বাংলা গানের দেখা নাই রে

কলকাতার ডিজে-দের প্লে লিস্ট থেকে কেন বাদ পড়ছে বাংলা সিনেমার হিট গান? খোঁজ নিলেন আবীর মুখোপাধ্যায়ফাগুনের রাত্রি হোক অথবা মরসুমের ‘স্যাটার-ডে নাইট’, বছরের পর বছর ধরে কলকাতার নাইট ক্লাবের দাপাদাপিতে ভিনদেশি তারাদের জাদু-সুরের জুড়ি নেই। জানতে ইচ্ছে করে, যে শহর দেশি সুরে দেহজাগানিয়া ক্যাবারে দেখতে দেখতে সাবালক হয়েছে, সেই শহরের ডিস্কে কি ইদানীং বাংলা গান শোনা যায়? ফাগুন হাওয়ার হ্যাংআউটে গিয়ে কি, বাংলা গান শুনতে চায় বং-জেন ওয়াই?

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৪ মার্চ ২০১৪ ০৪:১৪
Share:

মধুমাস মানেই শহরের ডিস্কে বসন্ত উদযাপনের মধুশালা।

Advertisement

দখিনা বাতাসে শহরের উড়ুক্কু মন কেবলই রঙরসিয়ায় মশগুল হওয়ার ছুঁতো খোঁজে।

নাইট ক্লাবের ফ্লোরে গুলশনকুমারের ‘ভল্যুম হাই করলে’র সুরের সঙ্গে এ বসন্তে ‘রঙ্গ বরষে ভিগি চুনরিয়া’র বাজারও তুঙ্গে। এ বারও হিট ‘সিলসিলা’-র এই রেট্রো মিক্স। বাংলা নয়, এই সব গানের তালেই কলকাতার ডিস্কে চলবে রঙবাজি।

Advertisement

ফাগুনের রাত্রি হোক অথবা মরসুমের ‘স্যাটার-ডে নাইট’, বছরের পর বছর ধরে কলকাতার নাইট ক্লাবের দাপাদাপিতে ভিনদেশি তারাদের জাদু-সুরের জুড়ি নেই। জানতে ইচ্ছে করে, যে শহর দেশি সুরে দেহজাগানিয়া ক্যাবারে দেখতে দেখতে সাবালক হয়েছে, সেই শহরের ডিস্কে কি ইদানীং বাংলা গান শোনা যায়? ফাগুন হাওয়ার হ্যাংআউটে গিয়ে কি, বাংলা গান শুনতে চায় বং-জেন ওয়াই?

কথা হচ্ছিল ডিজে ডিটস ওরফে সুদীপ্ত ঘোষের সঙ্গে। শহরের বেশ কয়েকটি অভিজাত নাইটক্লাবে সুরের মায়াজাল বিস্তার করেন ডিটস। বলছিলেন, “যে ভিড়টা থাকে নাইট ক্লাবে, সেটা মিক্সড। তবু সেখানে বাংলা গানের চাহিদা একেবারে যে নেই তেমন নয়। জিৎ গাঙ্গুলি, সমিধ-ঋষি, মিঠুন বা আকাশের গানের চাহিদা রয়েছে। ‘রংবাজ’ আর ‘বস’-এর গান দারুণ হিট ডিস্কে।” ডিটসের অভিজ্ঞতা বলছে, দর্শক চাইলে ঝিলমিল সুরার ছলবলে মধুরাতে কলকাতার ডিস্কে এ বার প্রিয়ঙ্কার ‘মদহোসি’ আইটেম ‘রাম চাহে লীলা চাহে’-র সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাজবে ‘রংবাজ’-এর ‘ও মধু, ও মধু, আই লভ ইউ’ অথবা ‘চ্যালেঞ্জ ২’-এর ‘পুলিশ চোরের প্রেমে পড়েছে’!

তবে সবাই এ কথা বলছেন না। নতুন বাংলা ফিল্মের গানের যে চাহিদা রয়েছে তা সব ডিজেরা মানতে নারাজ। যদিও তাঁরা একমত যে কলকাতার রজনীঠেকে ‘সাধের লাউ’ রিমিক্স খুবই জনপ্রিয়। সুদূর ব্যাংকক, হায়দরাবাদের নাইটক্লাব থেকেও ‘সাধের লাউ’এর রিমিক্সের অনুরোধ উড়ে আসার কথা বলছিলেন ডি জে আকাশ। চলতি মরসুমে শহরের জনপ্রিয় নাইট ক্লাবে ফ্রিল্যান্সের অভিজ্ঞতা থেকে আকাশ জানাচ্ছেন, “ফ্লোরে যে কসমোপলিটান ক্রাউড থাকে, তারা এখন শুনতে চাইছে সানির ‘রাগিণী এমএমএস টু’র ‘বেবি ডল’। প্রিয়ঙ্কার ‘গুণ্ডে’ ছবির ‘তুনে মারি এন্ট্রি’ এবং ‘শাদি কে সাইড এফেক্ট’য়ের ‘হরি ইজ নট আ ব্রহ্মচারী’। এ ছাড়া ‘বস’-এর ‘পার্টি ইন নাইট’ অথবা রণবীরকে ফিচার করে ‘বেশরম’-এর টাইটেল ট্র্যাক এখনও হিট। সঙ্গে রয়েছে ‘ফাটা পোস্টার নিকলা হিরো’-র শহিদ-ইলিনার ‘ধাতিং নাচ’, শাহরুখের ‘লুঙ্গি ডান্স’!”

ডিস্কের দৌড়ে সুরকার জিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘ভজ গৌরাঙ্গ’, পাগলু ডান্স’, ‘পরান যায় জ্বলিয়া’, সঙ্গীত পরিচালক আকাশের ‘তোর নাম’ ছবির ‘কলেজ ক্যাম্পাসে’ বা সমিধের ‘লাভেরিয়া’ ছবির ‘যদিদং হৃদয়ং তব’ থাকলেও, ‘মিশর রহস্য’ বা ‘হনুমান ডট কম’-এর কোনও গান নেই! কেন নেই? কলকাতার ডিস্কে সুরের মৌতাত জমাচ্ছেন যাঁরা, তাঁদের কথায় এটা পরিষ্কার যে, বাঙালি ডিস্ক-মুখো হলেও ‘রিদমিক’ অর্থাৎ ছন্দোময় বাংলা গানেই মেতে থাকতে চান তাঁরা। ক্যামাক স্ট্রিটের অভিজাত এক নাইট ক্লাবের ‘হেড অফ অপারেশন’ রীতেশ শ্রীবাস্তব কথায়, “শ্রোতাদের মুডের ওপর নির্ভর করে পুরোটা। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বলিউড ধামাকার রিমিক্স চায় ডান্স ফ্লোর। সেই তালিকায় কৃষ থ্রি-র ‘রঘু পতি রাঘব’, ইয়ে জওয়ানি হ্যায় দিওয়ানি-র ‘বদতমিজ দিল’, ‘বালম পিচকারি’, খিলাড়ি ৭৮৬-এর ‘হুকা বার’-এর চাহিদা বেশি। ‘রিদমিক’ বাংলা গান কিছু বাজানো হয়। যেমন দেবের গান চায় লোকে। ‘ঢাকের তালে’ বেশ জনপ্রিয়।”

অবশ্য পার্ক স্ট্রিটের সামপ্লেস এলস ব্যতিক্রম। প্রতিমাসে এখানে বাংলা গানের লাইভ অনুষ্ঠান হয় অন্তত একবার হলেও। ক্যাকটাস, লক্ষ্মীছাড়া গান করেছে। এই ফুড স্ট্রিটেই ‘ট্রিঙ্কাস’-এ সন্ধেরাতে রবিঠাকুরের গানও শোনা যায়। এক সময় এখানেই গাইতেন ঊষা উত্থুপ!

শুনতে আসতেন উত্তমকুমার থেকে সত্যজিৎ রায়, এমনকী শর্মিলা-পটৌডিও!

মধুশালায় বসন্তগান

• সানি সানি

• রঙ্গ বরসে ভিগি চুনরিয়া

• বেবি ডল

• তু নে মারি এন্ট্রি

• বলম পিচকারি

কলকাতার নাইট ক্লাবের অভিজ্ঞতার কথা বলছিলেন জিৎ গঙ্গোপাধ্যায়। “পুজোর সময় তখন স্ত্রী চন্দ্রাণীর সঙ্গে কলকাতায় মণ্ডপে শুনতে পেতাম হিন্দি রিমিক্স। এমনকী ডিস্কেও ওই একই গান শুনতে হত! মিস করতাম, ছেলেবেলায় শোনা পঞ্চমদা বা সলিল চৌধুরী! জনতা এসব শুনতে চাইছে যখন, তখন চলো! এই জায়গাটা থেকেই নতুন ধরনের বাংলা গান তৈরির ইচ্ছেটা জন্মাল। ২০০৪-এ ‘ভজ গৌরাঙ্গ’-র মতো গান বাঁধার উৎসাহ তৈরি হল।”

নাইট ক্লাবের হুল্লোড়ে পঞ্জাবি তড়কা ও বলিউডি রিমিক্সের সঙ্গে দিব্য শুনতে পাওয়া যায় জিতের ‘আশিকি-২’-র হুলা-বিলা হিটস, ‘শুন রহা হ্যায় তু’। এটা স্রেফ পত্রিকার গসিপ নয়! অরিজিৎ সিংহকে দিয়ে ‘মন মাঝি রে’ অথবা, ‘বাপি বাড়ি যা’-তে ঊষা উত্থুপকে দিয়ে ‘লেট মি লভ ইউ’ গাইয়েছিলেন জিৎ।

প্রথম দিকের দক্ষিণী সুরের নকল হলেও একটু একটু করে ডিস্কের ডিজে লিস্টে ঢুকে পড়ছেন সঙ্গীত পরিচালক সমিধ-ঋষিরাও। এই তালিকায় যাঁরা নেই, কী বলছেন তাঁরা? এই মুহূর্তের টলিউডের ব্যস্ত সঙ্গীত পরিচালক ইন্দ্রদীপ দাশগুপ্তের উত্তর, “বাংলা একটা পোয়েটিক ল্যাঙ্গোয়েজ। মধুর তার শব্দ লালিত্য। সেই শব্দ দিয়ে পার্টি ক্রাউডের বিট মিউজিক হয় না।”

তার মানে কী সত্যিই বাংলা শব্দে ডিস্কের গান হয় না? জিৎ বললেন, “আমার গান চলছে কী করে? ‘পরান যায় জ্বলিয়া রে’ তো একটা ফোক বেসড গান। সেটাও ডিস্কের ক্রাউড নিয়েছে।”

নাইট ক্লাবে গানে, ভাষাকে গুরুত্ব দিতে চান না গীতিকার-সুরকার অনুপম রায়ও। অনুপম মনে করেন, “ডিস্কের গানে মিউজিক অ্যারেঞ্জমেন্টটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। এমন হবে লয়, যাতে মানুষ নাচতে পারে। এখানে কথার থেকেও বেশি গুরুত্বপূর্ণ গানের সঙ্গে কোন ধরনের যন্ত্র বাজল। এবং তার লয়কারীর ওপরই নির্ভর করে ডিস্কের গানের জনপ্রিয়তা।”

ডিস্কে বাংলা গান বাজুক- এমনটা চান গায়ক অরিজিৎ সিংহ-ও। বললেন, “ডিস্কে বাংলা গান বাজাতে হলে অনেক বেশি ছন্দ চাই। এখনও সেই ফ্লেভারটা আসেনি। হয়তো মেলোডি রয়েছে। কিন্তু অনেক বেশি রিদমিক হতে হবে।”

কবি ও গীতিকার শ্রীজাত-র উত্তরও হল তাই, “প্রশ্নটা গানের কথার নয়, রিদমের।”

রিদমের কারণেই কলকাতার ডান্স ফ্লোরে এই সে দিনও ককটেলের ‘তুম হি হো বন্ধু’, ‘সেকেন্ড হ্যান্ড জওয়ানি’ অথবা ‘লুটনা’-র রিমিক্স জনপ্রিয় ছিল। শহরের হাফ ডজন ডিজে এবং পার্টি হপারদের অভিমত, ‘আর রাজকুমার’-এর ‘শাড়ি কে ফল সা’, ‘গন্দি বাত’, ‘গোরি তেরে পেয়ার মে’-র ‘ধ্যাত তেরি কি’, ‘চ্যালেঞ্জ ২’-এর ‘পুলিশ চোরের প্রেমে পড়েছে’ বা, ‘বুলেট রাজা’-র ‘তমঞ্চে পে ডিস্কো’-র বাজার এখন তুঙ্গে এই রিদমের কারণেই। বিটসের রমরমাতেই বহু বলি হিটসকে পিছনে ফেলে ডিস্কের হুল্লোড়ে এগিয়ে হানি সিংহ!

তবে এটাও ঠিক যে বাংলা ছায়াছবির গান পাল্টাচ্ছে। পাল্টাচ্ছে সময়েরও সমীকরণ। কে বলতে পারে হয়তো বা ডিস্কের জন্য বাংলা গানের সুরকারেরা লিখবেন নতুন স্বরলিপি। এবং ছন্দে ও কথাতেও হয়তো তখন থাকবে জমজমাট নাচের উন্মাদনা!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন