দেওঘরের বৈদ্যনাথ ধামে হাজির পূণ্যার্থীরা। পিটিআইয়ের ফাইল চিত্র।
ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে অপেক্ষা করতে করতে ওঁরা রাস্তাতেই শুয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। হঠাৎই রাত দু’টো নাগাদ কারা যেন খবর দিল মন্দিরের গেট খুলে গিয়েছে। ঘুম চোখে উঠেই শুরু হয়ে যায় আগে যাওয়ার হুড়োহুড়ি। আর সেই হুড়োহুড়িতেই পদপিষ্ট হয়ে মারা গেলেন ১১ জন পুণ্যার্থী। আহত ৫০।
রবিবার ভোর রাতে ঘটনাটি ঘটেছে দেওঘরের বৈদ্যনাথ মন্দির থেকে ১০ কিলোমিটার দূরে, বেলাবাগান মোড়ে। শ্রাবণের এই দ্বিতীয় সোমবারে ‘বাবাধামে’ শিবের মাথায় জল ঢালার জন্য দীর্ঘ লাইন পড়ে। মন্দির থেকে লাইন শুরু হয়ে তা দীর্ঘ হতে হতে বেলাবাগান মোড় ছাড়িয়ে যায়। স্থানীয় বাসিন্দা ও পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে, মন্দিরে ঢোকার জন্য তিনটে লাইন করা হয়েছিল। এর মধ্যে দু’টো লাইন রাতে একটু একটু করে এগোতে থাকে। মন্দিরের তিন নম্বর প্রবেশপথটি বন্ধ থাকায় তৃতীয় লাইনটি অনড় থাকে। তার ফলে লাইনে অপেক্ষমান ক্লান্ত ভক্তরা মাটিতে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। রাত ২টো নাগাদ শোনা যায়, গেট খুলেছে। লাইনও খুলে দেওয়া হয়েছে। তখনই সবাই হুড়মুড় করে এগোনোর চেষ্টা করতে থাকেন। ব্যারিকেড ভেঙে যায়। ঘুমচোখেই অনেকে হুমড়ি খেয়ে মাটিতে পড়ে যান। ঘটনাস্থলে পর্যাপ্ত আলো ছিল না বলেও অভিযোগ।
পুলিশ প্রশাসনের বক্তব্য, লাইন ভেঙে এগোতে গিয়েই এই বিভ্রাট। বিশৃঙ্খল পরিবেশ সামাল দিতে উপস্থিত পুলিশও হালকা লাঠিচার্জ করতে থাকে। এর ফলে এই হুড়োহুড়ি আরও বেড়ে যায়। দুর্ঘটনায় জখম, দুমকার বাসিন্দা বাদল শ্রীবাস্তব নামে এক পুণ্যার্থীর কথায়, ‘‘এত হুড়োহুড়ি শুরু হয়ে গেল যে আমার মোবাইল ফোনটা ছিটকে পড়ে। ফোনটা মাটি থেকে কুড়োতে গিয়ে ধাক্কাধাক্কিতে আমি মাটিতে পড়ে যাই। পড়ে যেতেই এক জন আমার পেটে পা দিয়ে চলে গেল। কোনও ক্রমে প্রাণে বেঁচেছি।’’
শিবের মাথায় জল ঢালার জন্য সোমবার পুণ্যার্থীদের ভিড় সব থেকে বেশি হয়। শ্রাবণী মেলার প্রথম সোমবার অর্থাৎ গত সোমবারই ভক্তের সংখ্যা এক লক্ষ ছুঁয়েছিল। দ্বিতীয় সোমবার অর্থাৎ এ দিন, সেই সংখ্যা দেড় লক্ষ ছাড়িয়ে যায়। শিবের মাথায় জল ঢালতে এই দেড় লক্ষ ভক্ত বিহারের ভাগলপুর জেলার সুলতানগঞ্জের গঙ্গা থেকে জল নিয়ে ১১৫ কিলোমিটার পথ হেঁটে রবিবারই দেওঘরে পৌঁছন। তার পর থেকেই লাইনে দাঁড়িয়ে তাঁদের প্রতীক্ষা শুরু হয়।
স্থানীয় মানুষজনের অভিযোগ, প্রয়োজনের তুলনায় পুলিশ ও মেলা কমিটির লোকজন অনেক কম ছিল। ভক্তদের অভিযোগ, গত সোমবারই এক লক্ষের মতো মানুষ জমায়েত হয়েছিল। দ্বিতীয় সোমবার ভিড় যে আরও বাড়বে, প্রশাসনের সেটা বোঝা উচিত ছিল। তা হলে কেন পর্যাপ্ত পুলিশ দেওয়া হয়নি? মনোজ সামন্ত নামে এক ভক্ত বলেন, ‘‘পুলিশ যে ব্যারিকেডগুলো লাইনের মাঝে মাঝে দিয়েছিল, তা-ও খুব বিভ্রান্তিকর। তাই অনেকে ব্যারিকেড ভেঙে এগোতে চেষ্টা করে। ভক্তদের জন্য যে সূচনা কেন্দ্র করা হয়েছিল, রাতে সেখানেও তেমন লোক ছিল না।’’ এডিজি এস এন প্রধান বলেন, ‘‘ঘটনাস্থলে পর্যাপ্ত পুলিশ ছিল কি না, কেন এ রকম বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি তৈরি হল, সেই বিষয় নিয়ে আমরা তদন্ত করে দেখছি। কারও গাফিলতি থাকলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’’
আহতদের দেওঘরের সদর হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। অভিযোগ, হাসপাতালে চিকিৎসকের সংখ্যা তখন এতই কম ছিল যে প্রথমে আহতদের চিকিৎসা শুরুই করা যায়নি। অসহায়ের মতো আহতরা হাসপাতালে পড়ে থাকেন কিছু ক্ষণ। এমনকী কয়েক জন আহতকে বাইরে থেকে ওষুধ কিনে আনতেও বলা হয় বলে অভিযোগ।
প্রতি বছরই দেওঘরের বৈদ্যনাথ ধামের শ্রাবণী মেলাকে কেন্দ্র করে ভক্তের সংখ্যা বাড়ছে। শুধু দেশ নয়, বিদেশ থেকেও লোকজন এই সময় দেওঘরে আসেন। ঝাড়খণ্ড সরকার জানিয়েছিল, এ বার পর্যাপ্ত ব্যবস্থাও নেওয়া হয়েছে। কিন্তু, বাস্তবে দেখা গেল, সবই হয়েছে খাতায়-কলমে।
২০১৩ সালে রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায় দেওঘরের মন্দিরে লাইন দিয়ে ঢোকার জন্য ও ভক্তদের বিশ্রামের জন্য ‘কিউ কমপ্লেক্সের’ শিলান্যাস করে গিয়েছিলেন। শিলান্যাসের পরে গত দু’বছরে অবশ্য একটি ইটও গাঁথা হয়নি। এ দিনের ঘটনার পরে অনেকের অভিমত, কিউ কমপ্লেক্স তৈরি হয়ে গেলে হয়তো এই দুর্ঘটনা এড়ানো যেত। ঘটনার কয়েক ঘণ্টা পরে অবশ্য একে একে ঘটনাস্থলে পদস্থ কর্তা ও মন্ত্রীরা আসতে থাকেন। শ্রমমন্ত্রী রাজ পলিবার বলেন, ‘‘প্রাথমিক অবস্থায় হাসপাতালে ওষুধের কম পড়েছিল, কিন্তু, পরে আহতদের ঠিক মতো চিকিৎসা করা হয়।’’ দেওঘরের ডেপুটি কমিশনার অমিত কুমার বলেন, ‘‘দুপুরের পর থেকে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে গিয়েছে। কোথায় কোথায় পরিকাঠামোর খামতি ছিল সেটা আমরা খতিয়ে দেখছি। আগামী তিনটে সোমবার হয়তো এর থেকেও বেশি ভিড় হবে। আর যাতে এমন ঘটনা না ঘটে সেই ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।’’ মুখ্যমন্ত্রী রঘুবর দাস জানিয়েছেন, ‘‘পরিস্থিতি স্বাভাবিক। মন্দিরে পুজো চলছে। নিহতের নিকটাত্মীয়দের দু’লক্ষ টাকা করে ও আহতদের ৫০ হাজার টাকা দেওয়া হবে। কয়েক জন আহতকে হেলিকপ্টারে করে রাঁচির রিমসেও নিয়ে আসা হচ্ছে।’’
সকাল থেকেই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ও কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিংহ দফায় দফায় পরিস্থিতির খোঁজ নেন। ঘটনায় প্রধানমন্ত্রী দুঃখপ্রকাশ করেছেন। এ দিন লোকসভাতেও বিষয়টি নিয়ে হইচই হয়। পরে রাজনাথ সভায় একটি বিবৃতি দেন। সেখানে তিনি ঘটনা বিবৃত করে বলেন, মুখ্যমন্ত্রীর অনুরোধে ভিড় সামাল দিতে কেন্দ্র অতিরিক্ত দু’কোম্পানি র্যাপিড অ্যাকশন ফোর্স দেওঘরে পাঠিয়েছে।