মুম্বই ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির সাম্প্রতিকতম হার্টথ্রব সিদ্ধার্থ মলহোত্র বলছিলেন, “একই ধরনের চরিত্রে অভিনয় করতে গেলে তো বোর হয়ে যাব। তাই নতুন নতুন চরিত্রে অভিনয় করতে চাই সব সময়।”
তিন বছর আগে পরিচালক কর্ণ জোহরের ‘স্টুডেন্ট অব দ্য ইয়ার’ সিনেমা দিয়েই বলিউডে অভিষেক হয়েছিল সিদ্ধার্থর। অনেকে ধরেই নিয়েছিলেন মিষ্টি মুখের, রোম্যান্টিক হিরো হিসেবেই দেখা যাবে তাঁকে। কিন্তু নিন্দুকদের সন্দেহকে তুড়ি মেরে সিদ্ধার্থ তাঁর তুখড় অভিনয়ে সমর্থকদের মন জয় করে নিয়েছেন। নানা রকম চরিত্রে, সংলাপ বলার দক্ষতায় এবং আবেগকে পর্দায় ফুটিয়ে তোলার নৈপুণ্যে সিদ্ধার্থ অনবদ্য। ‘এক ভিলেন’য়ে সিদ্ধার্থ অভিনয় করেছেন এক বদমেজাজি, রাগী মানুষের চরিত্রে। সেই চ্যালেঞ্জটা অবলীলায় গ্রহণ করেছেন তিনি। ইমরান খানের কেরিয়ারগ্রাফের দিকে তাকালেই বুঝতে পারবেন কেন সিদ্ধার্থ চিরন্তন প্রেমিকের রোম্যান্টিক ছাঁদে আটকে না থাকার সিদ্ধান্ত নিয়ে ভাল করেছেন।
আবেগকে পর্দায় ফুটিয়ে তোলার নৈপুণ্যে সিদ্ধার্থ অনবদ্য
সিদ্ধার্থ অবশ্যই ব্যতিক্রমী নন। গত ২-৩ বছরে বলিউডে আসা নতুন অভিনেতারা তাঁদের চরিত্র এবং সিনেমা বেছে নেওয়ার ব্যাপারে যথেষ্ট সাহসী। আর এটা করার পিছনে একটা বড় কারণ যে সৌন্দর্যের বিচারেই হোক বা মূলধারার ছবিতে বিপণনের ক্ষেত্রে, তরতাজা প্রতিভারা বাজারে চলছে ভাল। এই নতুন প্রতিভাদের পর্দায় তরতাজা একটা উপস্থিতি, আর নিত্যনতুন জিনিস নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা করার সাহস কিন্তু দর্শক এঁদের প্রত্যেকটি সিনেমা মুক্তি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে চাক্ষুষ করতে পারেন। এই ফ্রেশ ব্রিগেডের কাছে এমনকী কিছু বছর আগে বলিউডে যাঁরা পা রেখেছেন, সেই রণবীর কপূর, রণবীর সিংহ, অনুষ্কা শর্মা, আদিত্য রায় কপূর, সোনম কপূর, দীপিকা পাড়ুকোন বা ইমরান খান-দেরও কলেজের সিনিয়র মনে হয় যেন।
আলিয়া ভট্ট কথাপ্রসঙ্গে বলছিলেন রণবীর কপূর বা রণবীর সিংহদের মতো সিনিয়র অ্যাক্টরের সঙ্গে অবশ্যই অভিনয় করতে চাইবেন। ইমতিয়াজ আলির ‘হাইওয়ে’তে আলিয়ার অভিনয় দর্শকদের চমকে দিয়েছে। ‘স্টুডেন্ট অব দ্য ইয়ার’য়ে ও রকম একটা ক্যান্ডি ফ্লস ডেব্যুর পর কেউ কি ভাবতে পেরেছিলেন, আলিয়া তাঁর কেরিয়ারের শুরুতেই এমন দুর্দান্ত অভিনয় করবেন। “আমি সব ধরনের চরিত্র করতে চাই। ‘টু স্টেটস’ করার সময়ও আমি চরিত্রটাকে খুব ভাল করে স্টাডি করেছিলাম যাতে মনে না হয় অভিনয় করছি। চরিত্রটি এক দক্ষিণী মেয়ের হলেও তার বেড়ে ওঠাটা যথেষ্ট কসমোপলিটান ধাঁচের। আর মেয়েটি দারুণ নাচে। অর্জুন-আলিয়া অভিনীত ‘টু স্টেটস’ শুধু বক্স অফিসে বিরাট ব্যবসা করেছে তা-ই নয়। ওঁদের সমর্থক সংখ্যাও প্রচুর বাড়িয়ে দিয়েছে।
তবে শুধু আলিয়াই নন, নতুন ধারার এই বলিউড প্রতিভারা সকলেই প্রায় ফিল্ম স্কুল বা অ্যাক্টিং ক্লাস অ্যাটেন্ড করার দলে। এই পেশার মক্কা বলা উচিত যে ‘লি স্ট্র্যাসবুর্গ’ অ্যাক্টিং স্কুলকে, রণবীর কপূর সেখানকার ছাত্র। অন্য দিকে আলিয়া-অর্জুন, মোহিত মাড়ওয়া (অনিল কপূরের এই ভাইপো-ও লি স্ট্র্যাসবুর্গ-য়ে যেতেন) পত্রলেখারা এই পেশার স্থানীয় অভিজ্ঞদের থেকে পাঠ নিয়েছেন। কোন অভিনেতা কোন ফিল্মি পরিবার থেকে আসছেন, তা নিয়ে ১৮-৩৫ বছরের মাল্টিপ্লেক্সে সিনেমা দেখতে যাওয়া দর্শকদের কোনও মাথাব্যথা নেই। তাঁরা অন্য ধরনের সিনেমা দেখতেই বেশি পছন্দ করেন। শাহরুখ-সলমনরা যে ‘রাহুল’, ‘রাজ’, ‘প্রেম’-এর মতো চরিত্রদের অমর করে গিয়েছেন, সেই চরিত্ররা এই দর্শকদের কাছে মৃতই বলা যায়।
কেউ কি ভেবেছিলেন, আলিয়া এমন দুর্দান্ত অভিনয় করবেন!
নিত্যনতুন চ্যালেঞ্জ নিতে পিছপা নন নামী অভিনেত্রীরাও। ‘এক ভিলেন’য়ের পর শ্রদ্ধা কপূরকে দেখা যাবে বিশাল ভরদ্বাজের ছবি ‘হায়দার’য়ে। এক ডি-গ্ল্যাম চরিত্রে। আলিয়া অভিনয় করবেন পরিচালক বিকাশ বহেলের পরের ছবি ‘শান্দার’য়ে। তাঁর আগের নারীকেন্দ্রিক ছবি ‘কুইন’ অসাধারণ সাফল্য পেয়েছিল বক্স অফিসে। এঁদের পছন্দের সঙ্গে পরিণীতি চোপড়া, সোনাক্ষী সিংহ বা অনুষ্কা শর্মাদের পছন্দের তুলনা করে দেখুন। ২৫-এর নীচে থাকা সুন্দরীরা খুব সহজেই দর্শকের কৌতূহল নিজেদের দিকে টেনে রাখতে পারেন। ওঁদের ছবির বাছাইগুলোও লক্ষ করার মতো। এঁরা নিজেরাই বক্স অফিসের দায়িত্ব নিজেদের কাঁধে বইতে পারেন। আলিয়া ভট্ট, শ্রদ্ধা কপূর ইতিমধ্যেই এ বিষয়ে তাঁদের ক্ষমতা প্রমাণ করে দিয়েছেন। অভিনয় দক্ষতার সঙ্গে বাণিজ্যিকরণ বিষয়টা আয়ত্ত করতে যদিও দীপিকা বা সোনমদের পাঁচ বছর কেটে গিয়েছে।
এখনকার দর্শকদের কাছে অভিনয় দক্ষতা বা একটা ভাল চিত্রনাট্যই কিন্তু সব নয়। একজন নতুন অভিনেতার তরতাজা ভাবও কিন্তু বক্স অফিসে জাদু করার ক্ষমতা রাখে। ২০১৪-তে সিনেমাব্যবসার একটা খতিয়ান দেখলেই বিষয়টা পরিষ্কার হয়ে যাবে। ‘হিরোপন্তি’, ‘হসি তো ফসি’, ‘রাগিণী এমএমএস’ ছবিগুলো বক্স অফিসে বেশ ভাল ব্যবসা করেছে। অথচ ‘টু স্টেটস’ ছবিটি যে শুধু একশো কোটির বেশি ব্যবসা করেছে তা-ই নয়, অর্জুন কপূর-আলিয়া ভট্টকে ভবিষ্যৎ তারকার মর্যাদাও দিয়েছে। এখনও রমরমিয়ে ব্যবসা করছে ছবিটি। সলমন খানের ‘জয় হো’ ছবিটিও মোটামুটি ১০০ কোটির ব্যবসা করেছে। এর পর বলতেই হয় মেয়েদের কেন্দ্র করে তৈরি ‘হাইওয়ে’ বা ‘কুইন’ ছবির কথা। সিনেমা বিতরণের সঙ্গে যারা যুক্ত, বা ছবির প্রদর্শকরাও এই ছবিগুলোর দিকে নজর রাখতে বাধ্য হয়েছেন।
বক্স অফিসে যথেষ্ট সফল। এঁদের নেওয়ার খরচও যথেষ্ট কম
প্রতিষ্ঠিত ফিল্ম প্রযোজক বা লগ্নিকারীদের নতুন এই সব প্রতিভাদের নেওয়ার পিছনে অন্যান্য কারণও রয়েছে। প্রফিট শেয়ারিং মডেলের ভিত্তিতে দেখতে গেলে একজন স্টারের উপর লগ্নির খরচ বিশাল। শুধু কোটি টাকার ফি-ই নয়, সেই স্টারের সঙ্গে ঘুরে বেড়ানো লোকলস্করের খরচের বহরও দেখার মতো। এত খরচ মেটাতে গিয়ে সিনেমার গুণমানে যথেষ্ট কোপ পড়ে যায়। স্টারবাজি করার চাইতে তাই ছবির প্রযোজকরা নতুন প্রতিভাদের উপর বাজি ধরাটাই বেশি নিরাপদ মনে করছেন। ছবি যদি না-ও চলে, তাতেও বড়সড় ক্ষতির দায়টা অন্তত থাকে না। “আমরা দেখছি অল্পবয়সি অভিনেতাদের নিয়ে তৈরি সিনেমাগুলো বক্স অফিসে যথেষ্ট ভাল করছে। নতুন এই অভিনেতাদের নেওয়ার খরচও যথেষ্ট কম। আমার নিজের প্রযোজনা সংস্থা থাকায় অবশ্যই চাইব এদের নিয়ে কাজ করতে,” বললেন সইফ আলি খান। তাঁর ব্যানার ইলিউমিনাটি ফিল্মস সম্প্রতি অভিনেতা বরুণ ধবনকে সই করিয়েছে তাঁদের পরবর্তী ছবির জন্য। “এই বছর ছবির সাফল্যের তালিকা যদি দেখে থাকেন, দেখবেন সাফল্যের হার মোটে ১০ শতাংশ। একটা পরিপূর্ণ ইন্ডাস্ট— কাজ বেছে নেওয়ার ব্যাপারে যথেষ্ট চুজি হয়ে গিয়েছেন। শুধুমাত্র নামীদামি পরিচালক এবং পয়সাওলা প্রযোজকদের সঙ্গেই এঁরা কাজ করতে ইচ্ছুক। নতুনদের ছবিতে নেওয়ার পিছনে এ-ও এক বড় কারণ।
কিছু দিনের মধ্যেই কমল হাসন-সারিকার দ্বিতীয় কন্যা অক্ষরার বলিউড-অভিষেক হবে ‘শমিতাভ’ দিয়ে। আর বাল্কি পরিচালিত এই ছবিতে তাঁর সঙ্গে থাকবেন ধনুষ ও অমিতাভ বচ্চনও। নিখিল আডবাণীর ছবি ‘হিরো’তে ডেব্যু করতে দেখা যাবে সুরয পাঞ্চোলি-আতিয়া শেট্টিকে। এতেই শেষ নয়। আরও অনেক নতুন প্রতিভা উইংসের আড়ালে অপেক্ষা করে আছেন বড় পর্দায় মুখ দেখাবেন বলে। ছোট্ট প্রজেক্ট হলেও কোনও অসুবিধে নেই। নিজের একটা ছাপ ফেলে যেতে এই ছোট প্রজেক্টগুলোও নামীদামি স্টুডিয়ো বা প্রযোজক সংস্থাগুলোর কাছে গর্বের বিষয়। এর ভাল দিক হল অসংখ্য তারকা এবং অভিনেতা-অভিনেত্রীদের মধ্যে থেকে দর্শকরা এখন বেছে নিতে পারবেন তাঁদের পছন্দের জনকে।