প্লাস্টিক-জাত বর্জ্যে ভরে উঠেছে গঙ্গা। ছবি: রয়টার্স।
‘প্যাকেজিং প্লাস্টিক’-জাত বর্জ্যের দূষণে বিপন্ন গঙ্গার জীববৈচিত্র। অস্তিত্বের প্রান্তসীমায় পৌঁছে গিয়েছে বেশ কয়েকটি জলজ প্রাণী-প্রজাতি! বন্যপ্রাণ গবেষণা বিষয়ক কেন্দ্রীয় সরকারি প্রতিষ্ঠান ‘ওয়াইল্ডলাইফ ইনস্টিটিউট অফ ইন্ডিয়া’ (ডব্লিউআইআই)-এর সাম্প্রতিক সমীক্ষায় উঠে এল এই তথ্য।
ওই সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে গঙ্গার মধ্য অববাহিকায় জীববৈচিত্রের নিরিখে সমৃদ্ধ অঞ্চলগুলিতে দূষণের মূল কারিগর প্যাকেজিং প্লাস্টিক-জাত বর্জ্য। ডব্লিউআইআই-এর গবেষক দলটি সমীক্ষার জন্য বেছে নিয়েছিল ঝাড়খণ্ডের সাহেবগঞ্জ জেলার লালবাথানি এবং রাধানগরের মধ্যবর্তী ৭৬ কিলোমিটারের গঙ্গা অববাহিকাকে। এর ঠিক উত্তরেই বিহারের কাহালগাঁও থেকে সুলতানগঞ্জ পর্যন্ত প্রায় ৭০ কিলোমিটার দীর্ঘ সংরক্ষিত অঞ্চল ‘বিক্রমশীলা গ্যাঞ্জেটিক ডলফিন স্যাঙ্কচুয়ারি’র অবস্থান। গাঙ্গেয় শুশুকদের সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে ভারতের প্রথম গড়ে তোলা হয়েছিল ওই নদীকেন্দ্রীক সংরক্ষিত অঞ্চলটি।
‘বিক্রমশীলা গ্যাঞ্জেটিক ডলফিন স্যাঙ্কচুয়ারি’র মতোই লালবাথানি-রাধানগর অঞ্চলও গঙ্গাতেও শুশুক, মসৃণ ত্বকের ভোঁদড়, ঘড়িয়াল, নানা প্রজাতির ‘বিপন্ন’ শ্রেণিভুক্ত কচ্ছপের বাসস্থান। বস্তুত, ৭৬ কিলোমিটার জুড়ে বিস্তৃত ওই এলাকার ৩৪ কিলোমিটারই জীববৈচিত্রের নিরিখে ‘সমৃদ্ধ অঞ্চল’ হিসেবে চিহ্নিত। সেখানে প্যাকেজিং প্লাস্টিকই (প্লাস্টিকের ব্যাগ, পলিথিনের প্যাকেট, বিভিন্ন খাদ্যসামগ্রির মোড়ক প্রভৃতি) দূষণের মূল অনুঘটক বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। ৫২ শতাংশেরও বেশি দূষণ ঘটছে এটি থেকে। দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে শক্ত প্লাস্টিকের টুকরো। গঙ্গা দূষণে অবদান ২৩ শতাংশের সামান্য বেশি। অন্য দিকে, ওই ‘জীববৈচিত্র সমৃদ্ধ অঞ্চলে’ তামাকজাত পদার্থ পাঁচ শতাংশ এবং ভাঙা কাপ-প্লেট-চামচের মতো গৃহস্থালি বর্জ্য সাড়ে চার শতাংশ দূষণ ঘটাচ্ছে বলে রিপোর্টে জানানো হয়েছে।
জীববিজ্ঞানীরা জানাচ্ছেন, বিভিন্ন গোত্রের ব্যাক্টেরিয়াই জলজ বাস্তুতন্ত্র এবং জীববৈচিত্রের মূল ভিত্তি। নদীর তলদেশবাসী সেই সব ব্যাক্টেরিয়া সামগ্রিক ভাবে বাস্তুতন্ত্রের হাল ধরে থাকে। কিন্তু দূষিত বর্জ্য নদীর তলদেশে জমলে সেখানকার ব্যাক্টেরিয়া-জগৎ সবার আগে নষ্ট হয়। আর তার প্রত্যক্ষ নেতিবাচক প্রভাব পড়ে গোটা জীবজগতের উপরেই। বস্তুত, ব্যাক্টেরিয়া ক্ষতিগ্রস্ত হলে জীববৈচিত্র ও বাস্তুতন্ত্রের ভিতটাই নড়ে যায়। ক্ষতিগ্রস্ত হয় জলজ মেরুদণ্ডী-অমেরুদণ্ডী প্রাণীকুল। এমনকি, নদীর দূষণ বাড়লে তার থাবা এড়াতে পারবেন না তীরবর্তী এলাকার মানুষজনও। লালবাথানি-রাধানগর অঞ্চলে দূষণের ফলে জীববৈচিত্রের ক্ষতির ৩৭,৭৩০টি নমুনা সংগ্রহ করেছেন ডব্লিউআইআই-এর গবেষকেরা।
দেশের পাঁচটি রাজ্যে ২৫২৫ কিলোমিটার যাত্রাপথ গঙ্গার। হাজারের বেশি গ্রাম পঞ্চায়েত এবং অর্ধশতাধিক শহরের উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া গঙ্গাকে পরিশুদ্ধ রাখতে ১৯৮৪ সালে কেন্দ্রের নির্দেশে তৈরি হয়েছিল গঙ্গা অ্যাকশন প্ল্যান (গ্যাপ)। ২০১১ সালে সেটির পরিবর্তে তৈরি হয় ন্যাশনাল মিশন ফর ক্লিন গঙ্গা (এনএমসিজি)। যার উদ্দেশ্য ছিল জাতীয়, রাজ্য এবং জেলা স্তরে পৃথক পৃথক কমিটি গড়ে গঙ্গাদূষণ ঠেকানো এবং নদীতে জলের প্রবাহ অক্ষুণ্ণ রাখা। কিন্তু তাতে কোনও ফল না মেলায় জাতীয় পরিবেশ আদালত একটি মামলার প্রেক্ষিতে গঙ্গাতীর সংলগ্ন পুরসভাগুলিকে নির্দেশ দেয়, তরল বর্জ্য ‘সুয়ারেজ ট্রিটমেন্ট প্লান্ট’-এর মাধ্যমে পরিশোধন করে গঙ্গায় ফেলতে। গুরুত্ব দিয়েছিল প্লাস্টিক বর্জ্য পৃথকীকরণেও। কিন্তু অভিযোগ, এর পরেও অধিকাংশ পুরসভা বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় কোনও পদক্ষেপ না করে সেগুলি অশোধিত অবস্থাতেই গঙ্গায় ফেলছে।