সেপ্টেম্বর মাসের ঘটনা। আমরা জুহুতে ‘পিকু’ ছবির শ্যুটিং করছি। সেটে রয়েছে ইরফান খান, দীপিকা পাড়ুকোন এবং তিনি। সকাল থেকে ক্যামেরাম্যানের সঙ্গে মিটিং করে শটটা প্ল্যান করেছি। টাইম মতো শ্যুটিং শুরু।
হঠাত্ শটের মাঝখানে দেখি উনি দীপিকাকে বলছেন, “দীপিকা ডু ইউ নো দিস অ্যাক্টর কলড্ রবি ঘোষ?”
প্রশ্নটা করে উনি ইরফানের দিকেও তাকালেন। দীপিকা, ইরফান কেউই রবি ঘোষকে চিনতেন না। তার পর বলতে শুরু করলেন, ভারতবর্ষে রবি ঘোষের থেকে বড় কমিক টাইমিং আর কোনও অ্যাক্টরের না কোনও দিন হয়েছে, না কোনও দিন হবে। যখন বলছেন তখন আমি, ক্যামেরাম্যান, দীপিকা, ইরফান শুধু হাঁ করে ওঁকে দেখছি আর কথাগুলো শুনছি।
আমি তো জানতামই না উনি এত সূক্ষ্মতার সঙ্গে রবি ঘোষের অভিনয় দেখেছেন। শুনতে শুনতে সে দিন ভাবছিলাম, এত ডিটেলে রবি ঘোষকে অ্যানালাইজ করা বোধহয় শুধু ওঁর পক্ষেই সম্ভব।
এই হচ্ছেন অমিতাভ বচ্চন। প্রতি মুহূর্তে আপনাকে উনি নিজের অভিনয় দিয়ে, চিন্তাধারা দিয়ে, ডিপ আন্ডারস্ট্যান্ডিং অফ ইমোশন দিয়ে চমকে দেবেন।
আমার কাছে উনি ভগবান।
আমার ‘স্যর’।
তুই আমাকে বাঙালি বানিয়ে ছাড়বি
ওঁকে বেশ কিছু বছর ধরে কাছ থেকে দেখছি। বিজ্ঞাপনের শ্যুটিং দিয়ে শুরু। তার পর ‘শ্যুবাইট’, এখন ‘পিকু’— একটা ব্যাপার ওঁকে দেখলেই মনে হয় আজকাল—যত বয়স বাড়ছে, উনি যেন তত ভাল অভিনেতা হয়ে উঠছেন।
আমাকে হয়তো উনি খুব বেশি স্নেহ করেন তাই আমার কাছে উনি ওপেন আপও করেন অনেকটা। কিন্তু জীবনের সূক্ষ্ম আবেগ কী ভাবে অভিনয়ে ইনকরপোরেট করা যায় সেটা ওঁর থেকে ভাল বোধহয় কেউ জানেন না।
‘পিকু’র শ্যুটিং যখন করছি তখন সেই ফিল্মের আর একটা ঘটনার কথা বলি।
এই ছবিতে উনি এক বাঙালিবাবুর চরিত্র করছেন। সেটে ঢুকে প্রায় রোজই আমাকে উনি বলেন, “সুজিত, তুই আমাকে বাঙালি বানিয়ে ছাড়বি।”
এবং শ্যুটিংয়ের ফাঁকে ফাঁকেই উনি কলকাতার কথা বলেন। বুঝতে পারি না একটা মানুষের কী ভাবে এই রকম ফোটোগ্রাফিক মেমরি হয়!
বলেন কলকাতার সেই সময়কার মানুষজনের কথা। ওই যে ক্লাব কালচারটা কলকাতায় আছে, তা যে আর ভারতবর্ষের কোথাও নেই সেটাও বলেন প্রায়ই।
কোনও অভিনেতা পরিচালকের সামনে ওইরকম সারেন্ডার করে না
ওঁর সঙ্গে আমার প্রথম আলাপ ক্যাডবেরির একটা বিজ্ঞাপন করার সময়। উনি আমার প্রথম ছবি ‘ইয়াঁহা’ তখনও দেখেননি। কিন্তু জয়াদি দেখেছিলেন। জয়াদি ওঁকে আমার ব্যাপারে বলেন। তার পর তো প্রথম মিটিং অনেক ক্ষণ ধরে হয়। ধীরে ধীরে একটার পর একটা বিজ্ঞাপন করি একসঙ্গে। ক্যাডবেরি হোক কী পালস পোলিও কী ভাইব্র্যান্ট গুজরাত। ভাইব্রান্ট গুজরাতের শ্যুটিংয়ে তো আমরা গুজরাতের প্রায় সর্বত্র শ্যুটিং করেছি রান অব কচ্ছ, গির ফরেস্ট কিছু বাদ দিইনি।
এ সব শ্যুটিংয়ের মাঝখানে আমাদের কত রকম আড্ডা হয়েছে তা বলে বোঝাতে পারব না।
ইংরেজিতে একটা কথা আছে না, ‘পিকিং দ্য ব্রেন’ আমি কিন্তু স্যরের সঙ্গে এগজ্যাক্টলি তাই করি।
‘শক্তি’র ক্লাইম্যাক্সের শ্যুটিংয়ের আগে ওঁর মনের অবস্থা কী ছিল, ‘দিওয়ার’-এর ওই সব হাই ইনটেনসিটি সিনগুলোর আগে ওঁর পড়াশোনা কী ছিল ওঁর কাছে প্রশ্নের কোনও সীমা নেই আমার।
বহু দিন জানতে চেয়েছি বাণিজ্যিক হিন্দি ছবির অন্যতম সেরা পরিচালক মনমোহন দেশাই মানুষটা কেমন ছিলেন। এবং আমি ধন্য আমার প্রত্যেকটা প্রশ্নের উনি ধীরস্থির ভাবে জবাব দিয়েছেন। এগুলো আমার জীবনের সেরা উপলব্ধি তো বটেই।
তবে এত আলোচনার পর এটাও বুঝেছি, অমিতাভ বচ্চন ইজ আ কমপ্লিটলি ডিরেক্টরস অ্যাক্টর।
আমি কোনও অভিনেতাকে ডিরেক্টরের সামনে এই রকম সারেন্ডার করতে দেখিনি।
প্রমিস করছি আমি বেশি সময় নেব না
এখনও অনেক বার হয় ওঁর এই সারেন্ডার। হয়তো আমি একটা শট নিলাম, শটটা হয়তো ৯০% ঠিকই আছে। কিন্তু কোথাও হয়তো আমার একটু পজ দরকার ছিল, কোথাও চোখটা তুললে হয়তো সিনটা আরও ভাল হত। সেটা আমি ওঁকে ক্যাজুয়ালি বললেও ততক্ষণে হয়তো সেই শট আমি ‘ওকে’ করে দিয়েছি।
এর মধ্যে লাঞ্চব্রেকও ঘোষণা হয়ে গিয়েছে। দেখেছি তিন চার ঘণ্টা বাদে উনি আমাকে ঠিক ডাকবেন।
ডেকে বলবেন, “সুজিত তুমি শটটা ওকে করে দিয়েছ ঠিকই কিন্তু তুমি যে অবজার্ভেশনগুলো বললে সেগুলো আমি ভেবে দেখলাম একদম ঠিক। আমরা ওই শটটা কি আর এক বার করতে পারি? প্রমিস করছি আমি বেশি সময় নেব না।” এই ডেডিকেশনের নামই অমিতাভ বচ্চন।
রাতে ফোন এনগেজ মানেই জানবেন স্যর ফোন করেছেন
পরিচালকের শট মনঃপূত না হওয়া অবধি ‘স্যর’কে আপনি সেট থেকে বের করতে পারবেন না। এবং সেটা কিন্তু উনি দিনের দিনই করবেন এমনটা নয়।
আজও রাত বারোটা থেকে একটার মধ্যে ফোন বাজলে বুঝেছি ‘স্যর’ ফোন করেছেন। ইনফ্যাক্ট আমার বন্ধুবান্ধব কী পরিবার জানে ওই সময় আমার ফোন এনগেজ থাকা মানে ‘স্যর’য়ের সঙ্গে কথা চলছে। কোন সিনটা কেমন হল, কোন সিনটা আর একটু বেটার করা যায় এটা হয়তো উনি সেটে সব সময় বলেন না।
কিন্তু রাতে বাড়ি ফিরে শুয়ে শুয়ে সেগুলো ভাবেন আর তার পর ফোন করে ইনপুটস দেন। কত বার হয়েছে রাতে উনি বলছেন, “সুজিত, আজকের ওই শটটা কালকে আর একবার করতে দেবে আমায়? আমি তাড়াতাড়ি পৌছে যাব।”
এ রকম করে যে কোনও অভিনেতা বললেই পরিচালক তাঁকে সেটা আবার করতে দেবেই আর এখানে তো অভিনেতার নাম স্বয়ং অমিতাভ বচ্চন।
কলকাতায় ওঁকে শুক্তো, চচ্চড়ি আর ধোকার ডালনা খাওয়াতেই হবে
নভেম্বরে কলকাতায় আসছি ওঁকে নিয়ে। সেই শ্যুটিং নিয়ে ওঁর এক্সাইটমেন্টও কিছু কম নয়। কলকাতায় আউটডোর শুনে উনি বলে রেখেছেন ওঁকে নানা রকম ভেজিটেরিয়ান বাঙালি খাবার আমাকে খাওয়াতেই হবে। শুক্তো, পালংশাকের চচ্চড়ি থেকে ধোকার ডালনা—ওঁর লিস্ট রেডি।
এমনিতে উনি একদম সিম্পল খান। দু’টো রুটি, একটু ডাল, একটা সব্জি, দই আর স্যালাড। ব্যস।
ভাত একেবারে ছেড়ে দিয়েছেন। তবে যেটা ছাড়তে ওঁর কষ্ট হয়েছে সেটা হল মিষ্টি। “আরে, আমি তোমাদের সবার থেকে বেশি মিষ্টি খেতাম। দিনের যে কোনও সময় মিষ্টি দিলে আমি না করতে পারতাম না। মিষ্টি ছাড়াটা আমার জীবনের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল। কিন্তু এই বয়সে মিষ্টি খেলে শরীর খারাপ হবেই, তাই ছেড়ে দিয়েছি। তাও যখন তোমরা মিষ্টি খাও আমার অসম্ভব কষ্ট হয়,” সেটে আড্ডা মারতে মারতে প্রায়ই কথাগুলো বলেন।
তবে মিষ্টির একটা ‘সাবস্টিটিউট’ উনি খুঁজে পেয়েছেন। মধু। মাঝেমধ্যে খাওয়ার পর উনি মধু খান দেখেছি।
কোনও ভ্যালু নেই দেখছি আমার
তাও সেটের মধ্যে তো নানা খাবার আসতেই থাকে। হয়তো কখনও বিস্কুট এলো। কখনও ড্রাই ফ্রুটস। তখন দেখেছি উনি বাচ্চাদের মতো আমাদের কাছে চলে আসেন। “এই তোমরা কী খাচ্ছ দেখি,” বলে হয়তো একটু বাদাম খেলেন। প্রোডাকশনের ছেলেদের মজা করে বললেন, “ওদের জন্য ভাল খাবার আনছ আর আমাকে এক বারও বলছ না! কোনও ভ্যালু নেই আমার দেখছি সেটে!”
যখন উনি এসব বলেন তখন সবাই হেসে কুটোপুটি। উনি সেটে থাকলে বাকিদের এনার্জি লেভেলটাই অন্যরকম থাকে।
সেদিন ওঁর বাড়ির সামনেই শ্যুটিং করছিলাম। সকাল থেকে দেখি উনি দারুণ মুডে। লাঞ্চ ব্রেকে জিজ্ঞেস করলাম, “কী ব্যাপার, স্যর?”
আমার দিকে তাকিয়ে হাসলেন। বললেন, ওঁর খুশির কারণ হল শ্যুটিং প্যাক আপের পাঁচ মিনিটের মধ্যে উনি নাতনি আরাধ্যার কাছে ফিরে যেতে পারবেন, এটা ভেবেই নাকি উনি সকাল থেকে এত খুশি। এই সরলতার নামই অমিতাভ বচ্চন।
বহু মানুষের মতো আমার কাছেও অমিতাভ বচ্চন মানে ভগবান। ওঁর বহু অন্ধ ভক্তের মতো আমিও মনে করি আমি ওঁর ‘বিগেস্ট ফ্যান’।
জানেন, আমার আগের ছবিগুলো, ‘ভিকি ডোনার’ এবং ‘ম্যাড্রাস ক্যাফে’ দেখে উনি আমাকে হাতে লেখা কয়েকটা চিঠি লিখেছিলেন। সেগুলো আমি আমার অফিসে টাঙিয়ে রেখেছি। আমার কাছে ওর থেকে বড় সার্টিফিকেট আর কিছু হতে পারে না জীবনে।
এবং এত দিন ওঁর সঙ্গে কাজ করে বুঝেছি, কাজ ছেড়ে উনি থাকতে পারবেন না। আমার তো মনে হয়, কাজ না করলেই ওঁর শরীর খারাপ হয়।
ওঁকে জীবনীশক্তি জোগায় স্টুডিয়োর ফ্লোরগুলো... ওই হইহট্টগোল... ওই ধুলো... ওই চেয়ার ওই চায়ের কাপগুলো। আর ওঁকে অক্সিজেন জোগায় ক্যামেরাটা।
ভগবানের কাছে একটাই প্রার্থনা করি। ওঁর যেন শরীর ভাল থাকে আর বহু বছর যেন রাতে আমার বন্ধু-বান্ধব আমার ফোনটা এনগেজ্ড পায়।
অত রাতে ওই ভারী গলাতে ‘হ্যালো সুজিত’ আরও বহু বছর ধরে আমি শুনতে পাই।
সেই সময় যে উনি ফোন করেন।
আমার ‘স্যর’।