নকল চামড়ার শিরা-ধমনী দিয়ে ছুটবে গরম রক্ত। ফাইল চিত্র।
ছুঁলে শিহরণ জাগবে। তাতে ব্যথাবেদনা, ঠান্ডা-গরমের অনুভূতি থাকবে ষোলোআনা। সে চামড়ায় গজাবে রোম, শিরায় শিরায় ছুটবে গরম রক্ত। অনুভূতি পেতে তাতে থাকবে স্নায়ুর জালও। এমনই চামড়া তৈরি হচ্ছে গবেষণাগারেই। শুনলে অবাক লাগলেও, সত্যি। ঠিক মানুষের মতোই ত্বক তৈরি করে ফেলেছেন গবেষকেরা! বিশ্বের প্রথম কৃত্রিম ত্বক তৈরির কৃতিত্ব অস্ট্রেলিয়ার কুইন্সল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকদের।
শ্বাস নেবে কৃত্রিম চামড়া, ট্যানও পড়বে
কৃত্রিম চামড়া তৈরির গবেষণা নতুন নতুন নয়। টেকনিক্যাল ইউনিভার্সিটি অব মিউনিখের একদল গবেষক রোবটের শরীরে মানুষের মতো চামড়া বসানোর চেষ্টায় ছিলেন অনেক আগেই। তা নিয়ে গবেষণাও চলছিল। গবেষকেরা জানিয়েছিলেন, মানুষের মতো অনুভূতি পেতে হলে ধাতব ত্বক নয় বরং সেন্সর-যুক্ত কোষ দরকার, যাতে থাকবে কৃত্রিম স্নায়ুতন্ত্র। সেন্সরই বয়ে নিয়ে যাবে সঙ্কেত। যন্ত্রমানবকে মানুষের মতো অনুভূতি দিতে কৃত্রিম ত্বক তৈরির চেষ্টা শুরু হয়েছিল আগেই। তবে সে ছিল রোবটের জন্য কৃত্রিম ত্বক তৈরির প্রক্রিয়া। আর কুইন্সল্যান্ডের বিজ্ঞানীরা মানুষের শরীরে বসানোর জন্য কৃত্রিম ত্বক তৈরির চেষ্টা করছেন, যাতে অবিকল আসল ত্বকের মতোই রক্তজালিকা, রক্তনালি, ঘর্মগ্রন্থি— সবই থাকবে। রোদে বেরোলে সে ত্বকে দাগছোপও পড়বে। গরমে দরদর করে ঘাম হবে। আঘাত লাগলে ব্যথাও হবে। রক্তস্রোত বইবে শিরা-ধমনী দিয়ে।
কৃত্রিম চামড়া তৈরি করেছেন বিজ্ঞানীরা। ছবি: সংগৃহীত।
কুইন্সল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের টিস্যু ইঞ্জিনিয়ার ও রিজেনারেটিভ মেডিসিনের গবেষক আব্বা শ্যাফি জানিয়েছেন, চর্মরোগের চিকিৎসায় কৃত্রিম ত্বক খুব কাজে আসবে। ত্বকের ক্যানসারে আশার আলো হতে পারে নকল চামড়া। তা ছাড়া আঘাত লেগে বা পুড়ে গিয়ে যাঁদের ত্বক নষ্ট হয়ে গিয়েছে, তাঁদের জন্য ত্বক প্রতিস্থাপনের নতুন দিগন্ত খুলে দিতেই এই প্রচেষ্টা। ‘ব্রেন ডেথ’ হওয়া দাতার ত্বক নিয়ে তা প্রতিস্থাপনের প্রক্রিয়া বড়ই জটিল। চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় যাকে বলে ‘স্কিন গ্রাফটিং’। এই পদ্ধতি সব সময়ে সফল হয় না। প্রথমত তেমন দাতা খুঁজে পাওয়া জরুরি, দ্বিতীয়ত, সেই দাতার ত্বক গ্রহীতার শরীর গ্রহণ করবে কি না, সেটাও গুরুত্বপূর্ণ। গ্রাফটিং করতে গিয়ে বিপত্তি বেধেছে, এমন উদাহরণও অজস্র। তাই সে সবের ঝক্কিতে না গিয়ে, সরাসরি কৃত্রিম চামড়া বসিয়ে দিলেই কেল্লাফতে। না থাকবে দাতা খোঁজার ঝামেলা, না গ্রাফটিং-এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া।
কৃত্রিম ত্বকের কোষ। ছবি: সংগৃহীত।
স্টেম কোষই আসল কারিগর
কৃত্রিম চামড়া তৈরি করলেই তো হল না, সে চামড়া অবিকল মানুষের ত্বকের মতোও হতে হবে। গবেষক শ্যাফি জানিয়েছেন, ছ’বছর লেগে গিয়েছে, কাজ শেষ হতে। অসম্ভবকে সম্ভব করার জন্য কাজে এসেছে স্টেম কোষ। এই স্টেম কোষ হল শরীরের সেই আদি কোষ, যার ‘সুপার পাওয়ার’ আছে। মহাশক্তিধর এই কোষগুলি থেকে মনুষ্যেতর বিভিন্ন প্রাণী তাদের ক্ষতিগ্রস্ত অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সারিয়ে তোলে। সেই অঙ্গগুলিকে বদলে নতুন রূপ দেয়। রোগে বা দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের নানা অঙ্গপ্রত্যঙ্গের প্রতিস্থাপনের জন্যেও এখন স্টেম কোষেরই সাহায্য নিচ্ছেন গবেষকেরা।
অস্থি, তরুণাস্থি থেকে শুরু করে রক্ত এবং লসিকা সংবহনতন্ত্র গঠনে স্টেম কোষের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই কোষগুলির রূপান্তর ঘটানো সম্ভব। স্টেম কোষের উৎস অনেক। সন্তান জন্মানোর পর মায়ের শরীর থেকে যে প্ল্যাসেন্টা বা অমরা বেরিয়ে আসে, তার মধ্যে থাকে স্টেম কোষ, যাকে ‘এমব্রায়োনিক স্টেম সেল’ বলে। আবার মজ্জা থেকেও স্টেম কোষ তৈরি হয়। এই কোষগুলিকে অন্য যে কোনও কোষে বদলে দেওয়া যেতে পারে। যেমন, মজ্জা থেকে নেওয়া স্টেম কোষকে স্নায়ুর কোষে বদলে দেওয়া সম্ভব। আবার সেই স্টেম কোষ থেকে ত্বকের কোষও তৈরি করা অসম্ভব কিছু নয়। আবার এর থেকে হৃদ্পিণ্ড, ফুসফুস, মস্তিষ্কের কোষও তৈরি করা যায়। স্টেম কোষের এই রূপান্তরিত হওয়ার ক্ষমতাকেই কাজে লাগিয়ে কৃত্রিম চামড়া তৈরি করা হয়েছে, যাতে শিরা-ধমনী, রক্তজালক, রক্তনালি, স্নায়ু— সবই থাকবে। কাজেই, সে ত্বক একেবারে আসলের মতো। আগামী দিনে দুরারোগ্য ব্যাধির চিকিৎসায় এই গবেষণাই মাইলফলক হবে বলে আশা গবেষকদের।