অসীমা মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে সম্প্রতি কথা হচ্ছিল তার কারনানি ম্যানসনের ফ্ল্যাটে। অসীমাদি বললেন, ‘আনন্দপ্লাস’-এ চৌরঙ্গীর গান নিয়ে তোমার লেখা পড়লাম। তুমি যে লিখেছ পিনাকীবাবু প্রথমে আপত্তি করেছিলেন ‘বড় একা লাগে’ গানটিতে, তারপর উত্তমবাবুর অনুরোধে সে-গান রেকর্ড হয়—এ পর্যন্ত ঠিক আছে। কিন্তু তার পরের ঘটনা কি জানো? গান তো রেকর্ড হল, শ্যুটিংও হল। পরিচালক পিনাকী মুখার্জি বললেন, ‘না, এ গানটা সিচুয়েশনের সঙ্গে যাচ্ছে না। সিনটা ফেলে দিতে হবে।’ আমাদের তো মাথায় হাত। কিন্তু পরিচালকের উপরে কথা বলা যায় না। আমাদের মন খারাপ দেখে উত্তমবাবু বললেন, ‘সবাই চুপচাপ থাকুন। ওই একই সেটে আমার অন্য সিন যেদিন শ্যুট হবে, এই গানটা আমি আর একবার শ্যুট করিয়ে নেব। পরিচালককে রাজি করানোর দায়িত্ব আমার।’
যে কথা সেই কাজ। গানটার দ্বিতীয়বার শ্যুট হল। উত্তমকুমার নিজে অনেক সাজেশন দিয়ে কাজটা করালেন।
গানটির রেকর্ডিং হয়েছিল ১৯৬৭-তে, নিউ থিয়েটার্সের এক নম্বর স্টুডিওতে। বাতিল হওয়া সেই গান আজও সমান জনপ্রিয়তায় ৫০ বছর পূর্তির মুখে। আর ‘চৌরঙ্গী’ ছবির ওই দৃশ্য এখনও দেখলে বুকের ভিতর তোলপাড় হয়।
সত্যি সে একটা সময় ছিল বটে। ‘চৌরঙ্গী’তে সুর করার কথা ছিল শচীনদেব বর্মনের। কথাবার্তা অনেক দূর এগিয়েও ছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত অল্প বাজেটের বাংলা ছবিতে বোম্বের এই অন্যতম ব্যস্ত সুরকারকে অ্যাফোর্ড করা গেল না। অসীমাদিদের হোম প্রোডাকশনের ছবি। ঠিক হল তিনিই সুর করবেন। ভেবে দেখুন, ১৯৬৭ সালের কথা। তখন অসীমাদির কতটুকুই বা বয়স। রেডিওর চাকরি (পরে ডেপুটি স্টেশন ডিরেক্টর হয়ে রিটায়ার করেন)-তে জয়েন করেন তার অনেক পরে। মহিলা সুরকার— এই ধারণাটা বাংলা গানে তখন তেমন নেই। ভাবলে অবাক লাগে, অসীমাদি এবং নীতা সেন ছাড়া তেমন কোনও মহিলা সুরকার পাওয়া গেল না। হৈমন্তী শুক্ল, স্বাগতালক্ষ্মী বা অরুন্ধতী হোম চৌধুরী মূলত নিজেদের অল্প কিছু গানে সুর করেছেন। অসীমাদিও এই প্রথম সুর করছেন। কিন্তু বাংলা গানের তিন কিংবদন্তি শিল্পী সানন্দে গাইলেন এই ছবিতে। প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায় অবশ্য গেয়েছিলেন একটি রবীন্দ্রসঙ্গীত ‘এই কথাটি মনে রেখো’। এই গানের জন্য সে বছর তিনি বি.এফ.জে পুরস্কার পান। হেমন্ত মুখোপাধ্যায় অসাধারণ গাইলেন ‘কাছে রবে, জানি কোনও দিন হবে না সুদূর’ গানটি।
ওদিকে ফোনেই যোগাযোগ হল মান্নাদার সঙ্গে। অসীমাদিদের যোধপুরের বাড়িতে নিজে এসে গান ‘শিখে’ গেলেন। রেকর্ডিং-এর দিন একটা বলার মতো ঘটনা ঘটল। নভেম্বর মাস। পরিষ্কার আকাশ। একেবারে মেঘমুক্ত আবহাওয়া যাকে বলে। মান্নাদার রেকর্ডিং শেষ হল। তার পরই ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামল। মান্নাদা একটু হেসে অসীমাদিকে বললেন, ‘‘দেখেছেন কাণ্ড! আপনি ‘দেশ’ রাগে গানটার সুর করেছেন। বোধহয় মীড়-গুলো ঠিকমতোই লাগিয়েছি। প্রকৃতিও সে কথা বুঝেছে।’’ এই একটি কথা। একজন নতুন নবীন, তার ওপরে মহিলা সুরকার—মান্নাদার ওই কথায় আরও কাজ করার কনফিডেন্স এল তার।
মান্নাদাকে যখন গান শেখাচ্ছেন অসীমাদি, তখন মান্নাদা হঠাৎ বললেন, ‘‘আপনার গলাটা তো চমৎকার! কার কাছে শেখেন?’’ যখন শুনলেন তার গুরুরা হলেন জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ, পঙ্কজ মল্লিক, শৈলেন মুখোপাধ্যায়, তখন মান্নাদা বললেন, ‘‘আপনাকেও গান গাইতে হবে। গলাটাকে কাজে লাগান।’’ পরবর্তী ছবি ‘মেমসাহেব’-এ তাই ঘটল। মান্নাদার সঙ্গে ডুয়েটে অসীমাদি গাইলেন, ‘আজ বুঝি পাখিরা’। শুধু তাই নয়, ছবির ফিমেল ভয়েসের সব গানই গাইলেন অসীমাদি।
রেডিওতে একটি অপূর্ব গানের অনুষ্ঠান ‘রম্যগীতি’। কত ভাল ভাল গান আমরা শুনেছি এই অনুষ্ঠানে। অসীমাদির অনুরোধে বহু ব্যস্ততার মধ্যেও মান্নাদা গেয়েছেন বহু গান, অবশ্যই অসীমাদির সুরে। একটু প্রবীণ শ্রোতাদের ভাললাগায় এখনও জড়িয়ে আছে মান্নাদার গাওয়া সেই সব গান—গোলাপে কাঁটা, জলের ঠিকানা, আমার যা দেবার ছিল, ভাল আমি বেসেছি, অনেক হয়েছে রাত, কত দিন পরে, আমি যেমন থাকি না, আমার যখন তখন বিদেশ যেতে হয়, বহু দিন হল, ইত্যাদি। ‘গোলাপে কাঁটা’ গানটি মান্নাদা পরবর্তী কালে এইচএমভি-তে রেকর্ড করেছিলেন। কিন্তু অন্য সব রম্যগীতি, পুজোর গান, এ মাসের গান? মান্নাদার গাওয়া সেই সব অসাধারণ গান আর শোনা যাবে না। নতুন প্রজন্ম জানবে না? থাকবে শুধু আমাদের একদা শ্রবণে?
‘শুভরজনী’ ছবিতে অসীমাদির সুরে মান্নাদার অসাধারণ গান ‘ঈশ্বর বললেন’। গানটির রেকর্ডিঙের সময় মান্নাদার একটা কথা শুনে অসীমাদি একেবারে চমকে গেলেন। মান্নাদা বললেন, ‘‘এই ছবিতে সুরকার হিসেবে আপনার নাম থাকবে তো? নাকি, সুর করবেন আপনি, আর নাম যাবে অন্য কারও।’’ বিষয়টা একটু খুলে বলি। অসীমাদির হোম প্রোডাকশনে নতুন ছবি মুক্তি পেয়েছে। একেবারে ভিন্ন চরিত্রে রয়েছেন উত্তমকুমার। ছবিটি সুপারহিট হল। হেমন্ত মুখোপাধ্যায় ও মান্নাদার গাওয়া গান দুটো লোকের মুখে মুখে ফিরছে। ছবিটির টাইটেল কার্ডে দেখা গেল অসীমা মুখোপাধ্যায় নয়, সুরকারের নাম অন্য একজনের।
এমন কাণ্ড কখনও কখনও ঘটে। কিছু জানা যায়, কিছু জানা যায় না। একবার গীতিকার মিন্টু ঘোষকে বলেছিলাম—সেই আমলে অসংখ্য যুক্তাক্ষর দিয়ে গৌরীপ্রসন্ন কী অপুর্ব গান লিখেছিলেন ‘হসপিটাল’ ছবিতে। যেমন, ‘এই সুন্দর স্বর্ণালি সন্ধ্যায়/ এ কি বন্ধনে জড়ালে গো বন্ধু’। শুনে মিন্টুদা একটু ম্লান হাসলেন। অনেক চাপাচাপির পর মিন্টুদা বললেন, ‘‘ঘটনা হচ্ছে এই গানটি আমার লেখা। কী ভাবে যে গৌরীপ্রসন্নের নামে চলে গেল! যখন চোখে পড়ল, তখন আর কিছু করার ছিল না।’’
নিজের সৃষ্টি অন্যের নামে গেলে কেমন দুঃখ হয়, মান্নাদা জানতেন। এ জন্য খানিকটা রসিকতা করেই অসীমাদিকে বলেছিলেন, সুরকার হিসেবে সঠিক মানুষটির নাম যেন লেখা থাকে। ওই ছবিতে মান্নাদা এবং পিন্টু ভট্টাচার্যের একটি ডুয়েট গান ছিল। দু’জনেই আলাদা ভাবে গানটা শিখেছেন। ধারে-ভারে মান্নাদা অনেক বড় শিল্পী। রেকর্ডিঙের সময় সবাই একটু ভয়ে ভয়ে ছিল, মান্নাদার মুড যাতে বিগড়ে না যায়! কিন্তু মান্নাদা ছিলেন অত্যন্ত উদার মনের মানুষ। তাই রেকর্ডিঙের সময় মান্নাদা ভীষণ ভাবে কো-অপারেট করলেন মিন্টুদাকে। সবাই একবাক্যে বললেন, ‘‘কত বড় মনের মানুষ মান্নাদা। যত বড় মন, তত বড় শিল্পী।’’
এই প্রসঙ্গে একটি ঘটনা মনে পড়ল। অনেক দিন আগে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের ডুয়েট গানের একটি অ্যালবাম প্রকাশ করেছিল ‘টি-সিরিজ’। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গান গাইবার জন্য জয়ন্ত দে নামে একজন গায়ক সিলেক্ট হয়। মুশকিল হল, তেমন নাম নেই বলে কলকাতার অনেক প্রতিষ্ঠিত মহিলা শিল্পী জয়ন্ত দে-র সঙ্গে গান গাইতে রাজি হয়নি। কিন্তু নাম নয়, তার কণ্ঠ শুনে এককথায় গাইতে রাজি হয়েছিলেন কে জানেন? অনুরাধা পড়োয়াল। বড় শিল্পী, বড় মন। বড় মন, বড় শিল্পী। তার পরে সেই অ্যালবাম ‘নীড় ছোট ক্ষতি নেই’ তো ইতিহাস হয়ে গেল। এখনও পর্যন্ত টি-সিরিজের সর্বাধিক বিক্রীত বাংলা গানের অ্যালবাম ওটি।
নিজেকে নিয়ে ‘স্বপ্নের গায়ক, স্বপ্নের নায়ক’-এর শ্যুটিং করছিলেন মান্নাদা। কলকাতা থেকে খানিক দূরে একটা বাগানবাড়িতে শ্যুটিং। গাড়িতে স্ক্রিপ্ট পড়তে পড়তে এসেছেন। যে কাজই হোক, সঠিক হোমওয়ার্ক করেন মান্নাদা। সব কিছু ঠিকঠাক চলছিল। পরিচালক যেমন বলছেন, ঠিক তেমনটি করছেন মান্নাদা। হঠাৎই এক বিপত্তি। পড়ে গিয়ে মান্নাদার চশমাটা ভেঙে গেল। কী হবে এখন? একমাত্র অসীমাদির চোখেই চশমা। মান্নাদা অম্লানবদনে সেই চশমা পরে সারাদিনের বাকি কাজ সারলেন। নিজের অসুবিধার জন্য বাকি সকলের অসুবিধা করে শ্যুটিং ক্যানসেল করলেন না। নিজের চশমার বিনিময়ে অসীমাদি কী পেলেন? এক অমূল্য সম্পদ। মান্নাদার ভাঙা চশমাটি। পরম গর্বের সঞ্চয় হিসাবে আজও যা রাখা আছে সযত্নে। এখনও অসীমাদির আক্ষেপ, অপ্রকাশিত ‘বিনয়-বাদল-দীনেশ’ সিনেমাটিতে তার সুরে ও গৌরীপ্রসন্নর লেখায় মান্নাদার গাওয়া অসামান্য ছ’খানা গান, যেগুলো রেকর্ড করেছিল ‘গাথানি’, কি শুনতে পারব না আমরা? মান্নাদার গাওয়া ছ’ছখানা গান?