ফিজিক্স + রবীন্দ্রসংগীত

এই কম্বিনেশন নিতে পারব না কেন? আমি কী পড়ব, তা কেন নির্ভর করবে জ্যাঠামশাইদের তৈরি সিলেবাসের ধরাকাটের ওপর? বিদেশে ব্যাপার কিন্তু অন্য।প্রথম বর্ষে পাঠশালায় হাজির সাত শিক্ষার্থী। পাখি, বাঁদর, জিরাফ, হাতি, মাছ, কুকুর আর সিংহ। পণ্ডিতমশাই পড়ানোর ক্ষেত্রে কোনও ভেদাভেদ মানেন না। তাই এক বছর ধরে নিরলস পরিশ্রম করে সিলেবাস অনুযায়ী সবাইকে শেখাতে লাগলেনগাছে ওঠা। এক বছর পর রেজাল্ট বেরোলে দেখা গেল, বাঁদর আর পাখি ছাড়া সবাই ডাহা ফেল। তারা মনের দুঃখে জঙ্গলে ফিরে গেল।

Advertisement

অরুণাভ পাত্র

শেষ আপডেট: ১৫ অগস্ট ২০১৪ ০০:০৫
Share:

‘উই ডোন্ট নিড নো এডুকেশন’। পিংক ফ্লয়েড-এর গানের চিত্রায়ণ

প্রথম বর্ষে পাঠশালায় হাজির সাত শিক্ষার্থী। পাখি, বাঁদর, জিরাফ, হাতি, মাছ, কুকুর আর সিংহ। পণ্ডিতমশাই পড়ানোর ক্ষেত্রে কোনও ভেদাভেদ মানেন না। তাই এক বছর ধরে নিরলস পরিশ্রম করে সিলেবাস অনুযায়ী সবাইকে শেখাতে লাগলেনগাছে ওঠা। এক বছর পর রেজাল্ট বেরোলে দেখা গেল, বাঁদর আর পাখি ছাড়া সবাই ডাহা ফেল। তারা মনের দুঃখে জঙ্গলে ফিরে গেল।

Advertisement

আসলে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় ছাত্রছাত্রীদের পছন্দ আর দক্ষতার দাম সব থেকে কম। খাস ব্রিটেনে এক জন ১৩-১৪ বছরের শিক্ষার্থী মোট দশটির মধ্যে সাতটি বিষয় নিজে পছন্দ করে নেয়। বাধ্যতামূলক বিষয় সেখানে তিনটি। অংক, বিজ্ঞান আর ইংরেজি। সময়ের সঙ্গে গত একশো বছরে ব্রিটিশরা নিজেদের শিক্ষাব্যবস্থা আমূল পালটে ফেললেও, আমরা পড়ে আছি মান্ধাতার আমলের অভিভাবকগিরির বোঝা মাথায় নিয়ে। পড়ুয়াদের ইচ্ছেকে গুরুত্ব না দিয়ে, ওপর থেকে ‘আমরা তোমাদের ভাল তোমাদের চেয়ে ভাল বুঝি’ থান ইট চাপিয়ে দেওয়াই যে শিক্ষাব্যবস্থার প্রধান নীতি। ইতিহাসের সঙ্গে বিজ্ঞানও যে কারও সমান ভাল লাগতে পারে, কোয়ান্টাম ফিজিক্স পড়লেও যে রবীন্দ্রসঙ্গীত শেখা সম্ভব, তা ভাবতে নারাজ এই শিক্ষাগার্জেনরা।

অথচ এমনটা হওয়ার কথা ছিল না। স্বাধীনতার পর পরই, শিক্ষাব্যবস্থায় বদল আনা তাঁর অন্যতম অ্যাজেন্ডা বলে জানিয়েছিলেন জওহরলাল নেহরু। ষাট বছর পেরিয়ে গেলেও গুটিকতক আইআইটি-আইআইএম বাদ দিলে আরও কঙ্কালসার হয়েছে ভারতের শিক্ষাব্যবস্থা। ইউনেস্কোর রিপোর্ট অনুযায়ী, শিক্ষার্থীপিছু খরচের নিরিখে সারা পৃথিবীর মধ্যে তলানিতে ভারত। আফ্রিকার দেশগুলিও ভারতের থেকে অনেকটা এগিয়ে। সারা পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে বেশি, প্রায় তেত্রিশ কোটি নিরক্ষর মানুষ বাস করেন ভারতে। এই হাল যে দেশের শিক্ষার, সেখানে ছাত্রছাত্রীর স্বাধীনতা কেড়ে নেওয়াই যে একটা অ্যাজেন্ডা হবে, আশ্চর্য কী?

Advertisement

অথচ উন্নত দেশে স্নাতক স্তরেও ছাত্রছাত্রীদের পছন্দের বিষয়টিকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়। ব্রিটেনে নিজেদের কোর্স নিজেরাই তৈরি করে নেয় পড়ুয়ারা। ধরা যাক, কেউ একই সঙ্গে ইংরেজি ও মনস্তত্ত্ব নিয়ে পড়তে আগ্রহী। এ ক্ষেত্রে কোন বিষয়ের ওপর সে কতটা সময় দিতে পারবে, তা ঠিক করার দায়িত্ব তার নিজের। দুটি বিষয়েই ৫০% করে সময় দিলে সে পাবে জয়েন্ট ডিগ্রি। আর ৭৫% ও ২৫% করে সময় ভাগ করলে সে পাবে ইংরেজিতে মেজর ডিগ্রি। অর্থাৎ মাধ্যমিক স্তরের আগে থেকেই বিষয় বাছার যে স্বাধীনতা সে ভোগ করে, তা জারি থাকে স্নাতক স্তর পেরিয়েও। শুধু তা-ই নয়, পৃথিবীর শীর্ষস্থানীয় প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়েই বিজ্ঞান বিভাগের সঙ্গে নিবিড় যোগাযোগ থাকে সমাজবিজ্ঞান ও কলা বিভাগের। স্নাতক ও স্নাতকোত্তরেও যখন এই মেলবন্ধন বাড়াচ্ছে বাকিরা, আমরা তখন ব্যস্ত প্রাচীর তুলতে। পশ্চিমবঙ্গ উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা সংসদের বিষয় বাছার তালিকা নাড়াচাড়া করলেই বিষয়টা স্পষ্ট হবে। যেখানে স্পষ্ট বলা হচ্ছে, উচ্চমাধ্যমিক স্তরে পদার্থবিদ্যা পড়লে ইতিহাস পড়া যাবে না। স্ট্যাটিসটিক্স নিয়ে উৎসাহ থাকলে দর্শন নিয়ে ভাবনাচিন্তা বন্ধ করে দিতে হবে।

বাকিরা যখন ছাত্রছাত্রীদের চিন্তাশীল হতে শেখাচ্ছে, একই বিষয়ে নানা রকম ভাবে সমস্যা সমাধানের দক্ষতা বাড়ানোর ওপর জোর দিচ্ছে, আমরা তখন যত্ন করে পার্টিশন তুলছি। তাই সাধারণত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এক জন যা শিখছে, তার সঙ্গে আসমান-জমিন ফারাক তৈরি হচ্ছে কর্মজীবনের। যে কারণে সময়ের সঙ্গে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আরও বেশি করে হয়ে দাঁড়াচ্ছে শুধুমাত্র ডিগ্রি জোগাড় করার কারখানা।

এই মুহূর্তে দেশের জনসংখ্যার ৫০%-এরও বেশি মানুষের বয়স পঁচিশের নীচে। ২০২০ সালে ভারতের মানুষের গড় বয়স দাঁড়াবে উনত্রিশ। কৈশোর আর যৌবনের এই অভূতপূর্ব সুনামিকে এই তামাদি হয়ে যাওয়া শিক্ষাব্যবস্থার হাতে ছেড়ে দেওয়া বিপজ্জনক। এই আধমরা শিক্ষাব্যবস্থায় এ বার ছাত্রছাত্রীদের পছন্দকে গুরুত্ব দেওয়ার সময় এসেছে। তাদের মর্জিমাফিক চলতে হবে শিক্ষক-শিক্ষিকা, অভিভাবকদেরও। শিক্ষার্থীদের পছন্দমাফিক নিজেদের তৈরি করবে শিক্ষক সম্প্রদায়।

অযথা অভিভাবকগিরির অজুহাতে ছাত্রছাত্রীদের খিদে মেরে কোনও মহৎ কাজ হচ্ছে না, সেটা পরিষ্কার। নজর দিতে হবে তাদের খিদে বাড়ানোর দিকে। তারা বিজ্ঞান চাইলে বিজ্ঞান, তারা দর্শন পড়তে চাইলে দর্শন, ক্রিকেট চাইলে ক্রিকেট, একই সঙ্গে তিনটে চাইলে তিনটেই পড়ানোর ব্যবস্থা করতে হবে। পদার্থবিদ্যা ও দর্শনের মধ্যে কোথাও কোনও লড়াই নেই, এটা বোঝার সময় এসেছে। লড়াই থাকলে সংস্কৃত শাস্ত্রে পাণ্ডিত্যের পাশাপাশি পদার্থবিদ্যার বাজারে মস্তানি করতে পারতেন না সত্যেন্দ্রনাথ বোস। আইনস্টাইনের সঙ্গে আপেক্ষিকতাবাদ নিয়ে আলোচনায় বসতেন না রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

যার যা ভাল লাগে, তাকে সেটা করার সুযোগ করে দেওয়াই শিক্ষকতা। আসলে বেতন, পরিবার, সিনেমা, মোদী, মনমোহন, আল-কায়দার পাশাপাশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নিয়েও ভাবতে হবে শিক্ষক-শিক্ষিকাদের।

এখানেই মনে পড়ে যাচ্ছে, বর্ধমানের গ্রামে বেতন বাড়ানোর আন্দোলনে নামা পার্ট-টাইম শিক্ষকদের সঙ্গে তাঁদেরই এক সহকর্মীর মতানৈক্যের কথা। মধ্যবয়স্ক সেই পার্ট-টাইম শিক্ষকের সাফ দাবি ছিল, আমি আন্দোলনে নামতেই পারি, কিন্তু এক জন পড়ুয়াও পরীক্ষায় ফেল করলে, তার দায় মাথায় নিয়ে সারা বছরের বেতন ছাড়ার শর্তে রাজি হতে হবে সবাইকে। আন্দোলনের চিৎকারে সেই শিক্ষকের আওয়াজ হারিয়ে গেলেও এটা বোঝার সময় এসেছে, ওই সচেতন উচ্চারণেই বাঁধতে হবে নোঙর।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement
Advertisement