চরণ ধরিতে ‘দিয়েগো’

বিশ্বকাপ না আনা পর্যন্ত হ্যান্ড অব গড যাঁর, তিনি এগিয়ে থাকবেন লিওনেল মেসি-র থেকে। আর্জেন্তিনার দুই ফুটবল রত্নের বিশ্লেষণ করছেন চুনী গোস্বামীবিশ্বকাপ না আনা পর্যন্ত হ্যান্ড অব গড যাঁর, তিনি এগিয়ে থাকবেন লিওনেল মেসি-র থেকে। আর্জেন্তিনার দুই ফুটবল রত্নের বিশ্লেষণ করছেন চুনী গোস্বামী

Advertisement

শেষ আপডেট: ০৭ জুলাই ২০১৪ ০০:০১
Share:

দুনিয়া কাঁপানো বিতর্কটা প্রথম শুরু করেছিলেন আটাত্তরে আর্জেন্তিনার বিশ্বকাপ জয়ী কোচ লুই সিজার মেনোত্তি। মারাদোনা আর মেসি নিয়ে বছর কয়েক আগে আলোচনা করতে গিয়ে তিনি বলেছিলেন, “মেসি, মারাদোনা দু’জনেই আর্জেন্তিনার ফুটবল-গর্ব। কিন্তু সামনে থেকে নেতৃত্ব দেওয়ার ব্যাপারে আমি কিন্তু মেসির চেয়ে দিয়েগোকেই এগিয়ে রাখব।”

Advertisement

বিলার্দোর এই মন্তব্যের পরেই পাল্টা মুখ খোলেন ব্রাজিল এবং আর্জেন্তিনার দুই প্রথম সারির ফুটবল ব্যক্তিত্ব। এদের প্রথম জন টোস্টাও। যিনি সত্তরের বিশ্বকাপ জয়ী পেলেদের ব্রাজিল টিমের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য। তাঁর কথায়, “মারাদোনার চেয়ে মেসির খেলা অনেক আকর্ষণীয়। চোখকে সুখী করতে হলে আমি মেসির খেলাই দেখতে বসব।”

আর দ্বিতীয় জন আবার এক আর্জেন্তাইন কোচ। নাম কার্লোস বিয়াঞ্চি। যিনি মারাদোনা, মেসি দু’জনকেই বেড়ে উঠতে দেখেছেন। সেই বিয়াঞ্চি বলে বসেন, “পেলে বা মারাদোনার চেয়েও মেসি এগিয়ে।”

Advertisement

ব্রাজিল ও আর্জেন্তিনার এই তিন প্রখর ফুটবল ব্যক্তিত্বের মন্তব্য একটা কথাই প্রমাণ করে—দু’জনের খেলাতেই প্রচুর মিল। দু’জনেই আর্জেন্তিনার অধিনায়ক। দু’জনেই দশ নম্বর। তবে অমিলও রয়েছে বেশ কিছু। সে কারণেই এই দুই ফুটবল গ্রেটকে নিয়ে এত তুলনা, এত আলোচনা।

আর্জেন্তিনার এই দুই ফুটবল রত্নের খেলাই আমি নিজের চোখে দেখেছি। তা দেখার ভিত্তিতে প্রথমে দু’জনের টেকনিক্যাল মিলগুলোতেই আসা যাক।

মিল

দু’জনেই বাঁ পায়ের শিল্পী ফুটবলার এবং খুব বড় মাপের ড্রিবলার

প্রথমে মারাদোনার কথাতেই আসি। ছিয়াশির বিশ্বকাপ কোয়ার্টার ফাইনালে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে মারাদোনার দ্বিতীয় গোলটার কথা মনে করুন। হেক্টর এনরিকের থেকে নিজেদের অর্ধে সেন্টার সার্কেলের দশ মিটার ভিতরে বলটা পেল মারাদোনা। তার পরের দশ সেকেন্ডে ইংরেজদের গোলের দিকে মারাদোনার ৬০ মিটারের দৌড়। আর সেই দৌড়ে ধাপে ধাপে ফুটবলের রাজপুত্র ড্রিবল করে ছিটকে দিল পিটার বিয়ার্ডসলি, পিটার রিড, টেরি বুচার (দু’বার) এবং টেরি ফেনউইক। সবশেষে ইংল্যান্ড গোলকিপার পিটার শিল্টনকে কাটিয়ে মারাদোনার সেই ঐতিহাসিক গোল।

ঠিক তেমনই বছর সাতেক আগে স্প্যানিশ লিগে গেটাফের বিরুদ্ধে লিও মেসির গোলটাও ভোলার নয়। সেই ম্যাচে ও মারাদোনার মতোই ছ’জনকে ড্রিবল করতে করতে বার্সেলোনার জার্সি গায়ে গোলটা দিয়ে এসেছিল মেসি।

কেউ কেউ নাক সিঁটকে বলতে পারেন, লা লিগার ম্যাচ আর বিশ্বকাপের ম্যাচ এক নয়। তা হলে এ বারের বিশ্বকাপে বসনিয়া অ্যান্ড হার্জেগোভিনার বিরুদ্ধে মেসির গোলটার কথা মনে করুন। তিন জনকে ড্রিবল করে এলএম টেন-এর গোল সেই উত্তর দিয়ে দেবে ।

দু’জনে হেডে সে ভাবে দক্ষ নয়

মেসি ও মারাদোনা দু’জনেই এরিয়াল বলে হেড দিয়ে গোল করায় সে রকম দক্ষ নয়। মেসিকে তাও ক্লাব পর্যায়ে দু’-এক বার হেডে গোল করতে দেখেছি। কিন্তু মারাদোনাকে হেডে গোল করতে দেখেছি বলে মনে করতে পারছি না। এর কারণ দু’জনেরই উচ্চতা কম। যদি উচ্চতা বেশি হত তা হলে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে সেই কোয়ার্টার ফাইনালে মারাদোনা শিল্টনকে টপকেই হেডে প্রথম গোলটা করে আসত। ওকে আর ‘ভগবানের হাত’ বিতর্ক তাড়া করত না।

দু’জনেই মাঠটাকে খেলার সময় খুব ভাল ভাবে মেপে নেয়

এ বারের বিশ্বকাপ প্রি-কোয়ার্টার ফাইনালে সুইসদের বিরুদ্ধে দি’মারিয়ার গোলটা একবার চোখ বুজে মনে করুন। মাঝমাঠ থেকে মেসি বলটা ধরেই পেরিফেরিয়াল ভিশনে দেখে নিয়েছিল ডান দিক ধরে উঠছে দি’মারিয়া। কোনও দিকে না তাকিয়ে ডাউন দ্য মিডল ঢুকে বক্সের ঠিক আগে দি’মারিয়ার জন্য যে ফরোয়ার্ড পাসটা রাখল মেসি, সেখান থেকে গোল করতে ভুল করেনি দি’মারিয়া।

মারাদোনাও এই দলে। বেশ মনে আছে ছিয়াশির বিশ্বকাপে মেক্সিকোর আজটেক স্টেডিয়ামে বিশ্বকাপ ফাইনালে আর্জেন্তিনা-পশ্চিম জার্মানি ম্যাচটা। কেলাটা মাঠে বসে দেখেছিলাম। ব্রাউন আর ভালদানোর গোলে আর্জেন্তিনা এগিয়ে যাওয়ার পর সেই গোল জার্মানদের হয়ে শোধ করে দেয় রুমেনিগে, ফোলার। মারাদোনা খেলা শেষ হওয়ার ঠিক আগে জয়সূচক গোলটা বুরুচাগাকে দিয়ে করানোর সময় বলটা কিন্তু বাড়িয়েছিল ওর দিকে না তাকিয়েই।

দু’জনের এই ড্রিবলিং, ফরোয়ার্ড পাসিং, ভিশন—সব কিছুতে এত মিল সত্যিই বিস্ময় জাগায় বইকী।

তা হলে মেসি এবং মারাদোনার মধ্যে অমিল কোনগুলো? এ বার আসব সে কথায়।

অমিল

স্পট কিক নেওয়ায় মারাদোনার চেয়ে এগিয়ে মেসি

মেসি ক্লাব স্তর এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ডান দিক এবং বাঁ দিক থেকে সব ধরনের স্পট কিক নিয়ে অভ্যস্ত। কর্নার, ফ্রিকিক— সব নিয়ে থাকে দক্ষতার সঙ্গে। সেখানে মারাদোনা একটু পিছিয়েই থাকবে। কারণ ফুটবলের রাজপুত্রকে স্পটকিকে খুব একটা রাজত্ব করতে দেখা যায়নি কোনও দিন।

মারাদোনার চেয়ে মেসির মাথা ঠান্ডা

মারাদোনার খেলার সময় ইনভলভমেন্টটা এত বেশি থাকত যে আবেগটাকে সংবরণ করতে পারত না। মাঝেমাঝেই উত্তেজিত। বিরাশিতে স্পেনের বিশ্বকাপে ব্রাজিল ম্যাচে সক্রেটিস ওকে প্রায় বোতলবন্দি করে রেখেছিল। মারাদোনা সেই রাগে টার্গেট করেছিল ফালকাওকে। কিন্তু ওকে বাগে না পেয়ে মেরে বসল বাতিস্তাকে। ফল লাল কার্ড। মারাদোনার মার্চিং অর্ডার। সেখানে মেসির মাথাটা শশার মতো ঠান্ডা। কেউ মারলে তেড়ে যায় না। উল্টে শিশুসুলভ হাসিমুখে তাকিয়ে থাকে সেই ফুটবলারের দিকে। মাঠে কখন কী করবে, কতটা ড্রিবল, কতটা দৌড়, মাঠের বাইরে কতটা কথা বলবে—সবটাই নিয়ন্ত্রিত মেসির ক্ষেত্রে।

বিশ্বকাপ রয়েছে মারাদোনার হাতে

এ বার টেকনিক্যাল নয়। একটু বাস্তবের রাস্তায় হাঁটছি। মারাদোনার হাতে রয়েছে ছিয়াশির বিশ্বকাপ। তিনটে বিশ্বকাপ খেলে একটায় চ্যাম্পিয়ন। নব্বইতে রানার্স। সেখানে মেসি কিন্তু এখনও বিশ্বকাপ বুয়েনস আইরেসে নিয়ে যেতে পারেনি। সাফল্যের দিক দিয়ে তাই এখনও পর্যন্ত এগিয়ে কিন্তু সেই দিয়েগোই।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন