ছবি: সুব্রত কুমার মণ্ডল।
‘‘কত বড় মিথ্যে, ফাঁকি, ভুয়ো ব্যবস্থার মধ্যে আমাদের থাকতে হচ্ছে। আর সেটা আমাদের মেনে নিতে হচ্ছে। এর প্রতিবাদ করা উচিত। ওদের জানানো উচিত এটা মিথ্যে...ফাঁকি...অন্যায়...।’’
নাটকীয় ভাবে এই সংলাপ বলতে বলতে পদ্মপুকুর রোডে মৃণাল সেনের বাড়ির ডাইনিং স্পেসের চেয়ার টেনে বসে পড়েন রঞ্জিত মল্লিক।
তারপর মৃণালকে জিজ্ঞাসা করেন, ‘‘মনে আছে মৃণালবাবু, ডায়লগটা?’’
বয়স ৯৩। প্রায় চলৎশক্তিহীন। জরা ঘিরে ধরেছে তাঁকে। কিন্তু মুখের হাসিতে ছুঁয়ে আছে যুবকের রসিকতা। প্রাণশক্তি। মুহূর্তে ফিরে যান তেতাল্লিশ বছর আগে। স্মৃতির গভীর থেকে চকচক করে ওঠে চোখ দু’টো। হাসতে হাসতে বলেন, ‘‘‘ইন্টারভিউ’ ছবিতে তোমার ডায়লগ ছিল এটা!’’
কাঁটায় কাঁটায় সন্ধে সওয়া সাতটায় মৃণালের বাড়ি পৌঁছেছিলেন রঞ্জিত মল্লিক। মুখে সেই নায়কোচিত হাসি। হাতে মিষ্টির প্যাকেট। দিনটা ছিল ২ অগস্ট রবিবার। উপলক্ষ তাঁর প্রথম ছবি ‘ইন্টারভিউ’য়ের জন্য কার্লোভি ভ্যারি আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে সেরা অভিনেতার পুরস্কার পাওয়া। ১৯৭২ সালে ২ অগস্ট এই পুরস্কার পান রঞ্জিত। তার পর থেকে গত ৪৩ বছর প্রতি ২ অগস্ট তিনি দেখা করতে যান মৃণালের সঙ্গে।
এই বছরও সেই নিয়মের অন্যথা হল না।
মৃণালের বাড়ি পাল্টেছে বার বার। ঠিকানা পাল্টেছে। নতুন ঠিকানা খুঁজে প্রতিবছরই রঞ্জিত হাজির হয়েছেন মৃণালের বাড়িতে ২ অগস্ট।
তখন ডাইনিং রুমে বসে মৃণাল। এই সময়টা প্রত্যেক দিনই ডাইনিং রুমে বসে টিভিতে খবর দেখেন তিনি। কখনও বা নজর রাখেন স্পোর্টস চ্যানেলে ক্রিকেট ম্যাচের সন্ধানে। অতিথি এলে তাঁদের সঙ্গে আড্ডায় মাতেন এই সময়টায়।
২ অগস্টও তেমনি এসে বসেছিলেন তিনি খাবার ঘরে। মাঝে মাঝে অসুস্থ হয়ে পড়লেও বা ওয়াকার নিয়ে হাঁটলেও তাঁর মধ্যে প্রাণের স্ফুরণ আগের মতোই। একটা সময় ছিল একবার মৃণাল কথা শুরু করলে আর সহজে থামতেন না। এখন সেই স্বভাব বদলেছে। এখন বলেন কম, শোনেন বেশি। মুচকি মুচকি হাসেন আর অন্যদের কথা শুনে উপভোগ করেন।
জিজ্ঞেস করেন রঞ্জিতকে, ‘‘তোমাকে আমার কাছে কে পাঠিয়েছিল মনে আছে?’’ রঞ্জিত বলেন, ‘‘আপনার কাছে আমাকে পাঠিয়েছিলেন আমার কাকা বিমলচন্দ্র মল্লিক। সব মনে পড়ে যায়। দোজ ওয়্যার গোল্ডেন ডেজ মৃণালবাবু। আমি তো অভিনয়ের কিছুই জানতাম না। সে কথা খোলাখুলি জানিয়েছিলাম প্রথম দেখাতেই। তার পর সিনেমাটোগ্রাফার কে কে মহাজন আমার লুক টেস্ট করেছিলেন!’’
২০১৫ ইন্টারভিউ
১৯৭১ ‘ইন্টারভিউ’
‘ইন্টারভিউ’ নিয়ে কথা বলতে বলতেই চলে আসে আজকের সিনেমার প্রসঙ্গ। রঞ্জিত জিজ্ঞাসা করেন, ‘‘আজকালকার ছবি দেখেন মৃণালবাবু?’’
৯৩ বছরের অশক্ত শরীর। কিন্তু স্মৃতি সজীব। মৃণাল জানান, ‘‘শেষ হলে গিয়ে দেখেছি কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘শব্দ’। দারুণ ছবি। কৌশিক কিন্তু দুর্দান্ত ভাল কাজ করছে।’’ রঞ্জিত সায় দিয়ে বলেন, ‘‘হ্যাঁ, কৌশিক খুব ভাল ছবি করছে। তবে কি, বদলে গিয়েছে এখনকার সিনেমার কাঠামো। ভবানীপুরের সিনেমা হলগুলো আর নেই। একমাত্র টিম টিম করে চলছে বিজলি হলটা।’’
শুনে বিমর্ষ হন মৃণাল। এক সময় পূর্ণ সিনেমার সামনেই ছিল তাঁর আড্ডার জায়গা। সে কথা বলতে বলতে স্মৃতিতে ডুব দেন। আড্ডা চলে টানা কুড়ি মিনিট। তারই মাঝে আসে তুলসী চক্রবর্তীর অভিনয়ের কথা। ‘পরশপাথর’-এর নস্টালজিয়ায় ভেসে যান অভিনেতা আর পরিচালক।
প্রশ্ন একটাই। ‘ইন্টারভিউ’তে এত সফল রঞ্জিত মল্লিক। কিন্তু মৃণাল সেন তাঁকে আর কোনও ছবিতে নিলেন না কেন? প্রতিবেদকের প্রশ্নের উত্তরে মৃণাল বললেন, ‘‘আর কোনও ছবিতে ওকে দেওয়ার মতো চরিত্র পাইনি। সেই জন্যেই রঞ্জিতকে নেওয়া হয়নি।’’
ঘড়িতে সাতটা পঁয়ত্রিশ। উঠে দাঁড়ান রঞ্জিত।
এ বার যাবার পালা।
যাবার আগে রঞ্জিতের হাত সাদরে জড়িয়ে ধরেন মৃণাল। রঞ্জিত হেসে বলেন, ‘‘আজ আসি। সামনের বছর এই দিনে আবার আসব। ভাল থাকবেন মৃণালবাবু।’’
যেতে যেতে রঞ্জিত এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘‘গোটা ইন্ডাস্ট্রি মৃণালদা বলে ডাকলেও আমি কিন্তু ওঁকে মৃণালবাবু বলেই ডাকি।’’
মৃণালও স্মৃতিমেদুর হাসিমুখে বলেন, ‘সত্যি, রঞ্জিত কিন্তু আমাকে বরাবর মৃণালবাবু বলে। আবার এসো রঞ্জিত। সামনের বছর আবার দেখা হবে।’’
রঞ্জিত চলে যাওয়ার পর উষ্ণ হাসিতে মৃণাল বলেন, ‘‘তেতাল্লিশ বছরে একবারও ২ অগস্ট ও মিস করেনি আমার কাছে আসা। কী আশ্চর্য!’’