পাকা হলেই চলে যাব।’’
কলকাতার নিরাপদ রুটিরুজি ছেড়ে মুম্বই চলে যাওয়ার মধ্যে এক ধরনের ঝুঁকি তো থেকেই যায়। সেই ঝুঁকি কী ভাবে সামাল দেবেন ওঁরা? সৃজিত, অনিরুদ্ধ, সুমন —প্রত্যেকেই বলছেন ঝুঁকি না নিলে তো নিজেকে সমৃদ্ধ করা সম্ভব নয়। তাই ঝুঁকি নিয়েই তাঁরা এগিয়ে চলেছেন।
কলকাতা থেকে ছাব্বিশ বছর বয়েসে অজয় বিশ্বাসের অ্যাসিসটেন্ট হয়ে মুম্বইতে কাজ করতে গিয়েছিলেন পরিচালক প্রভাত রায়। অজয় বিশ্বাসের পর প্রমোদ চক্রবর্তী, শক্তি সামন্তের সহকারী হয়েই তাঁর উত্থান। প্রথম দিকে বলিউডে গিয়ে তাঁকে সংগ্রাম করতে হয়েছিল। কিন্তু তার পর পেয়ে যান থিতু জীবন। আজকে যে বাংলার শিল্পী-কলাকুশলীরা মুম্বই যাচ্ছেন তাঁদের ব্যাপারে আশাবাদী প্রভাত। তিনি বলছেন, ‘‘এখন যাঁরা মুম্বই যাচ্ছেন, তাঁরা সকলেই কাজ শিখে যাচ্ছেন, বাংলায় প্রতিষ্ঠা পাওয়ার পর যাচ্ছেন। তাই সফল হওয়ার ভাল সম্ভাবনা।’’
কলকাতা যখন কলকাতাতেই
কলকাতা থেকে একাধিক পরিচালক মুম্বইমুখী হলেও এই মুহূর্তে বিনা আমন্ত্রণে মুম্বই যেতে নারাজ পরিচালক কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়। কারণ তিনি তাঁর কেরিয়ারের শুরুতেই মুম্বই টেলিভিশনের জন্য কাজ করেছিলেন। ‘রাহাত’ নামের সেই সিরিয়াল এক বছর চলার পর বন্ধ হয়ে যায়। কৌশিক হেসে বললেন, ‘‘বলিউড আমার কাছে পুরনো প্রেমিকার মতো যে আমাকে প্রত্যাখ্যান করেছে। এখন যদি সেই পুরনো প্রেমিকা ভিড়ের মধ্যে থেকে অটোগ্রাফ নিতে এগিয়ে আসে, তা হলেই যাব।’’ সব মিলিয়ে কলকাতার পরিস্থিতি যা দাঁড়িয়েছে তাতে এই ২০১৬র বাকি সাত মাসে বাংলার অনেক শিল্পীই সৃষ্টির টানে পৌঁছে যাবেন আরব সাগরের তীরে। আমচি মুম্বইয়ে তাঁদের সাফল্য কতটা আসবে, জাতীয় পরিচিতি আদৌ হবে কি হবে না তার উত্তর দেবে সময়। এই ভাবে মুম্বই পাড়ি দেওয়ার মধ্যে ঝুঁকি তো থাকছেই। তবে শেখাটাও যে অনেক। সৃজিত যেমন বলছিলেন, ‘‘এখানে এসে একটা জিনিস শিখলাম যে, দিনের শেষে কাজটাই সব।’’
শিল্পী-কলাকুশলীরা তো বটেই নিউ বাংলা নিউ এজ ছবির একাধিক প্রযোজক ভাবছেন হিন্দিতে ছবি করার কথা। কারণ বাংলা ছবি করে কোনও লাভ হচ্ছে না। বরং লাভ আছে সিরিয়ালে। আর হিন্দি ছবিতে। সেখানে বাজার অনেক বড়।
টালিগঞ্জের বঙ্গ কি তা হলে সত্যিই পশ্চিমে ঢলছে?