এটা হওয়ারই ছিল

বলছেন প্রসেনজিত্‌ চট্টোপাধ্যায়।আমি দেড় বছর আগেই আপনাদের শনিবারের ‘পত্রিকা’য় বলেছিলাম টালিগঞ্জের ঘোর দুর্দিন আসবে যদি না আমরা বক্স অফিস কালেকশনের দিকে মন না-দিই। এটা আসাতে আমার থেকে দুঃখিত আর কেউ নেই। কিন্তু কী জানেন, এটা আসারই ছিল।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০২ জুলাই ২০১৪ ০০:০০
Share:

আমি দেড় বছর আগেই আপনাদের শনিবারের ‘পত্রিকা’য় বলেছিলাম টালিগঞ্জের ঘোর দুর্দিন আসবে যদি না আমরা বক্স অফিস কালেকশনের দিকে মন না-দিই।

Advertisement

এটা আসাতে আমার থেকে দুঃখিত আর কেউ নেই। কিন্তু কী জানেন, এটা আসারই ছিল। বড্ড বেশি দিন ধরে আমরা একটা স্বপ্নের দেশে বাস করছিলাম। কেউই আর থিয়েটার থেকে কত টাকা পেল, তা নিয়ে কথা বলছিল না। শুধু এই রাইটস্‌ থেকে এত টাকা, ওই চ্যানেল বলেছে এত দেব এ সব নিয়ে আলোচনা হত।

কিন্তু দশ বছর আগেও পরিস্থিতিটা উল্টো ছিল। তখন শুধু থিয়েটার থেকে যে ছবি টাকা কামাত, তাকেই হিট বলা হত। কিন্তু গত দু’বছরে হিটের সংজ্ঞাটাই ঠিক করে দিচ্ছিল এই স্যাটেলাইট রাইটস্‌ থেকে আসা টাকাটা।

Advertisement

আর এই ঝামেলায় দয়া করে আর্টিস্টদের দোষ দেবেন না।

পুরনো বহু প্রোডিউসর এমন আছেন যাঁরা আমাদের কত বার এসে বলেছেন, ‘বুম্বাদা আগের ছবিটা চলেনি। এই ছবিতে একটু কম টাকা নেবেন প্লিজ’। হাসতে হাসতে আমরা সবাই সেটা মেনে নিতাম।

কিন্তু আজকে কোনও আর্টিস্ট বা ডিরেক্টরকে কোনও প্রোডিউসর যদি বলেন, ‘একটু টাকা কম নেবে’, সেই আর্টিস্ট বা ডিরেক্টর তো ঘুরে বলবে, “কেন দাদা? রোজ তো পেপারে দেখছি আপনারা ৪ কোটি-৬ কোটি টাকার ছবি অ্যানাউন্স করছেন, আমার টাকা কেন কমাচ্ছেন।” এর উত্তর কিন্তু প্রযোজকরা দিতে পারবেন না। তাঁরা এটাও বুঝছেন না বড় বাজেট মানেই কিন্তু ছবি চলবে এমন কোনও গ্যারান্টি নেই। তাই যদি হত, তা হলে শিবুর ‘রামধনু’ এত রমরমিয়ে চলছে কী করে? শিবুর ছবিতে তো কোটি কোটি টাকা নেই, কিন্তু হৃদয়টা আছে।

আজ এই সংকটের জন্য কিন্তু প্রযোজকদেরই দায়ী করব। তারা ইদানিং কেউ কোটির নীচে কথা বলছিল না। আরে এত ভাল অবস্থা তো নয় ইন্ডাস্ট্রির।

হ্যাঁ, ভেঙ্কটেশ আজ ৫০ পার্সেন্ট অব দ্য ইন্ডাস্ট্রি, কিন্তু অন্য ৫০ পার্সেন্টও তো আছে। ভেঙ্কটেশের তো লস হলে কিছু এসে যায় না। ওরা একটা সিস্টেম করে নিয়েছে ইউটিভি বা যশরাজের মতো, যেখানে ওরা ঠিক প্রফিটে থাকবে। কিন্তু বাকিরা, বিশেষ করে সিঙ্গল প্রোডিউসররা, তো মরে যাবে এই কোটির খেলায় নেমে।

একটা সময় ছিল শু্যটিংয়ে কুকুর ঘুরে বেড়াত, আর আমরা অ্যাক্টররা থাকতাম। কষ্ট করে সবাই কাজ করতাম। কিন্তু এটা খেয়াল রাখতাম যে, প্রোডিউসর যদি ১০০ টাকা খরচ করে, তবে আমাদের ৭০ টাকা হলে টিকিট বিক্রি করে তুলে দিতে হবে। আজ পুরো সমীকরণটাই উল্টো হয়ে গিয়েছে। হল দেবে ৩০ আর স্যাটেলাইট রাইটস্‌ থেকে পাওয়া যাবে ৭০। আরে চ্যানেলগুলো তো ব্যবসা করতে এসেছে। আজকে ওরা সেই টাকা না দেওয়ায় ইন্ডাস্ট্রির নাভিশ্বাস উঠে গিয়েছে। মুম্বইতেও তাই হয়েছে। চ্যানেলরা সব এক হয়ে টাকা কম দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এখানেও এ বার তাই হচ্ছে। কিন্তু আমি যখন বলেছিলাম, লোকে আমাকে বলেছিল, ‘বুম্বাদা তুমি বোঝো না। ইন্ডাস্ট্রির ডায়নামিক্সটা চেঞ্জ হয়ে গিয়েছে’। আজ সেই কথাগুলো কানে বাজছে। আসলে কী হয়েছিল জানেন? লোকে ঢেউগুলো দেখছিল। ঢেউয়ের পিছনের অন্ধকারটা দেখেও না-দেখার ভান করছিল। এর সঙ্গে রয়েছে বছরে ১১০-টা ছবি রিলিজ করার হিড়িক। প্রত্যেক সপ্তাহে রিলিজ! আরে, এত ছবি দেখবে কে?

আমাদের ইন্ডাস্ট্রিটাই অত বড় না। ম্যাক্সিমাম বছরে ৫০ থেকে ৬০টা ছবি রিলিজ করতে পারে। আর এর পাশাপাশি শুরু হল ডিরেক্টরদের মধ্যে কম্পিটিশন।

এ তিন কোটির ছবি করছে, তো অন্য জন চার কোটির ছবি অ্যানাউন্স না-করা অবধি শান্তি নেই। এই ভাবে কি চলে কোনও ইন্ডাস্ট্রি? তবে এর থেকে বেরোতে হলে জেলার হলগুলোকে ভাল করতে হবে। এই তো কিছু দিন আগে জেলার হল-মালিকদের সঙ্গে কথা হচ্ছিল। ওরা আমাকে বলেছিল, ‘দেব আর জিতের ছবি শুধু চলে, বুম্বাদা। তাই দিয়ে আমাদের ৫ সপ্তাহ চলে। বাকি ৪৭ সপ্তাহ আমরা কী করব? আগে আপনি বছরে ১২টা ছবি করতেন, মিনিমাম ৪ সপ্তাহ চলত। সেই থেকে আমাদের চলে যেত। আজ আমাদের উপায় নেই বলে হল চালাচ্ছি। সুযোগ পেলেই আমরা হল বিক্রি করে দেব’।

আর ওরা ভুল বলেনি। একটা সময় আমার নাম ছিল ‘এমজি চ্যাটার্জি’ মানে ‘মিনিমাম গ্যারান্টি চ্যাটার্জি’। মিঠুনদাও এই মিনিমাম গ্যারান্টি বলে বলে করত। সব ছবির বেসিক টাকাটা অন্তত তুলে প্রোডিউসরকে ফেরত দিয়ে দিতে পারতাম আমরা। এটা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব ছিল। এখন আর কেউ এগুলো নিয়ে ভাবে না।

আর এই জায়গা থেকে ইন্ডাস্ট্রিকে বার করতে হলে আমাদের বাংলাদেশের মার্কেটে যেতেই হবে। আমি অনেক চেষ্টা করেছি, কিন্তু তারপর চুপ হয়ে গিয়েছি।

এটা না করলে কিন্তু বাঁচব না আমরা।

চলুন না, সবাই মিলে আমরা একটু বাজেট কমাই। একটু কম ছবি বানাই। দয়া করে থিয়েট্রিকাল ব্যবসার দিকে নজর দিই। আর কোটি টাকা নিয়ে কথা কম বলি।

এই চারটে জিনিস না-করলে কিন্তু সামনে আরও বড় বিপদ আসছে।

এবং আমি মন থেকে চাই না আমার দু’বছর আগের মতো এই প্রেডিকশনটাও মিলে যাক।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন