চিন-মডেল অনুসরণের দাওয়াই দিলেন বিশেষজ্ঞরা
Advantage Assam

অ্যাডভান্টেজ অসম: ২ দিনে লক্ষ কোটি টাকার চুক্তি

বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম পোশাক রফতানিকারক ও চামড়া বাজারের ৩ শতাংশের দখলদার বাংলাদেশে বিশ্বের তাবড় উৎপাদনকারীরা উৎপাদনকেন্দ্র খুলেছে।

Advertisement

রাজীবাক্ষ রক্ষিত

গুয়াহাটি শেষ আপডেট: ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ ১৯:৫০
Share:

মঞ্চে হাতে হাত রেখে একসঙ্গে চলে সকলের অর্থনৈতিক উন্নতিকর অঙ্গীকার করল আসিয়ান দেশগুলি। রয়েছেন অসমের মুখ্যমন্ত্রীও। ছবি- পীতাম্বর নেয়ার

অপছন্দ হলেও অনিবার্য। 'অ্যাডভান্টেজ অসম'-এর রাজপথ থেকে সভামঞ্চ- সর্বত্রই উপস্থিতি থেকে গেল চিনের। লগ্নি, নিরাপত্তা, সৌন্দর্যের ত্রিফলাকে তুলে ধরতে বিশ্ব বাণিজ্য সম্মেলেনর আসর বসেছে গুয়াহাটিতে। চিনা দ্রব্য বর্জনের হুমকি দেওয়া সরকারই গোটা শহর মুড়েছে চিনা আলোকসজ্জায়।

Advertisement

এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাঙ্কের কর্তা থেকে ভুটানের অর্থমন্ত্রী বা রাজ্যের অতিরিক্ত মুখ্য সচিব সকলেই বললেন, আসিয়ানের ৮০ কোটি মানুষের বাজার ধরতে গেলে চিন-মডেলই অনুসরণ করতে হবে। যে ভাবে ইউনান গত বিশ বছরে জিডিপি ১০ গুণ বাড়িয়েছে, যোগাযোগের উন্নতি, সদিচ্ছা ও পরিকাঠামো বিকাশ করলে তেমন উন্নতি করতে পারে অসমও- যে রাজ্যের মাথাপিছু আয় স্বাধীনতার সময় জাতীয় গড়ের চেয়ে বেশি ছিল।

মুখ্যমন্ত্রী সর্বানন্দ সোনোয়ালের আক্ষেপ, স্বাধীনতা ইংরাজ শাসন থেকে মুক্তি আনলেও অসমকে বাংলাদেশ তথা আসিয়ান দেশগুলি থেকে সড়ক-রেলপথে বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে। তার জেরেই থমকে গিয়েছে উন্নয়ন।

Advertisement

আরও পড়ুন: রোহিঙ্গা প্রশ্নে জাপানের হাত ধরতে চায় ভারত

আরও পড়ুন: বফর্সে টান ব্যর্থতা ঢাকতেই: কংগ্রেস

বিশ্ব বাণিজ্য সম্মেলনের শেষ দিন থিম দেশ ছিল বাংলাদেশ। সে দেশের শিল্পমন্ত্রী আমির হুসেন আমু ও বণিক সংগঠনের যৌথ মঞ্চ এফবিসিসিআই-এর সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্স শেখ ফজলে ফাহিম জানান, ভারতের সঙ্গে আগামী অর্থবষে সাত বিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে। সেখানকার কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্প ও গ্যাস প্রকল্পে বিনিয়োগ করছে ভারত। বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম পোশাক রফতানিকারক ও চামড়া বাজারের ৩ শতাংশের দখলদার বাংলাদেশে বিশ্বের তাবড় উৎপাদনকারীরা উৎপাদনকেন্দ্র খুলেছে। ফাহিম অসম ও ভারতের উৎপাদকদেরও সে দেশে কারখানা গড়ার আহ্বান জানান। বলেন, ২০২০ সালের মধ্যে দেশের জিডিপি ৮ শতাংশ বৃদ্ধি, এক কোটি ২৯ লক্ষ চাকরি ও ১০০ শতাংশ মানুষের হাতে মোবাইল পৌঁছে দেওয়া তাঁদের লক্ষ্য।

অসম থেকে বাংলাদেশ হয়ে ৭৬৫ কিলো ভোল্ট বিদ্যুতের লাইন পাতলে তার একাংশ বিদ্যুৎ বাংলাদেশ পাবে। ৪০ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে অসমের শদিয়া থেকে বাংলাদেশের চট্টগ্রাম পর্যন্ত ব্রহ্মপুত্র ড্রেজিং হবে। প্রকল্পগুলির জন্য ভারত সরকারকে ধন্যবাদ দেন আমু। ফাহিম মেনে নেন, গত এক দশকে বাংলাদেশ ভারত থেকে যে পরিমাণ আমদানি করেছে সেই তুলনায় রফতানি একেবারেই বাড়েনি। তাই বাণিজ্য সম্মেলনের মঞ্চ থেকে তিনি অসমকে সার, প্রসাধনী, ওষুধ, সেরামিক দ্রব্য, জুতো ও চর্মজাত দ্রব্য, প্লাস্টিক, বৈদ্যুতিন সামগ্রী, পাট, শুকনো মাছ ও অবশ্যই জামদানি শাড়ি নেওয়ার প্রস্তাব দেন। পাশাপাশি অসম থেকে চা, মশলা, অপরিশোধিত তেল, গ্যাস, জলবিদ্যুৎ, পাথর চাইছে বাংলাদেশ। নির্মাণ, রাসায়নিক সার, বিদ্যুৎ উৎপাদন ও পর্যটনে যৌথ উদ্যোগের আহ্বান জানান বাংলাদেশের প্রতিনিধিরা।

এক নজরে অ্যাডভান্টেজ অসম

• দু'দিনে মোট ২০০ চুক্তি, প্রস্তাবিত লগ্নির পরিমাণ প্রায় এক লক্ষ কোটি টাকা

• পলাশবাড়িতে টেক সিটির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন কেন্দ্রীয় তথ্য-প্রযুক্তি মন্ত্রী রবিশঙ্কর প্রসাদ। ১২০ কোটি টাকার এই প্রকল্পে আট হাজারের কর্ম সংস্থান হবে

• মাজুলি, কোকরাঝাড়, শিলচর, ডিফু ও নগাঁওতে বিপিও হবে। তথ্য-প্রযুক্তি ক্ষেত্রে ৩২টি চুক্তি স্বাক্ষর হয়েছে। বিনিয়োগ হবে প্রায় হাজার কোটি

• ওলা গুয়াহাটিতে ব্রহ্মপুত্রের বুকে অ্যাপ নির্ভর রিভার ট্যাক্সি পরিষেবা চালু করার চুক্তি করল, এমন পরিষেবা দেশের মধ্যে প্রথম, ১২,০০০ বেকারের প্রশিক্ষণ ও চাকরির জন্য ওলার সঙ্গে চুক্তি

• তিনটি দক্ষতা বৃদ্ধির মেগা সেন্টার তৈরি হবে। এডিবির সহায়তায় গড়ে উঠবে ১২টি দক্ষতা বৃদ্ধি প্রতিষ্ঠান

• নির্মাণ, নৌ ও স্বাস্থ্যকেন্দ্র তিনটি উৎকর্ষকেন্দ্র স্থাপন

• চা শিল্পের ক্ষেত্রে চা পাতা শুকোনোর মাইক্রোওয়েভ পদ্ধতি, ইউনিভার্সার মাইক্রোওয়েভ বেসড ময়েশ্চার মিটার ও রেডিও তরঙ্গ ভিত্তিক সংক্রমণরোধ পদ্ধতির উদ্বোধন হয় আজ

• সুভাষ ঘাইয়ের সঙ্গে হাত মিলিয়ে রাজ্যে মেগা মিডিয়া ইনস্টিটিউট খোলার ব্যাপারে আলোচনা শুরু

• পবন হংস গোষ্ঠীর একটি প্রযুক্তি প্রশিক্ষণকেন্দ্র তৈরি নিয়ে আলোচনা

দুই বাংলার যৌথ উদ্যোগে ছবি তৈরির ক্ষেত্রে সম্প্রতি কিছু সমস্যা দেখা দিয়েছে। ফাহিম বলেন, "আমাদের মূল সমস্যা হল দেশে ডিস্ট্রিবিউশন নেটওয়ার্ক নেই। নতুন করে তা তৈরি করা হচ্ছে। যৌথ উদ্যোগে পশ্চিমবাংলা বা অসমের সঙ্গে বাংলাদেশে ছবি তৈরি হওয়াকে সব সময়ই স্বাগত। কিন্তু যৌথ থেকে যৌথই হয়। দুই দেশের মধ্যে প্রযুক্তি ও শিল্পের আদানপ্রদান, দক্ষতাবৃদ্ধির দিকে নজর রাখতে হবে।"

বাংলাদেশের কৃষি প্রক্রিয়াকরণ গোষ্ঠী বাপার সভাপতি ফকরুল ইসলাম মুন্সি ও ফাহিম বিশেষ জোর দেন বন্দর বাণিজ্যের উপরে। বলেন, অসম-চট্টগ্রাম জলপথ বাণিজ্য শুরু হলে বিপুল পরিমাণ শস্য, পণ্য কম খরচে চট্টগ্রাম যাবে। অ্যাডভান্টেজ অসমের মঞ্চ থেকে গত কাল ভুটান যেমন নিজেদের দেশের বিনিয়োগ সম্ভাবনা তুলে ধরেছিল, বাংলাদেশও তাদের দেশে লগ্নির ক্ষেত্রে অনেক নীতির কথা ঘোষণা করে জানায়, ২০২২ সালের মধ্যে তাদের দেশ শিল্পোন্নত হয়ে উঠবে।

রাজ্যের অতিরিক্ত মুখ্য সচিব রবি কপুর বলেন, স্থল পরিবৃত হওয়ায় যে সুবিধা ইউনানের মাধ্যমে চিন নিতে পেরেছে তা অসম পারেনি। বিদেশ মন্ত্রকের যুগ্ম সচিব অনুরাগ ভূষণ জানান— কম্বোডিয়া, লাও পর্যন্ত সড়কপথ চালু হচ্ছে। আসিয়ান দেশগুলিকে গুয়াহাটির সঙ্গে সড়ক ও বিমানে জোড়া হবে। কম্বোডিয়া, লাও, ভিয়েতনামে পণ্যবাহী জাহাজ পাঠানো হবে। আসিয়ান দেশে উৎপাদিত সামগ্রী ভারতে এবং ভারতে উৎপাদিত সামগ্রী স্থলপথে আসিয়ান দেশগুলিতে রফতানি হলে শুল্কছাড়ের বিষয় নিয়ে আলোচনা চলছে। তেমন হলে সব দেশ উপকৃত হবে। নীতি আয়োগের চেয়ারম্যান অমিতাভ কান্তের পরিচালনায় হওয়া বণিক সভায় গুয়াহাটির সঙ্গে আসিয়ান দেশগুলির বিমান যোগাযোগ অবিলম্বে শুরু করার উপরে প্রধান জোর দেওয়া হয়।

এয়ার ডেকানের সিইও ক্যাপ্টেন গোপীনাথ বলেন, "বড় বিমানবন্দরে নতুন ভবন নির্মাণ না করে এখন ছোট ছোট ও স্বচ্ছ বিমানবন্দর তৈরিতে মন দেওয়ার সময় এসেছে।"

এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাঙ্কের কান্ট্রি ডিরেক্টর কেনিচি ইয়োকোহামা জানান, আসিয়ান দেশগুলির ৮০০ বিলিয়ন (৮০,০০০ কোটি) ডলারের বাজার অসমের জন্য অপেক্ষা করছে। অসম সন্তান তথা লাও পিডিআরের প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী হাবিব চৌধুরী তাঁর অসম থেকে দুবাই ও সেখান থেকে লাও গিয়ে ব্যবসা প্রসারের কথা শোনান। কম্বোডিয়ার পর্যটনমন্ত্রী, মায়ানমারের বাণিজ্যমন্ত্রী, ভুটানের অর্থমন্ত্রীরা বাণিজ্য বিস্তারের বিভিন্ন সম্ভাবনা তুলে ধরেন।

অসমের মুখ্যমন্ত্রী সর্বানন্দ সোনোয়াল বলেন, এক সময় দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া থেকে এসেই তাই রাজা স্যুকাফা আহোম সাম্রাজ্য গড়ে তোলেন। সেই সমৃদ্ধি ও যোগাযোগ বজায় ছিল ভারত স্বাধীন হওয়া পর্যন্ত। তার পরেই অসমের সঙ্গে রেল-সড়ক-জলপথ যোগাযোগ বন্ধ হতে থাকায় অসমের অর্থনীতি বড় ধাক্কা খায়। তিনি সব আসিয়ান দেশকে গুয়াহাটিতে কনসুলেট খোলার অনুরোধ জানান।

এ দিনের অন্যতম মুখ্য আকর্ষণ ছিল ওলার সঙ্গে রাজ্য জলপথ পরিবহণ দফতরের রিভার ট্যাক্সির চুক্তি। দেশের মধ্যে প্রথম এই ধরণের পরিষেবা শুরু হল। অ্যাপ ভিত্তিক ট্যাক্সি বুক করে যাত্রীরা ব্রহ্মপুত্রের এপার-ওপারে এক ঘণ্টার সড়কযাত্রা জলপথে মাত্র দুই থেকে পাঁচ মিনিটে পার করতে পারবেন। বিমানবন্দর যাওয়ার সময়ও কমে অর্ধেক হয়ে যাবে। ফেরি ঘাট থেকে কনেকটিং ওলা ক্যাবের ব্যবস্থাও থাকবে। রাজ্যের পরিবহণমন্ত্রী চন্দ্রমোহন পাটোয়ারি বলেন, "রাজ্য তথা দেশের জলপথ পরিবহণের ক্ষেত্রে এ এক উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ। জলপথ পরিবহণে অন্যান্য রাজ্যকে পথ দেখাতে পারে অসম।" ওলার ভাইস প্রেসিডেন্ট বিজয় ঘাটগে জানান, প্রথম দিকে গুয়াহাটির লাচিত ঘাট থেকে যাত্রা করবে হাই স্পিড ওয়াটার ট্যাক্সিগুলি। দেশের জলপথ পরিবহণে এই চুক্তি নতুন দিগন্ত খুলে দেবে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন