উত্তরাধিকারে রোগ পাবে না সন্তান! গ্রাফিক— সনৎ সিংহ।
কোনও শিশু যখন ভূমিষ্ঠ হয়, তখন উত্তরাধিকার সূত্রে কিছু জিনগত বৈশিষ্ট্য সঙ্গে নিয়েই আসে।
তাতে যেমন মা-বাবা-পূর্বসূরিদের কিছু চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য থাকে, তেমনই থাকে কিছু শারীরিক বৈশিষ্ট্যও। মুশকিল হল, ওই শারীরিক বৈশিষ্ট্যের মধ্যে থাকে বাবা-মায়ের শরীরে থাকা কিছু দুরারোগ্য রোগও। যা জিনবাহিত হয়ে বাসা বাঁধে সন্তানের শরীরেও। এ ভাবে মায়ের শরীরে থাকা বহু জটিল রোগে শিশুরা আক্রান্ত হতে পারে, যা হয়তো সারা জীবনে চিকিৎসা করিয়েও সারানো য়ায় না।
এই সমস্যার প্রতিকার এত দিন না থাকলেও এই প্রথম, মায়ের শরীরের রোগ এড়িয়ে সুস্থ সন্তানের জন্ম হল এক বিশেষ পদ্ধতিতে। যার নাম থ্রি প্যারেন্ট ইনভিট্রো ফার্টিলাইজেশন।
ব্রিটেনের গবেষকদের চেষ্টায় ওই বিশেষ পদ্ধতিতে জিনগত রোগ এড়িয়ে জন্ম হল ৮টি শিশুর, যার মধ্যে কয়েক জনের মায়ের শরীরে মারণ রোগও ছিল। আবার কারও ছিল ডায়াবিটিস, দৃষ্টিশক্তি নষ্ট হয়ে যাওয়ার রোগ, পেশি নষ্ট হয়ে যাওয়ার মতো রোগও। এর কোনওটিই সন্তানের শরীরে জিনবাহিত হয়ে আসেনি!
উত্তর-পূর্ব ইংল্যান্ডের নিউ কাসল ফার্টিলিটি সেন্টারে ২২ জন নানা রোগে আক্রান্ত মায়েদের নিয়ে পরীক্ষামূলক চেষ্টাটি চালিয়েছিলেন এক দল গবেষক। বুধবার সেই পরীক্ষার সাফল্যের খবর প্রকাশ করেছেন তাঁরাই। গবেষকেরা জানিয়েছেন, মোট ২২ জন ‘মা’য়ের মধ্যে সাত জনের সন্তান হয়েছে। চারটি কন্যা এবং চারটি পুত্র সন্তানের জন্ম দিয়েছেন ওই মায়েরা। তার মধ্যে এক মা যমজ সন্তানেরও জন্ম দিয়েছেন। কোনও শিশুরই ডিএনএ-তে তাদের মায়েদের রোগের কোনও চিহ্ন পাওয়া যায়নি।
কী ভাবে এটি সম্ভব হল?
মায়েদের রোগ সন্তানের শরীরে না-আসার জন্য ‘থ্রি পেরেন্ট আইভিএফ’ নামে এক ইনভিট্রো ফার্টিলাইজেশন পদ্ধতি প্রয়োগ করেছিলেন গবেষকেরা। বিজ্ঞান বিষয়ক জার্নাল নেচারে সেই পদ্ধতির বিস্তারিত বিবরণও দেওয়া হয়েছে।
থ্রি পেরেন্ট আইভিএফ কী?
থ্রি পেরেন্ট শব্দটির মধ্যেই বিষয়টি অনেকটা বলে দেওয়া রয়েছে। থ্রি পেরেন্ট অর্থাৎ তিন জন বাবা-মা। বা বলা ভাল বাবা এবং দু’জন মা।
প্রথম মা: এই মা তিনি, যাঁর শরীরের ডিম্বাণু শুক্রাণুর সংস্পর্শে এসে ভ্রুণে পরিণত হচ্ছে। কিন্তু তাঁর শরীরে জিনগত রোগ বাসা বেঁধে থাকায় সেই ভ্রুণের কোষে তৈরি হচ্ছে রোগের খুঁত লাগা মাইটোকনড্রিয়া (যে মাইটোকনড্রিয়া কোষের মূল শক্তির কেন্দ্র)।
দ্বিতীয় মা: সন্তানের এই দ্বিতীয় মা হলেন তিনি, যিনি স্বেচ্ছায় নিজের সুস্থসবল ডিম্বাণুর কোষ দাান করছেন। যে কোষে কোনও জিনগত রোগ নেই। এই কোষ দাতা দ্বিতীয় মায়ের ডিম্বাণুতেই স্থাপন করা হচ্ছে প্রথম মায়ের ভ্রুণের কোনও রকম রোগের বৈশিষ্ট্যহীন নিউক্লিয়াস। তার পরে দ্বিতীয় মায়ের শরীরে ধীরে ধীরে বেড়ে উঠছে নীরোগ সন্তান।
ব্রিটেনে এই পদ্ধতি অবলম্বন করেই জন্ম হয়েছে ওই আট শিশুর। যাঁরা পরীক্ষামূলক ভাবে এই প্রক্রিয়াটি প্রয়োগ করেছিলেন, তাঁরা বলছেন, এই পদ্ধতিতে পরীক্ষা এবং সাফল্য— কোনওটিই আগে আসেনি। এ প্রসঙ্গে নিউ ইয়র্ক সিটির কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টেম সেল বিজ্ঞানী ডায়েট্রিস এগলিও জানিয়েছেন, ‘‘সন্তানের জন্মের যে সমস্ত জটিলতা রয়েছে, তার মধ্যে একটি অবশ্যই মায়ের শরীরের রোগ শিশুর শরীরে জিনবাহিত হয়ে বাসা বাঁধা। এই পদ্ধতিতে নিঃসন্দেহে সেই জটিল সমস্যাকে সমাধানের পথ দেখাল।’’