Delayed Menopause Impact

রজোনিবৃত্তিও পিছিয়ে দেওয়া যায়! বিজ্ঞান এগোচ্ছে, সমাজ এগোচ্ছে কি? পরিণতিই বা কী?

সমাজের যে স্তরেই হোক, রজোনিবৃত্তি পর্ব অনেক মহিলার কাছেই আতঙ্কের। তাই কী ভাবে এই পর্বটিকে ঠেকিয়ে রাখা যায়, সে নিয়ে নানা গবেষণা শুরু হয়েছে। ওষুধ, হরমোনাল থেরাপির পাশাপাশি জরায়ু ‘ফ্রিজ়’ করে রাখার পদ্ধতি নিয়ে জোরদার চর্চা চলছে।

Advertisement

আনন্দবাজার ডট কম সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ৩১ মে ২০২৫ ০৮:৫৬
Share:

রজোনিবৃত্তি কি পিছিয়ে দেওয়া যায়? নতুন কী কী গবেষণা হল? গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।

৪৫ থেকে ৫০ বছরের দোরগোড়ায় পৌঁছে ঋতুস্রাব বন্ধ হওয়ার সময় আসে। শরীর এব‌ং মনের নানা বদলের মধ্যে দিয়ে যেতে যেতে ৫২ থেকে ৫৫ বছরে গিয়ে ঋতুচক্রে পাকাপাকি ইতি পড়ে। ওই পর্বটিকেই বলা হয় রজোনিবৃত্তি, যা নিয়ে মহিলাদের চিন্তার শেষ নেই। ঋতুচক্র শেষ হওয়া মানেই যেন গেল গেল রব পড়ে যায়। সন্তানধারণের ক্ষমতা চলে যাবে, শরীর বার্ধক্যের দিকে আরও এক কদম এগিয়ে যাবে— এই পরিবর্তনটা মেনে নেওয়া কঠিন হয়ে পড়ে অনেকের কাছেই। সমাজের যে স্তরেই হোক, রজোনিবৃত্তি পর্ব অনেক মহিলার কাছেই আতঙ্কের। তাই কী ভাবে এই পর্বটিকে ঠেকিয়ে রাখা যায়, সে নিয়ে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা, গবেষণা শুরু হয়েছে বিশ্বের নানা জায়গায়। ওষুধ, হরমোনাল থেরাপির পাশাপাশি ডিম্বাণু ‘ফ্রিজ়’ করে রাখার পদ্ধতি নিয়ে জোরদার চর্চা চলছে। এই থেরাপিগুলি নীতিমতো ভাবে কতটা সঠিক বা এর প্রভাব সমাজে কী ভাবে পড়বে, সে নিয়ে আলোচনা কমই হয়েছে। বিজ্ঞানীরা দাবি করছেন, একজন মহিলা যত দিন বাঁচবেন, তত দিনই তাঁর ঋতুস্রাব চলবে, এমন পরিবর্তন নিয়ে আসা এখনও সম্ভব হয়নি। তবে আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানে এমন কিছু পদ্ধতি আছে, যা দিয়ে কয়েক বছরের জন্য হলেও রজোনিবৃত্তির পর্বটিকে পিছিয়ে দেওয়া যেতে পারে।

Advertisement

আসলে বার্ধক্য পিছিয়ে দেওয়াই এখন সবচেয়ে চর্চিত বিষয়। তাই চারদিকে এত অ্যান্টি-এজিং প্রসাধনীর ছড়াছড়ি। রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন তো কিছু দিন আগে ফরমান জারি করেছিলেন, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব যৌবন ধরে রাখার ওষুধ আবিষ্কার করতে হবে। জলে নেমে হোক, পাতাল ফুঁড়ে হোক অথবা পৃথিবীর আনাচ-কানাচ ঘুরে, বয়স কমানোর কৌশল খুঁজে বার করতেই হবে। সোজা কথায় বললে, সেই অমরত্ব লাভের বাসনাই যুগ যুগ ধরে চলে আসছে। যৌবন গত হওয়া মানেই, জীবন শেষ হয়ে যাওয়া, এমন ধারণাই বদ্ধমূল হয়ে আছে সমাজের নানা স্তরে। আর সে ধারণা থেকেই মহিলাদের রজোনিবৃত্তি পর্বটিকেও পিছিয়ে দেওয়া বা থামিয়ে দেওয়ার ভাবনা এসেছে। আর যেমন ভাবনা, তেমন কাজ। বিজ্ঞানীরাও উঠেপড়ে লেগেছেন নতুন আবিষ্কারে, যা প্রকৃতির নিয়মকেও ঘোল খাইয়ে দিতে পারে।

ছবি:ফ্রিপিক।

মাথাব্যথা যখন মেনোপজ়

Advertisement

রজোনিবৃত্তি নিয়ে বিজ্ঞানীরা যে এত মাথা ঘামাচ্ছেন, তার শিকড় কিন্তু বহু দিন আগেই গাঁথা হয়েছিল। মেনোপজ় মানেই আতঙ্ক, উদ্বেগ, গেল গেল রব— এই ধারণা তৈরি হয় সেই ১৮ শতকেই। ‘মেনোপজ়’ শব্দটি এসেছে গ্রিক শব্দ ‘মেনস’ অর্থাৎ মাস এবং ‘পাউইন’ অর্থাৎ থামানো থেকে। অর্থাৎ, মাসিক চক্রের সমাপ্তি হচ্ছে যে সময়টাতে, তাকে মেনোপজ় বলে। ১৮২১ সালে ফরাসি চিকিৎসক চার্লস-পিয়েরে-লুই দে গার্ডেন প্রথম শব্দবন্ধটি ব্যবহার করেন। সেই সময়ে চিকিৎসকেরা রজোনিবৃত্তি বা মেনোপজ়কে অসুখ বলে মনে করতেন। ঋতুমতী মহিলার ঋতুচক্র বন্ধ হয়ে যাওয়াকে জটিল অসুখ হয়েছে বলে মনে করা হত। ধারণা ছিল, প্রজনন-অক্ষম, গতযৌবনা নারী মানেই সে সমাজে থাকার অযোগ্য। এই ধারণা পোক্ত হয়ে বসে পরবর্তী সময়ে। কারণ, রজোনিবৃত্তির দোরগোড়ায় পৌঁছে যাওয়া মহিলাদের আরও কিছু শারীরিক সমস্যাও দেখা দিতে থাকে, যেমন অস্টিয়োপোরোসিস বা হাড় ভঙ্গুর হয়ে যাওয়া, অপুষ্টিজনিত রোগ এবং হার্টের রোগ। অস্টিয়োআর্থ্রাইটিসে অনেকের শরীর ধনুকের মতো বেঁকেও যেত। এই সমস্যার সমাধান করতে সেই ১৯৩০ সালে কানাডার এক জন স্ত্রীরোগ চিকিৎসক আর্চি ক্যামেরন প্রথম মেয়েদের জরায়ুর প্লাসেন্টার নির্যাস ব্যবহার করে ‘ইস্ট্রোজেন থেরাপি’ শুরু করেন, যা রজোনিবৃত্তির পর্বটিকে দীর্ঘ সময় ঠেকিয়ে রাখতে পারে। সেটিই ছিল প্রথম ‘হরমোনাল রিপ্লেসমেন্ট থেরাপি’ (এইচআরটি)। এখন সেই পদ্ধতিই অনেক বেশি উন্নত ও তার নানা ধরন ও পদ্ধতি চলে এসেছে।

রজোনিবৃত্তি সময়ের নিয়মেই আসে, ভারতীয় মহিলাদের ৪৫ থেকে ৫৫ বছরই হল সে সময়। ছবি: ফ্রিপিক।

রজোনিবৃত্তির সময়টি পিছিয়ে দেওয়া যায় কি?

আর্চি ক্যামেরন হরমোনাল থেরাপি তো করলেন, তবে তা নিয়ে সমালোচনাও শুরু হল। সে সময়ে ঋতুস্রাব নিয়ে অত খোলাখুলি আলোচনা হত না। তাই তার নিবৃত্তি নিয়েও যে সমাজের সব স্তরের মানুষ খুব একটা উৎসাহী হবেন, তা তো নয়। তবে শিকে ছিঁড়ল ১৯৬৬ সালে গিয়ে। আমেরিকার স্ত্রীরোগ চিকিৎসক রবার্ট এ উইলসনের ‘ফেমিনিন ফরএভার’ বইটি রীতিমতো বিপ্লব ঘটিয়ে দিল। চিকিৎসক স্পষ্ট ভাষায় লিখলেন, যৌন আনন্দ উপভোগ করার অধিকার মহিলাদেরও আছে। আজীবন ঋতুমতী থাকতে পারলেই তা সম্ভব। ‘মেনোপজ়াল হরমোনাল থেরাপি’ নামে তিনি এক নতুন চিকিৎসাপদ্ধতি নিয়ে এলেন, যেখানে মহিলাদের ইস্ট্রোজেন হরমোনের সরবরাহ বজায় রেখে, ঋতুচক্রকে স্বাভাবিক রাখা যায়। তবে উইলসনের এই থেরাপি নিয়েও প্রবল বিতর্ক হয়েছিল। অভিযোগ উঠেছিল, জোর করে ঋতুস্রাব স্বাভাবিক রাখতে গিয়ে শরীরে হরমোন ক্ষরণের চক্রটাই ওলটপালট করে দিচ্ছেন চিকিৎসক। এতে মেয়েদের স্তন ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়ছে।

সে যুগের হরমোন থেরাপিরই আরও পরিবর্তিত রূপ চলে এসেছে এ সময়ে।

স্টেম সেল থেরাপি ও পিআরপি (প্লেটলেট-রিচ প্লাজ়মা থেরাপি) প্রয়োগ করেও রজোনিবৃত্তির সময়টাকে পিছিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চলছে বলে জানিয়েছেন স্ত্রীরোগ চিকিৎসক সুদীপ বসু। ক্যানসার বা এড্‌স সারাতে স্টেম সেল থেরাপি যতটা কার্যকর প্রমাণিত হচ্ছে, রজোনিবৃত্তি ঠেকিয়ে রাখতে তা কতটা সফল, তা অবশ্য নিশ্চিত ভাবে জানা যায়নি। আর পিআরপি থেরাপি হাল আমলের। যোনিতে বা অন্যত্র ইঞ্জেকশন দিয়ে কোষ পুনর্গঠনের চেষ্টা হয়, যাতে জরায়ুর স্বাভাবিক কর্মক্ষমতা বজায় থাকে এবং ডিম্বাণুর সংখ্যাও দ্রুত নিঃশেষ না হয়ে যায়। তবে এই পদ্ধতিও যে পুরোপুরি সফল, তা বলা যায় না। বস্তুত রজোনিবৃত্তিকে থামিয়ে দেওয়া বা পিছিয়ে দেওয়ার তেমন কোনও পদ্ধতিই এখনও আবিষ্কার করা যায়নি বলে মত অধিকাংশ চিকিৎসকেরই।

কী কী গবেষণা সাম্প্রতিক সময়ে হচ্ছে? ছবি: ফ্রিপিক।

হরমোনের অদলবদল ঘটিয়ে অনেক মহিলাই তো যৌবন ধরে রাখার চেষ্টা করছেন। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে, পঞ্চাশ পেরিয়েও মা হচ্ছেন অনেকে। সে ক্ষেত্রে একান্ত প্রয়োজন হলে হরমোন রিপ্লেসমেন্ট থেরাপিও কার্যকর হতে পারে। বর্তমান সময়ে এমন থেরাপি অসংখ্য হচ্ছে বলে জানালেন স্ত্রীরোগ চিকিৎসক অভিনিবেশ চট্টোপাধ্যায়। অনেক মহিলাই বলেন যে, তিনি দেরিতে সন্তান নিতে চান। সে কারণে ঋতুমতী থাকতে চান আরও কয়েকটা বছর। ‘হরমোন রিপ্লেসমেন্ট থেরাপি’-তে রজোনিবৃত্তির লক্ষণগুলিকে থামিয়ে রাখা যায়। হরমোন ইঞ্জেকশন দিয়ে পেরিমেনোপজ়, অর্থাৎ ঋতুস্রাব বন্ধ হয়ে যাওয়ার আগের সময়টাকে পিছিয়ে দেওয়া যায়। একজন মহিলা কেবল মা হতে পারবেন বলেই যে এটি করা হয় তা নয়, পঞ্চাশ পেরিয়েও যাতে হাড়ের গঠন মজবুত থাকে, ত্বকে বলিরেখা না পড়ে, ক্যানসার ও হৃদ্‌রোগের ঝুঁকি কমে, সে কারণেও হরমোনের থেরাপি করা হয়। তবে এই পদ্ধতিও সাময়িক ভাবে কার্যকরী, চিরকালীন নয়।

কী কী গবেষণা সাম্প্রতিক সময়ে হচ্ছে?

প্রত্যেক মেয়েই জন্মানোর সময়ে নির্দিষ্ট সংখ্যক ডিম (এগ) নিয়ে জন্মায়। সেই সংখ্যাটা সাধারণত ১০ লক্ষের কাছাকাছি। ঋতুস্রাব শুরুর সময়টায় গিয়ে এই সংখ্যাটা কিছুটা কমে যায়। যদি ১৪ বছর বয়স থেকে ঋতুস্রাব শুরু হয়, তা হলে ১৪ থেকে ৫০ বছর বয়স অবধি প্রতি মাসে ডিম্বাশয় থেকে ডিম্বাণু ফ্যালোপিয়ান নালিতে চলে আসে। সেটি সেখানেই নিষিক্ত হওয়ার জন্য অপেক্ষা করে। ডিম্বাণু জরায়ুতে এসে যে জায়গায় থিতু হয়, সেখানে একটি স্তর তৈরি হয় যার নাম এন্ডোমেট্রিয়াম। মহিলাদের শরীরের দুই হরমোন ইস্ট্রোজেন ও প্রোজেস্টেরন এই ডিম্বাণু তৈরি ও নির্গমনের প্রক্রিয়াটিকে নিয়ন্ত্রণ করে। এন্ডোমেট্রিয়াম স্তরটির ঘনত্ব বাড়াতে সাহায্য করে ইস্ট্রোজেন হরমোন। এ বার যদি ডিম্বাণুটি নিষিক্ত না হয়, তবে প্রোজেস্টরনের মাত্রা কমতে থাকে। তখন এই হরমোনটি এন্ডোমেট্রিয়ামের স্তর ভেঙে দেয়, এবং এই স্তরটিই ঋতুস্রাবের আকারে বেরিয়ে আসে।

মেয়েদের সম্পূর্ণ ঋতুচক্রে সাধারণ ভাবে ৫০০-৬০০ ডিম্বাণু খরচ হয়। তার মধ্যেও কিছু থাকে প্রজননক্ষম, বাকিগুলি অপরিণত অবস্থায় থাকে, যাদের বলে ‘প্রাইমরডিয়াল ফলিকল’। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ডিম্বাণুর সংখ্যা ও গুণগত মান যেমন কমতে থাকে, তেমনই ইস্ট্রোজেন ও প্রোজেস্টরন হরমোনের কার্যকারিতাও কমতে থাকে। এই ভাবে রজোনিবৃত্তি পর্বে এসে আর ডিম্বাণুর নিঃসরণ হয় না, এন্ডোমেট্রিয়াম স্তরও তৈরি হয় না, ফলে ঋতুস্রাব বন্ধ হয়ে যায়। যদি এই গোটা প্রক্রিয়াটিকে থামিয়ে বা পিছিয়ে দিতে হয়, তা হলে ডিম্বাণু তৈরির প্রক্রিয়াটিকে অব্যাহত রাখতে হবে। আর সেই কাজ করতে পারে ইস্ট্রোজেন হরমোন। সে কারণেই কৃত্রিম ভাবে ইস্ট্রোজেন হরমোন ইনজেক্ট করতে থাকলে, এই প্রক্রিয়াটি চলতে থাকবে। ইস্ট্রোজেন হরমোন দিয়ে রজোনিবৃত্তি পিছনোর পদ্ধতিকে চিকিৎসার ভাষায় একেই বলে ‘ইস্ট্রোজেন হরমোন থেরাপি’, যা কয়েক বছরের জন্য হলেও ঋতুস্রাব চালু রাখতে পারে। তবে হরমোন থেরাপি করে ডিম্বাণু তৈরি তো হল, সেগুলি সব সময়ে নিষিক্ত হওয়ার ক্ষমতা রাখবে কি না, তা নিশ্চিত করে বলা যায় না। সে কারণেই হরমোন থেরাপি দিয়েই যে রজোনিবৃত্তি আটকানো যাবে, তা মানতে রাজি হন স্ত্রীরোগ চিকিৎসক মৃগাঙ্ক মৌলি সাহা। তাঁর মতে, এই পদ্ধতি সাময়িক ভাবে কার্যকরী, সুদূরপ্রসারী ফল পাওয়া যাবে না।

আরও একটি গবেষণা হচ্ছে ‘এগ ফ্রিজ়িং’ নিয়ে। কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীরা নতুন এক থেরাপি নিয়ে এসেছেন, যা জরায়ুকে বুড়িয়ে যেতে দেবে না। গত বছরই ‘আমেরিকান জার্নাল অফ অবসট্রিকস অ্যান্ড গাইনেকোলজি’-তে এই গবেষণার খবর প্রকাশিত হয়। বিজ্ঞানীরা জানান, ডিম্বানু কোষকে আগে থেকেই তুলে নিয়ে তা হিমায়িত করা হবে। পরে বয়সকালে সেই কোষগুলিকেই ফের প্রতিস্থাপন করে দিলে জরায়ুর বয়স কয়েক বছর কমে যাবে। সে ক্ষেত্রে ডিম্বাণুর সংখ্যাও ফুরিয়ে যাবে না, আর ঋতুচক্রের সমাপ্তিও হবে না। এই গবেষণাও কতটা সফল, তা বলতে পারেননি গবেষকেরা।

· ‘ওভারিয়ান ক্রায়োপ্রিজ়ারভেশন’ আরও একটি পদ্ধতি। ইয়েল স্কুল অফ মেডিসিনের চিকিৎসকেরা এই পদ্ধতি নিয়ে গবেষণা করছেন। পাশাপাশি, ‘ওভারিয়ান ট্রান্সপ্লান্ট’ বা জরায়ু প্রতিস্থাপন নিয়েও গবেষণা চলছে। এ ক্ষেত্রে ২১ থেকে ৪০ বছর বয়সের মধ্যে জরায়ুর থেকে এমন কিছু কোষ নিতে হবে, যাতে কয়েকশো বা কয়েক হাজার অপরিণত ডিম্বাণু (প্রাইমরডিয়াল ফলিকল) থাকবে। সেই কোষগুলিকে একটি কন্টেনারে ভরে মাইনাস ৩২০ ডিগ্রি ফারেনহাইটে সংরক্ষণ করা হবে। পরবর্তী সময়ে সেই কোষসমেত ডিম্বাণুগুলিকেই ফের প্রতিস্থাপন করা হয় জরায়ুতে। যত বেশি ডিম্বাণু প্রতিস্থাপিত হবে, ঋতুচক্র তত দিনই চলবে বলে দাবি। এই পদ্ধতি প্রয়োগের হার কম, সাফল্য নিয়ে সুনিশ্চিত ভাবে কিছু বলা যায় না।

· ইস্ট্রোজেন ইঞ্জেকশন দিয়ে রজোনিবৃত্তি এক বছর করে পিছিয়ে রাখা যায়। তবে ডিম্বানুর গুণগত মান কেমন, তার উপরেই সবটা নির্ভর করবে। ৫০ বা ৫৫ বছরের কোনও মহিলা ইঞ্জেকশন নিয়ে ঋতুচক্র পিছিয়ে রাখার চেষ্টা করতে পারেন, তবে তিনি সন্তানধারণ করতে পারবেন কি না, তা নিশ্চিত করে বলা যায় না।

· গর্ভনিরোধক বড়ি খেয়ে পেরিমেনোপজ় আসার সময়টাকে কিছুটা পিছোনো যায়, তবে এই সব ওষুধ খেয়ে রজোনিবৃত্তি বন্ধ করে দেওয়া যায় না। যে মহিলারা গর্ভনিরোধক বড়ি বেশি খান, তাঁদের রজোনিবৃত্তির পর্ব আসার সময়টাকে কিছুটা হলেও পিছিয়ে যায়।

মেনোপজ় পিছোতে হরমোন থেরাপি কতটা কার্যকরী? ছবি: ফ্রিপিক।

রজোনিবৃত্তি ও সংস্কার

তথ্যপ্রযুক্তি কর্মী মিতালি বিশ্বাসের বয়স পঁয়তাল্লিশের কোঠায়। রজোনিবৃত্তি নিয়ে অল্পবিস্তর চিন্তা রয়েছে। তবে হরমোন থেরাপি করানোর ঝুঁকি নিতে রাজি নন। এমন অনেক মহিলাই রয়েছেন, যাঁদের সুপ্ত বাসনা, কী ভাবে রজোনিবৃত্তির পর্বটিকে পিছোনো যায়। ইন্টারনেটে এই নিয়ে বিস্তর খোঁজাখুঁজিও হয়। অনেক মহিলারই ধারণা, নারী ঋতুমতী হওয়া মানে যৌবনবতী হওয়া। তাঁর তখন সৌন্দর্য রয়েছে ও সন্তান জন্ম দেওয়ার ক্ষমতা রয়েছে। ফলে সমাজে তিনি ‘মূল্যবান’। ভারতের একাধিক প্রদেশে মেয়েরা প্রথম ঋতুমতী হলে প্রায় বিয়ের মতো উৎসব হয়। রজোনিবৃত্তি মানেই আবার সমাজে ‘দর’ কমে যাওয়া।

এই আজন্মলালিত বিশ্বাস বহু নারীর ভিতরেই এমন ভাবে প্রোথিত যে, রজোনিবৃত্তির পরে অনেকেই বলেন, স্বামী আর আগের মতো ভালবাসেন না, কেউ তারিফের চোখে তাকান না। রজোনিবৃত্তি থামিয়ে দেওয়ার ওষুধ বা থেরাপি নিয়ে যতটা মাথাব্যথা, তার চেয়ে অনেক বেশি চিন্তার ব্যাপার হল জীবনের এই পর্বটিকে নিয়ে বিভ্রান্ত থাকা। স্ত্রীরোগ চিকিৎসক ইন্দ্রাণী লোধ মনে করেন, রজোনিবৃত্তি মানেই যৌবন চলে যাওয়া নয়। বার বার ইঞ্জেকশন দিয়ে প্রক্রিয়াটিকে এক বছর করে পিছিয়ে দেওয়া যায় মাত্র। তবে মন থেকে অন্ধবিশ্বাস দূর করা যায় না। রজোনিবৃত্তি মানেই বয়স হয়ে যাওয়া, দেখতে খারাপ হয়ে যাওয়া, সঙ্গীর কাছে আকর্ষণ হারানোর মতো দুশ্চিন্তা বহু মহিলাকে চূড়ান্ত অবসাদ ও নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে ফেলছে। তাঁরা বাড়াবাড়ি রকম হরমোন রিপ্লেসমেন্ট থেরাপি, অ্যান্টি-ডিপ্রেসেন্ট ট্যাবলেট বা নেশার দ্বারস্থ হচ্ছেন। গ্রামীণ এলাকায় অনেক মেয়েই স্বামীর কাছে কদর কমে যাওয়ার ভয়ে মেনোপজ়ের কথা লুকিয়ে যান। সমস্যাটা আসলে এখানেই।

সংসার, কাজকর্ম, ছেলেমেয়ের অজস্র ঝড়ঝাপটা সামলে জীবনের মধ্যপর্বে এসে মেয়েদের একটু দম ফেলে থিতু হওয়ার কথা। তখন সে অনেক পরিণত, পরিবারে বা কর্মক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত। অনেকেই তার উপরে নির্ভরশীল। ওই পর্বে গিয়ে রজোনিবৃত্তি থামিয়ে দেওয়ার কথা না ভেবে ঠিক খাওয়াদাওয়া, ব্যায়াম, জীবনযাত্রা ও কাউন্সেলিং নিয়ম মেনে করালে এমনিতেও রজোনিবৃত্তি পর্ব দেরি করেই আসবে। জৈবিক একটি প্রক্রিয়াকে কৃত্রিম ভাবে থামিয়ে দেওয়ার প্রয়োজন নেই বলেই মনে করেন স্ত্রীরোগ চিকিৎসক মল্লিনাথ মুখোপাধ্যায়। গর্ভনিরোধক বড়ি খেয়েও রজোনিবৃত্তি পর্বকে ঠেকিয়ে রাখা যায়, তবে দীর্ঘ দিনের এই অভ্যাস শরীরের বড় ক্ষতি করে।

কেউ কেউ হয়তো জিজ্ঞেস করবেন, রজোনিবৃত্তি থামিয়ে দেওয়ার ওষুধ বেরিয়ে গেলে সত্যিকারের পরিবর্তন কতটুকু হবে? বিরাট পরিবর্তন যে এখনই আসবে না, তা হলফ করে বলা যায়। চিকিৎসাবিজ্ঞানের উন্নতিতে কেউ কেউ হয়তো সদিচ্ছায় এই বিষয়টিকে গ্রহণ করবেন, কেউ বা সামাজিক পরিবর্তনের একটা অঙ্গ হিসেবে, আবার কেউ বলবেন কুসংস্কার ভাঙছেন। গবেষণা চলবে, প্রকৃতির নিয়মকে বুড়ো আঙুল দেখাতে নতুন নতুন আবিষ্কারও হবে। আর এর প্রভাব ভাল হবে না মন্দ, তা আগামী সময়েই বোঝা যাবে।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement