সোনম কপূর। ছবি: সংগৃহীত।
বছরশেষের আগে স্ফীতোদরের ছবি দিয়ে অভিনেত্রী সোনম কপূর জানালেন, মা হতে চলেছেন তিনি। প্রথম সন্তান বায়ুর বয়স তিন। দ্বিতীয় বার মাতৃত্ব উপভোগ করার জন্য প্রস্তুত সোনম। উচ্ছ্বসিত স্বামী আনন্দ আহুজা। সোনমের বয়স এখন ৪০। এই বয়সে সোনমের আসন্ন মাতৃত্বের খবর ঘোষণার পরেই প্রশ্ন উঠছে, বেশি বয়সে মা হওয়ার তো ঝুঁকি অনেক! অনেক মহিলাই এখন বেশি বয়সে নিজের কর্মক্ষেত্রে একটি ভাল জায়গায় পৌঁছোনোর পরেই মা হওয়া সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন। চাইলেন আর মা হয়ে গেলেন, ব্যাপারটা কিন্তু অত সহজ নয়। ৩০-এর পর থেকে মেয়েদের শরীরে ডিম্বাণুর সংখ্যা ও গুণমান কমতে থাকে। ৩৫-এর পর পর গর্ভধারণের সম্ভাবনা দ্রুত কমে যেতে থাকে। অন্তঃসত্ত্বা হলেও হরমোনের গোলমালের জন্য গর্ভপাতের সম্ভাবনা বাড়ে। আবার ডিম্বাণুর গুণমান ভাল না হলে শিশু বিকলাঙ্গ হতে পারে। বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়াতে পারে মায়ের স্বাস্থ্যও।
সোনম কপূর একা নন, ক্যাটরিনা কইফ, দীপিকা পাড়ুকোন, বিপাশা বসুর মতো অভিনেত্রীরাও বেশি বয়সে অন্তঃসত্ত্বা হয়েছেন। চিকিৎসকেরা জানাচ্ছেন, সঠিক পরিকল্পনা এবং চিকিৎসকের কড়া নজরদারিতে থাকলে বেশি বয়সে মা হওয়া এখন ততটাও ঝুঁকিপূর্ণ নয়। হায়দরাবাদের চিকিৎসক নিলম সুরি বলেন, ‘‘বেশি বয়সে অন্তঃসত্ত্বা হওয়ার ঘটনা এখন নতুন বিষয় নয়। চিকিৎসকের সঠিক পরামর্শ মতো সাবধানতা অবলম্বন করে এখন অনেক মহিলাই ৪০ বছরে এসেও অন্তঃসত্ত্বা হওয়ার পরিকল্পনা করছেন, এবং তাঁরা ইতিবাচক ফলও পাচ্ছেন। তবে ২০ বছর বা ৩০ বছরের তুলনায় ৪০ বছরে অন্তঃসত্ত্বা হওয়ার ঝুঁকিও বেশি, তবু সঠিক পরিকল্পনা, রুটিন চেকআপ, স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন করলে মা ও সন্তানের শারীরিক সমস্যা এড়ানো সম্ভব।’’
চিকিৎসাবিজ্ঞান এখন উন্নত, তাই ৩৫-এর পরে যাঁরা অন্তঃসত্ত্বা হচ্ছেন, তাঁদের মা হওয়ার হার এখন অনেকটাই বেড়েছে। দিল্লিনিবাসী স্ত্রীরোগ চিকিৎসক ইলা গুপ্ত বলেন, ‘‘এখন অনেক অভিনেত্রীই ৪০-এর কাছাকাছি বয়সে মা হচ্ছেন। ইদানীং ‘ফার্টিলিটি ট্রিটমেন্টের’ উন্নতি কতটা হয়েছে, তাঁদের সাফল্য তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে। চিকিৎসকের সঠিক পরামর্শ ও মেডিক্যাল ট্রিটমেন্টের কারণে ৪০-এর পরেও এখন মা হওয়া কোনও বড় বিষয় নয়। তবে সব মহিলার শরীরে সমান ভাবে একই মেডিক্যাল ট্রিটমেন্ট কাজ করে না, তাই ঝুঁকি একেবারেই থাকে না, সে কথাও বলা যাবে না।’’
৩৬ বছর বয়সে প্রথম বার অন্তঃসত্ত্বা হয়েছিলেন সোনম। ছবি: ইনস্টাগ্রাম।
জরায়ুর বয়স বাড়ে খুব তাড়াতাড়ি। একে চিকিৎসা বিজ্ঞানের পরিভাষায় বলা হয় ‘ওভারিয়ান এজিং’। বাইরে থেকে তা বোঝা যায় না। শরীরের বয়স যে হারে বাড়ে, তার থেকে দ্রুত গতিতে বাড়ে জরায়ুর বয়স। তা ছাড়া, এখনকার আবহাওয়ার পরিস্থিতি, দূষণ, খাবারে ভেজাল, স্থূলত্ব ও জীবনযাপনে অসংযমের কারণে জরায়ুর কর্মক্ষমতা অনেকটাই তাড়াতাড়ি কমে যাচ্ছে। তাই সন্তান নেওয়ার পরিকল্পনা দ্রুত করাই ভাল।
চিকিৎসক মল্লিনাথ মুখোপাধ্যায় পরামর্শ দিচ্ছেন, ৩০ বছরের আগেই সন্তান নেওয়ার পরিকল্পনা শুরু করা উচিত। কারণ ৪০ থেকে ৫০ বছর বয়স অবধি মহিলাদের রজোনিবৃত্তির সময়। সেটা ৪০ বা তার আগেও হতে পারে অথবা ৫০-এও হতে পারে। ঋতুস্রাব হচ্ছে মানেই ডিম্বাণুর গুণগত মান ঠিক আছে, তা কিন্তু একেবারেই নয়। সাধারণত সন্তান পরিকল্পনা শুরু করার এক বছর অবধি চেষ্টা করে যেতে হয়। তার পরেও না হলে তখন পরীক্ষা করে দেখতে হবে যে, সমস্যাটা কোথায়। সমস্যা চিহ্নিত হলে তার পর ওষুধ ও চিকিৎসা। এর পরেও সন্তান না এলে তখন ল্যাপারোস্কোপি ও অন্যান্য থেরাপি করা দরকার। এর পর আইইউআই ও শেষে আইভিএফ। যদি দেখা যায় তিন বারেও আইভিএফ সফল হয়নি, তখন জানিয়ে দেওয়া হয় যে, সম্ভাবনা নেই বললেই চলে।
৪০-এ মা হতে চাইছেন, তা হলে কী করা উচিত?
১) স্ত্রীরোগ চিকিৎসকেরা পরামর্শ দিচ্ছেন, সবচেয়ে আগে দু’রকম টেস্ট করিয়ে নেওয়া খুব দরকার।
ক) আলট্রাসাউন্ড- এই পরীক্ষা করালে বোঝা যাবে, জরায়ু ঠিক কেমন পর্যায়ে রয়েছে এবং ডিম্বাণুর গুণগত মান কেমন।
খ) এএমএইচ টেস্ট- এই পরীক্ষা করালে বোঝা যাবে, জরায়ুতে কতগুলি ডিম্বাণু আর অবশিষ্ট আছে, মা হওয়া সম্ভব কি না।
২) মা হওয়ার পরিকল্পনা করার সময়ে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত। সন্তান নেওয়ার পরিকল্পনা থাকলে ‘প্রি প্রেগন্যান্সি কাউন্সেলিং’ করাতে পারেন। এ ক্ষেত্রে হবু সন্তান ও মায়ের অসুস্থ হয়ে পড়া ও অন্যান্য জটিলতার ঝুঁকি কমে যায়। সে ক্ষেত্রে আগে আলট্রাসাউন্ড ও এএমএইচ পরীক্ষা করিয়ে দেখে নেওয়া হয়, স্বাভাবিক ভাবে মা হওয়া সম্ভব কি না।
৩) থ্যালাসেমিয়া পরীক্ষা করিয়ে নেওয়া দরকার। মা ও বাবা দু’জনেই যদি বাহক হন, তা হলে ২৫ শতাংশ ক্ষেত্রে শিশুরও থ্যালাসেমিয়া হওয়ার ঝুঁকি থেকে যায়।
৪) রুবেলা টেস্ট করানো খুবই জরুরি। চিকিৎসক বলে দেবেন, কখন রুবেলার টিকা নিতে হবে। রুবেলার টিকা নেওয়া থাকলে গর্ভাবস্থায় সংক্রমণের ভয় কম থাকবে। তা না হলে, গর্ভাবস্থায় যদি কোনও রকম সংক্রমণ হয়, তা হলে শিশু সুস্থ ও স্বাভাবিক হবে না।
৫) এখন এন্ডোমেট্রিওসিস, পলিসিস্টিক ওভারির মতো সমস্যা ঘরে ঘরে। তাই মা হওয়ার কথা ভাবলে আগে থেকে এ সবের চিকিৎসা করিয়ে নেওয়া ভাল।
৬) বয়স ৩৯ পার করে গেলেই সেই মহিলার রক্তের এনআইপিটি টেস্ট করে নেওয়া হয়। তাতেই ৯৯ শতাংশ বলে দেওয়া যায় শিশুর ডাউন সিনড্রোম হতে পারে কি না।
৭) যদি শুরু থেকেই ভাবেন যে, সন্তান বেশি বয়সে নেবেন, তা হলে অনেক আগে থেকে ডিম্বাণু সংরক্ষণ করে রাখতে পারেন। একে বলা হয় ‘উসাইট প্রিজ়ারভেশন' বা 'এগ ফ্রিজিং’। আগে থেকে ডিম্বাণু সংরক্ষণ করে রাখলে ভবিষ্যতে মা হওয়ার কোনও সমস্যা থাকে না। চিকিৎসকেরা বলছেন, ধরুন, ৩০ বা ৩২ বছর বয়সে ডিম্বাণু সংরক্ষণ করলেন, তা হলে ৩৮ বা ৩৯ বছরে গিয়ে মা হওয়া ততটা জটিল হবে না। তা ছাড়া, অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায়, স্বামীর স্পার্ম কাউন্ট কম বা শুক্রাণুর গণগত মান ভাল নয়। তখন ডিম্বাণু সংরক্ষণের কথা ভাবা যেতে পারে।