১০০+৬৬= বহুরূপী ২০১৪

একশো’য় শম্ভু মিত্র। তাঁর হাতে তৈরি দল ছেষট্টি। দুইয়েরই স্মরণ ‘বহুরূপী’র নাট্যোৎসবে। লিখছেন দেবশঙ্কর মুখোপাধ্যায়একশো’য় শম্ভু মিত্র। তাঁর হাতে তৈরি দল ছেষট্টি। দুইয়েরই স্মরণ ‘বহুরূপী’র নাট্যোৎসবে। লিখছেন দেবশঙ্কর মুখোপাধ্যায়

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৮ এপ্রিল ২০১৪ ২২:০৩
Share:

বহুরূপী-র নতুন নাটক ‘মুখোশের মুখ’য়ের মহড়া। ছবি: সুব্রত কুমার মণ্ডল

রবীন্দ্রনাথ কি কোনও দিন জেলখানায় বন্দি ছিলেন? নইলে বন্দিদের মনের এত কথা উনি জানলেন কী করে!

Advertisement

তাঁর ‘রক্তকরবী’ নাটকের গল্প শুনে এমনই প্রশ্ন করেছিলেন বহরমপুরের এক কারাবন্দি। ২০১২-র বাংলা ছবি ‘মুক্তধারা’র নায়ক নাইজেল আকারার মতো সে’ও তখন ‘লাইফার’।

আর এই ঘটনার বছর কয়েকের মধ্যে তাকেও অভিনয় করতে দেখা যায় ‘রক্তকরবী’ অবলম্বনে তৈরি ‘যক্ষপুরী’ নাটকে। বহরমপুর সংশোধনাগারের কারাবন্দিদের এই নাটক এ বার কলকাতাও দেখতে চলেছে ‘বহুরূপী’ নাট্যদলের ৬৬ বছর পূর্তির নাট্যোৎসবে। যার শুরু ১ মে। ৬টি নাটকের এই উৎসব চলবে টানা ৪ মে অবধি। অ্যাকাডেমিতে।

Advertisement

কিন্তু ‘রক্তকরবী’ তো এক অত্যাচারী রাজার কাহিনি। যে প্রকৃতি ধ্বংস করে। লোকলস্কর নিয়ে প্রজাদের ওপর অত্যাচার চালায়। প্রেমিক রঞ্জনের কাছ থেকে ছিনিয়ে আনে তার প্রেমিকা নন্দিনীকে। সেখানে কারাগার কোথায়?

“এটা নতুন প্রেক্ষাপটে তৈরি রক্তকরবী। বিডি শর্মা যখন আইজি-প্রিজন, আমাদের বলেন জেলে বন্দিদের নিয়ে কিছু করতে। তখন ‘থিয়েটার থেরাপি’ কথাটা মাথায় আসে। অভিনয় করিয়ে কারাবন্দিদের যদি কিছু ভাল করা যায়। ওখানে যাই, দেখি একটা তাসের দেশ যেন! প্রাণের স্পন্দন নেই। অত্যাচারে, হতাশায় বন্দিরা সব যন্ত্র বনে গেছে। রবীন্দ্রনাথের নাটকও তো তাই। কয়েদখানা সেখানে আস্ত একটা রাজ্য,” বলছিলেন যক্ষপুরী-র পরিচালক প্রদীপ ভট্টাচার্য। শোনা গেল, থিয়েটার করে এক সময়ের যাবজ্জীবন কারাদণ্ডর বন্দিরা মূলস্রোতে ফিরছে। ছাড়া পেয়ে তাঁদের কেউ আর অন্ধকার জগতের দিকে ঘুরেও তাকাচ্ছে না।

১০ মে, ১৯৫৪-য় বহুরূপী যখন প্রথম বারের জন্য ‘রক্তকরবী’ মঞ্চে আনে, নির্দেশক ছিলেন শম্ভু মিত্র। তখন ওঁর বয়স মাত্র ৪০। ২২ অগস্ট তিনি শতবর্ষে পড়ছেন। নাট্যোৎসবে তাই দলের জন্মদিন পালনের সঙ্গে সূচনা হচ্ছে তার প্রতিষ্ঠাতার একশো বছর উদ্যাপনও। উৎসব জুড়ে থাকছে শম্ভু মিত্রর বিরল ছবির দুর্লভ প্রদর্শনী।

“শুধু প্রদর্শনী নয়, উৎসবে অন্য দলের নাটক বাছার ক্ষেত্রেও শম্ভু মিত্রের ছায়া। যে নাটকগুলোর সঙ্গে ওঁর নাম জড়িয়ে, তার দুটি এখানে থাকছে। ‘রক্তকরবী’ তো আছেই, ‘রাজা অয়দিপাউস’ও,” জানালেন বহুরূপী-র সম্পাদক সুশান্ত দাস।

সোফোক্লেসের ‘রাজা অয়দিপাউস’ নাটকটি ‘ইদিপাস’ নামে তৈরি করেছে ‘এবং আমরা (বর্ধমান)’।

জেলবন্দিদের নিয়ে থিয়েটার যদি ‘যক্ষপুরী’-র বক্সঅফিস হয়, ‘এবং আমরা’-র ‘ইউএসপি’ তবে তাদের ‘থিয়েটার ভিলেজ’-এর নাটক।

থিয়েটার ভিলেজ? হ্যাঁ, বীরভূম-বর্ধমান সীমানায় অজয়ের পাড়ে লালমাটির দেশ সাতকাহানিয়া। তারই প্রায় ৪ একর জমিতে গড়ে উঠেছে এই ‘ভিলেজ’। নাম ‘তেপান্তর’। অনেকটা ‘ইকো ট্যুরিজম’-এর ধাঁচে। আদিবাসী আর স্থানীয়দের অনেকে মিলে সারা বছর এখানে দল বেঁধে থাকেন। চাষবাসের সঙ্গে নিয়মিত থিয়েটারও করেন। ‘ইদিপাস’ তাঁদেরই তৈরি।

গ্রিক পৌরাণিক চরিত্র ইদিপাস। তার বাবা লাইউস। মা জোকাস্টা। ওঁরা থীবসের রাজা আর রানি। ডেলফির দেবতার কাছে রাজা জানতে পারেন তাঁর সদ্যোজাত ছেলে এক দিন তাঁকেই হত্যা করবে। আর বিয়ে করবে মা-কে। মূল কাহিনির এই আদলটা প্রায় এক রেখে তার মধ্যে স্থানীয় সুর বুনে দিয়ে নাটকে অনেকটা সাতকাহানিয়ার গল্প বলেছেন নির্দেশক কল্লোল ভট্টাচার্য।

নাট্যোৎসব শুরু হচ্ছে বহুরূপী-রই নতুন নাটক দিয়ে। ‘মুখোশের মুখ’। যার আবার মূল স্বরটা ধরা পড়ে মার্টিন লুথার কিং (জুনিয়র)-এর পৃথিবী বিখ্যাত সেই উক্তিতে। লুথার বলেছিলেন, “পরোপকার করতে গিয়ে খেয়াল রাখবেন, ঠিক কী ধরনের অন্যায় ও অবিচারের কারণে তাঁদের আজ পরোপকার করতে হচ্ছে।”

অরূপশঙ্কর মৈত্রর লেখা এই কাহিনিটি ওড়িশার ফুন্ডিংলার। ঝাড়খন্ড সীমানায়, পাহাড়-জঙ্গল ঘেরা ছোট্ট শহর। চার পাশে ছোট ছোট আদিবাসী গ্রাম। খাদান, খনি, টিলা। তার মাঝেই এক বহুজাতিক খনি সংস্থার কমপ্লেক্স। শপিং মল, একটা ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল। খাদানে কাজ করে স্থানীয় আদিবাসীরা। তাঁদের বাচ্চারাও।

কমপ্লেক্সে ‘লেডিজ ক্লাব’-এর সেক্রেটারি মুনমুন। মুনমুন লক্ষ করে এই সব আদিবাসীর মুখে লজ্জা, দুঃখ, অভিমান, বেদনা, এমনকী রাগও নেই। সবাই যেন মুখোশ পরে বসে আছে। তাদের বাচ্চাদের পড়াশোনার জন্য সরকারি আর্থিক সাহায্য আসে। তাতেও তারা স্কুলে যায় না। খাদানেই পড়ে থাকে। মুনমুন ক্লাবে প্রস্তাব দেয়, ওই বাচ্চাদের জন্য স্কুল খোলা হোক। এর পরই তৈরি হয় নিস্তরঙ্গ সময়ের ঝোড়ো বাঁক। তখনই মুখোশগুলো ছিঁড়ে গিয়ে বেরিয়ে আসে সত্যিকারের মুখ। কোন সে মুখ? কীসের অভিব্যক্তি সেখানে? ঘৃণা? ক্রোধ? না কি ভয়? নির্দেশনায় দেবেশ রায়চৌধুরী।

এই তিনটি ছাড়া উৎসবে আর থাকছে বহুরূপী-রই পুরনো তিনটি নাটক। ‘ছাঁচ ভাঙা মূর্তি’, ‘রাজার খোঁজে’, ‘ফুল্লকেতুর পালা’।

কবিপক্ষের দরজায় দাঁড়িয়ে পিতৃপক্ষের আয়োজন আপাতত এই রকমই।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন