দুই মলাটে ফিরে এল শেফালির সন্ধ্যারাত

ব্যাকগ্রাউন্ডে ‘চৌরঙ্গি’ ছবির বিখ্যাত এক স্টিল। ঝলমলে সাজে লাস্যময়ীর নাচের দৃশ্য। আজ তিনি প্রৌঢ়া। মঞ্চে বহু দিনের পরিচিত দুই শিল্পীর মাঝে বসে আছেন। সাজে এখনও কিছুটা চাকচিক্যই পছন্দ। নেটের শাড়ি-পুঁতি বসানো টিপ। উধাও শুধু ঠোঁটের কোণে আবেদন উস্কানো হাল্কা হাসিটা। চোখে-মুখে যেন বিস্ময়। নাকি এখনও অভিমান? কেমন আছেন মিস শেফালি? কেমন কেটেছে তাঁর জীবনটা?

Advertisement

সুচন্দ্রা ঘটক

কলকাতা শেষ আপডেট: ০৮ জানুয়ারি ২০১৫ ০১:০৫
Share:

আনন্দ পাবলিশার্স থেকে প্রকাশিত হল মিস শেফালির আত্মজীবনী ‘সন্ধ্যারাতের শেফালি’। সেই অনুষ্ঠানে তাঁর সঙ্গে শংকর এবং দীপঙ্কর দে। বুধবার, রোটারি সদনে। ছবি: দেবাশিস রায়।

ব্যাকগ্রাউন্ডে ‘চৌরঙ্গি’ ছবির বিখ্যাত এক স্টিল। ঝলমলে সাজে লাস্যময়ীর নাচের দৃশ্য।

Advertisement

আজ তিনি প্রৌঢ়া। মঞ্চে বহু দিনের পরিচিত দুই শিল্পীর মাঝে বসে আছেন। সাজে এখনও কিছুটা চাকচিক্যই পছন্দ। নেটের শাড়ি-পুঁতি বসানো টিপ। উধাও শুধু ঠোঁটের কোণে আবেদন উস্কানো হাল্কা হাসিটা। চোখে-মুখে যেন বিস্ময়। নাকি এখনও অভিমান?

কেমন আছেন মিস শেফালি? কেমন কেটেছে তাঁর জীবনটা?

Advertisement

তাঁর কথাই নাকি শুনতে এসেছেন অডিটোরিয়াম ভর্তি ‘রুচিশীল’ বাঙালি! সংস্কৃতিমনস্ক শহরবাসীর পীঠস্থান নন্দন চত্বরের অনতিদূরেই সম্ভ্রান্ত-শিক্ষিত জনেদের ভিড় জমেছে তাঁকে ঘিরে। উপলক্ষ তাঁর আত্মজীবনী ‘সন্ধ্যারাতের শেফালি’-র প্রকাশ অনুষ্ঠান। এত যুগ পরে লাইমলাইটে কার্যত বাক্‌রুদ্ধ সাত-আটের দশকের বাংলা রুপোলি পর্দার সেই ‘হার্টথ্রব’।

মঞ্চে পড়া হচ্ছে তাঁরই আত্মজীবনী থেকে নির্বাচিত অংশ। বাড়ি ছেড়ে ফিরপোস হোটেলে নাচ। বিদেশি নর্তকীদের কাছে ট্রেনিং। এটিকেট শিক্ষা। তাঁরই মাঝে বাবার শাসনের ভয়ে মায়ের সঙ্গে গঙ্গার ধারে দেখা করা। চোখের জল আটকাতে পারেন না। ইতিহাস এখনও কাঁদায় শেফালিকে। দর্শকাসনে পাশে বসা বৃদ্ধা যেন একটু ভুরু কোঁচকান। সহানুভূতির খোঁজে অভিনয় নয় তো? রুমাল দিয়ে রীতিমতো চোখ রগড়াচ্ছেন মঞ্চের প্রৌঢ়া। জনসমক্ষে এটিকেট মেনে চোখ মোছার কায়দা বুঝি তাঁর আর আসে না। অভিনয় তো দূর অস্ত্‌।

পেটের টানে ক্যাবারে শেখা উদ্বাস্তু পরিবারের এই কন্যার গোটা কেরিয়ারে শিল্পীর সম্মান জোটেনি। কী পরিচয় তাঁর, নর্তকী না নটী? আর যা-ই হোক, তাঁকে অভিনেত্রী পরিচয় দেয় না বাঙালি। এতকাল পরে মঞ্চে অভিনয় করার দায় আছে কি আর? তাই তো এই বইয়ে উজাড় করে দিয়েছেন এত দিন মনের কোণে লুকিয়ে রাখা মান-অভিমান-লজ্জা-লাঞ্ছনা-ভাল লাগা।

শীর্ষ বন্দ্যোপাধ্যায় অনুলিখিত বইটি প্রকাশ করে কথায় কথায় পুরনো দিনে ফিরে গিয়েছিলেন সাহিত্যিক শংকর। আনন্দ পাবলিশার্স-এর বইপ্রকাশ অনুষ্ঠানে মুখ্য চরিত্রের আসনে বসা আরতি দাস ওরফে মিস শেফালির তুলনা টানলেন নটী বিনোদিনীর জীবনের সঙ্গে। বললেন,“বিনোদিনীর আত্মকথার পরে এমন দুঃসাহসিক আত্মকথা বোধহয় বাংলায় আর হয়নি।”

আগ্রহীদের জন্য নিজেও লিখে এনেছিলেন দু’-চার কথা। মঞ্চে উঠে পড়ে দিতে পারলেন না। শরীর বেশ খারাপ। কথাও জড়িয়ে যায়। সে লেখা পড়ে শোনানোর দায়িত্ব যায় এক পরিচিতের উপরে। তাঁরই মাধ্যমে দর্শকদের কানে ভেসে আসে শেফালির অনুভূতি। এত সম্মানের দিনে সর্বপ্রথম তাঁর মনে পড়ে সত্যজিত্‌ রায়কে। বইয়েও তেমনই লিখেছেন। শিল্পীর প্রাপ্য সম্মান জুটেছে একমাত্র ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’র পরিচালকের থেকেই। মনে পড়ে উত্তমকুমার ও তরুণকুমারকেও। মঞ্চে পাশে বসা, বহু পুরনো বন্ধু, অভিনেতা দীপঙ্কর দে-র আবদারে শেষে একটু কথা বলতেই হয় মিস শেফালিকে। মাইকে মিষ্টি গলায় মঞ্চে ডাকেন বন্ধু নিমাই ঘোষকে। সেই লাস্যময়ী ছবির আলোকচিত্রী। সে সব ছবিই তো তাঁকে বানিয়েছিল হার্টথ্রব। এমন সম্মানের দিনে সেই বন্ধুকে স্বীকৃতি না দিয়ে কি পারেন শেফালি?

শেফালির চরিত্রের এই আটপৌরে দিকটাই নানা ভাবে মঞ্চে উল্লেখ করেছেন দীপঙ্কর, পরে নিমাই। বড় দরাজ তাঁর মন। সুসময়ে সকলের সঙ্গে ভাগ করে নিয়েছেন নিজের ঐশ্বর্য। আজ সম্মান!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন