বাবা চাইতেন ঝাড়গ্রামের সাইকেল সারাইয়ের দোকানটাই ভাল করে চালাক ছেলেটা।
ছেলে মজে যোগ ব্যায়াম আর শারীরিক কসরতে। জঙ্গলমহলে তখন গুলি-বোমা-বন্দুকের রাজত্ব। এক সময় ৫০-১০০ টাকা ভিক্ষা করে স্পেনের মাদ্রিদে বিশ্ব যোগ প্রতিযোগিতায় অংশ গ্রহণের অর্থ জোগাড় করতে হয়েছে তাঁকে। পর পর তিন বার বিশ্ব যোগ প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর কোনওক্রমে প্রশিক্ষকের চাকরি জোটে সিঙ্গাপুরে। দু’কেজি চাল, কিছুটা আলু আর মায়ের দেওয়া একটা ছোট্ট হাঁড়ি নিয়ে সিঙ্গাপুরের বিমান ধরেছিল সেই ছেলে। সালটা ২০০৫। ২০১৫-এ জঙ্গলমহলের সৌমিক বেরার এখন ঠিকানা সিঙ্গাপুরের অর্চার্ড রোডের চোখ ধাঁধানো শপিং মলের টপ ফ্লোরের ১৫ হাজার বর্গফুটের স্টুডিও। ৩০০ কোটি টাকার এক সংস্থার মালিক ঝাড়গ্রামের সৌমিক এখন সিঙ্গাপুরের অন্যতম বড় যোগ প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের সফল পরিচালক।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর উদ্যোগে রাষ্ট্রপুঞ্জ ২১ জুন-কে আন্তর্জাতিক যোগ দিবস হিসাবে ঘোষণা করা হয়েছিল। বিশ্ব জুড়ে তা পালিতও হল। সেই যোগ প্রশিক্ষণকে মাধ্যম করে জঙ্গলমহলের এক যুবকের শূন্য থেকে একশোয় পৌঁছানোর কাহিনিও তাই কম চমকপ্রদ নয়। পিঁপড়ের ডিম আর ফ্যান-ভাতের জঙ্গলমহল থেকে পৃথিবীর সেরা ধনীদের বাসস্থান এই বিশালবহুল শহরের ভারতীয় যোগ শিক্ষার দাপুটে সংস্থা গড়ে তোলার স্বপ্ন উড়ান সত্যিই অবিশ্বাস্য।
সিঙ্গাপুরেই তাঁর সংস্থা ‘রিয়েল যোগার’ পাঁচটি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র। এ ছাড়া অস্ট্রেলিয়া, ইন্দোনেশিয়াতেও রমরমিয়ে চলছে তাঁর কেন্দ্র। খরচ সাপেক্ষ হলেও দু’বছর আগে খোলা কলকাতার কেন্দ্রতেও এখন ২০০০- এর বেশি ছাত্র-ছাত্রী। সব মিলিয়ে প্রতিদিন তাঁর কেন্দ্রগুলিতে ১৪ হাজার জন যোগাভ্যাস করেন। আর ব্যবসা আরও বাড়াতে জাপানের ১৯টি যোগ প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের একটি সংস্থা অধিগ্রহণ করার পরিকল্পনা করছেন সৌমিক। তাঁর কথায়, “প্রথম পর্যায়ে এশিয়ার সবচেয়ে বড় যোগ শিক্ষার কেন্দ্র হিসাবে নিজের সংস্থাকে প্রতিষ্ঠা করতে চাই। তারপর ইউরোপ-আমেরিকায় পা রাখব।” সে বলে চলে,“ জানেন তো, এখনও আমি সাইকেলের লিক সারাই করতে পারি। বাবার সাইকেলের দোকানটা বন্ধ করতে দিইনি।
আজ আমার সংস্থা কেনার জন্য এখানকার কোটিপতিরা প্রস্তাব দিচ্ছেন। অবিশ্বাস্য সেই প্রস্তাব। কিন্তু না, ঝাড়গ্রামের সাইকেল দোকান যেমন চলছে, আমার রিয়েল যোগা সংস্থাও আমিই চালাব। কাউকে বিক্রি করব না। নিজেই বড়
করব। অনেক রক্ত-ঘাম এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে।”
আর সৌমিকের সাফল্যের পিছনে যে তাঁর জেদটাই সম্বল তা বুঝতে অসুবিধা হয় না। প্রায় শূন্য থেকে শুরু করে এত বড় হয়েছেন। কিন্তু কেউই তো আপনাকে চেনে না?
তাঁর জবাব, চিনলেই মুশকিল। নিজের কাজটা ভণ্ডুল হতে শুরু করবে। বেশ তো আছি।
এখন তাঁর সংস্থায় ৩০০ জন যোগ শিক্ষক কাজ করেন। তবুও এখনও সৌমিক নিজেও প্রশিক্ষণ দেন। কেন?
সৌমিক বলেন,“আসলে ভারতের বাইরে যোগপ্রশিক্ষণ কেন্দ্রগুলোর মালিক ব্যবসায়ীরা। প্রশিক্ষকরা চাকুরে। আর আমার সংস্থায় আমিই তো সবচেয়ে বড় এক্সপার্ট। ফলে ব্যবসা এবং দক্ষতা একসঙ্গে মিশিয়েছি। তাতেই সাফল্য এসেছে।”
তবে দক্ষতা নিয়ে বড়াই করতেই পারে সৌমিক। তাঁর অতীতটা বলে দিলে সকলকেই অবাক হতে হবে।
ঝাড়গ্রামে পড়াশোনা। সেখানকার রাজ কলেজ থেকেই বি-কম পাশ করে সৌমিক। কিন্তু যোগব্যায়াম শুরু হয়েছিল ৪ বছর বয়স থেকেই। ঝাড়গ্রামের জাগ্রত সঙ্ঘ জিমনাসিয়ামে। পরবর্তী কালে জেলা ও রাজ্য স্তরে চ্যাম্পিয়ন হয়ে চেন্নাইয়ে জাতীয় যোগ প্রতিযোগিতায় প্রথম। তারই স্বীকৃতিতে স্পেনের মাদ্রিদে বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে অংশগ্রহণের আমন্ত্রণ পাওয়া। ১ লক্ষ টাকা জোগাড় করতে ভিক্ষা করা। ২২ বারের চেস্টায় মহাকরণে তৎকালীন ক্রীড়ামন্ত্রী সুভাষ চক্রবর্তীর দেখা পেয়েছিলেন সৌমিক। কিন্তু সুভাষবাবু ফেরাননি। ৩০ হাজার টাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। এর পর ইতালির মিলান এবং মেক্সিকো চ্যাম্পিয়নশিপেও প্রথম স্থান। পাশাপাশি এশিয়ার সেরা যোগ প্রশিক্ষকের শিরোপা জোটে সৌমিকের। ২০০৫ সালে যোগ প্রশিক্ষকের চাকরির ডাক পান তিনি। আর তার তিন বছরের মাথায় সৌমিক নিজের সংস্থা শুরু করেন। এখন তাঁর সংস্থার মূল্যায়ন ৩০০ কোটির।
তাঁর কেন্দ্রের বৈশিষ্ট্য কী? সৌমিক জানান, এখন প্রায় সকলেই দিনভর বাতানুকূল ঘরে বা অফিসে থাকেন। ফলে ঘাম ঝরে না। তাঁর কেন্দ্রে ‘হট-যোগ’ অভ্যাস করতে ভিড় সবচেয়ে বেশি। ৪২ ডিগ্রি তাপমাত্রার একটি স্টুডিওয় জনা পঞ্চাশ একসঙ্গে ‘হট-যোগ’ অভ্যাস করেন। এক ঘণ্টার অভ্যাস শেষে সকলেই ঘেমেনেয়ে একসা। কিন্তু শরীরের পক্ষে খুবই উপযোগী বলে দাবি সৌমিকের। পাশাপাশি তাঁর সংস্থার আর্টিস্টিক যোগাও নাকি খুব জনপ্রিয়। এই পদ্ধতিতে নাচের তালে তালে ভারতীয় যোগের অভ্যাস করানো হয়। সৌমিক জানাচ্ছেন, সিঙ্গাপুরে তাঁর সংস্থার ৯০ শতাংশই মহিলা। মহিলাদের মধ্যে সৌন্দর্য ধরে রাখার যে বাসনা থাকে তার ফলেই যোগ প্রশিক্ষণ কেন্দ্রগুলিতে ব্যাপক ভিড় হয়। তাঁর বক্তব্য, ভারতীয় যোগ-ব্যবসার ভবিষ্যৎ আছে।
কিন্তু সে তো বিত্তশালীদের জন্য। সাধারণ মানুষের উপকারে লাগে এমন কিছু করতে চান না? সৌমিকের জবাব, অনেক দিনের পরিকল্পনা। সরকার যদি জায়গা দেয় আমি যোগ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে দিতে পারি। আমার পক্ষে স্থায়ী ভাবে তা দেখা সম্ভব নয়। কিন্তু সিঙ্গাপুর থেকে প্রশিক্ষক পাঠিয়ে, নিজে গিয়েও রাজ্যে যোগ-আন্দোলন শুরু করতে পারি। চাইলে স্কুলে স্কুলে যেতে পারি।
যদিও সৌমিক শেষ করছেন, “কিন্তু আমাকে ডাকবেন কে? মুখ্যমন্ত্রী যদি মনে করেন জঙ্গলমহলের এই ছেলেটাকে কাজে লাগাবেন, আমি যাব। কোনও পারিশ্রমিকের বিনিময়ে নয়, মাটির টানেই যাব।”