সদ্যোজাত শিশুরও জিনগত পরীক্ষা হবে, তাতে লাভটা কী? ছবি: ফ্রিপিক।
সদ্যোজাতেরও জিনের পরীক্ষা হবে? কোষ তৈরি হয় যে জিন বা ডিএনএ দিয়ে, তা পরীক্ষা করে দেখা হবে, সেই শিশুটি আগামী দিনে কোনও জটিল রোগের শিকার হবে কি না। আগেভাগে জেনে নিয়ে তেমন ভাবেই তার চিকিৎসা শুরু করে দেওয়া হবে। এমনই পরিকল্পনা নিয়েছে ব্রিটেনের ‘ন্যাশনাল হেল্থ সার্ভিস’ (এনএইচএস)। জিনগত রোগ বা অটোইমিউন অসুখ যার নিরাময় চট করে হয় না, তেমনই সব দুরারোগ্য ব্যাধি চিহ্নিত করতে ‘ডিএনএ ম্যাপিং’ করা হয়ে থাকে। তবে তা করা হয়, রোগের উপসর্গ টের পাওয়ার পরে। শিশুর জিনগত পরীক্ষা আগে থেকে করিয়ে রাখার ভাবনা এই প্রথম। আগামী ১০ বছরের জন্য এই পরিকল্পনা নিয়েছে এনএইচএস।
শিশু জন্মানোর সঙ্গে সঙ্গে মায়ের নাড়ি বা আম্বিলিকাল কর্ড থেকে কোষের নমুনা নিয়ে তার ‘ডিএনএ টেস্ট’ করা হবে। প্রায় লক্ষাধিক নবজাতকের কোষের নমুনা নিয়ে পরীক্ষার কাজ শুরু হতে চলেছে ব্রিটেনে।
জিনের পরীক্ষা কেন জরুরি? ছবি: ফ্রিপিক।
কেন জিনগত পরীক্ষা এত জরুরি?
বিশ্বে আনুমানিক ৭০০০ রকমের বিরল রোগ রয়েছে এবং প্রায় ৩০ কোটি মানুষ এই সব রোগে ভোগেন। সমীক্ষা বলছে, প্রতি বছর মোট যত জন শিশু জন্মাচ্ছে, তার মধ্যে প্রায় ছ’শতাংশ এই ধরনের বিরল রোগ নিয়ে জন্মায়। এদের মধ্যে ৩০ শতাংশের পাঁচ বছর বয়স হওয়ার আগেই মৃত্যু ঘটে। ‘প্রেস ইনফরমেশন ব্যুরো’ (পিআইবি)-র তথ্য বলছে, এ দেশে প্রতি বছর প্রায় ৫০ লক্ষ শিশু নানা রকম জিনগত রোগ নিয়ে জন্মায়। যদিও সব জিনগত রোগ প্রাণঘাতী নয়, তবুও সাবধান থাকা জরুরি। যেমন স্পাইনাল মাস্কুলার অ্যাট্রফি, সিক্ল সেল অ্যানিমিয়া, সিস্টিক ফাইব্রোসিস, হান্টিংটনের মতো রোগ পরবর্তী সময়ে ধরা পড়লে তার চিকিৎসা পদ্ধতি খুবই জটিল ও ব্যয়সাপেক্ষ। রোগ সম্পূর্ণ নিরাময় হওয়ার সম্ভাবনাও কম। তাই শিশু জন্মানোর সঙ্গে সঙ্গেই যদি তার জিনের পরীক্ষা করে রোগের আঁচ পাওয়া যায়, তা হলে রোগ মাথাচাড়া দেওয়ার আগেই প্রতিকারের চেষ্টা করা যাবে।
জিন কী? কেন হয় জিনগত রোগ?
মানবকোষ ২২ জোড়া ক্রোমোজ়োম নিয়ে তৈরি আর থাকে একজোড়া ‘সেক্স’ ক্রোমোজ়োম এক্স ও ওয়াই। মা-বাবার থেকে এক্স ও ওয়াই ক্রোমোজ়োম এলে পুত্রসন্তান হবে আর এক্স-এক্স ক্রোমোজ়োম এলে হবে কন্যাসন্তান। এই ক্রোমোজ়োম হাজার হাজার জিন (ডিএনএ) নিয়ে তৈরি, যারা পর পর সজ্জিত থাকে। জিন-ই নির্ধারণ করে কোন প্রাণীকে কী রকম দেখতে হবে, তার স্বভাব কেমন হবে, কী ভাবে জীবনধারণ করবে ইত্যাদি। এই জিনের সাজসজ্জায় যদি কোনও ত্রুটি থাকে অথবা জিনের মধ্যে রাসায়নিক বদল ঘটে যায় (জেনেটিক মিউটেশন), তা হলে জটিল রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে। জিনগত রোগ নির্মূল করা প্রায় অসম্ভব, তার জন্য জিনের সাজসজ্জায় বদল আনতে হয়, যা খুবই জটিল পদ্ধতি।
এখনও পর্যন্ত যত ধরনের জেনেটিক ডিজ়অর্ডার পাওয়া গিয়েছে,তা তিনটি ভাগে ভাগ করা যায়—সিঙ্গল জিন ডিজ়অর্ডার,ক্রোমোজ়োমাল ডিজ়অর্ডার এবং মাল্টি-জিন ডিজ়অর্ডার। মা ও বাবার শরীর থেকে আসা একটি জিনে যদি বদল হয়, তা হলে সন্তানের জিনগত রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে ৫০ শতাংশ। এই ধরনের রোগের উদাহরণ হল হান্টিংটন’স ডিজ়িজ়, মারফান সিনড্রোম,টিউবেরাউস স্ক্লেরোসিস ইত্যাদি। আবার বাবা ও মা দু’জনেই যদি রাসায়নিক ভাবে বদলে যাওয়া বা মিউটেটেড জিনের কপি বহন করে, তা হলে পরবর্তী প্রজন্মের জিনগত রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বাড়ে। সে ক্ষেত্রে রবার্টস সিনড্রোম, সিক্ল সেল ডিজ়িজ়, সিস্টিট ফাইব্রোসিসের মতো রোগের ঝুঁকি বাড়ে। তাই আগে থেকেই যদি জিনের পরীক্ষা করিয়ে রাখা যায়, তা হলে লাভ হবে দু’টি— প্রথমত, ভবিষ্যতে শিশুটিকে দুরারোগ্য ব্যধিতে ভুগতে হবে না। দ্বিতীয়ত, গোড়া থেকেই যদি জিনের ত্রুটি সংশোধন করে ফেলা যায়, তা হলে জিনগত রোগ আর পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যেও ছড়িয়েও পড়তে পারবে না।