ছবি সৌজন্যে টুইটার।
গুয়াহাটির পাঁচ তারা হোটেলে বসেই উত্তর-পূর্বের ৬ রাজ্য সামলাচ্ছেন। এখনও খোলা হয়নি দূতাবাসের নিজস্ব দফতর। মার্চ থেকে মে— দু'মাসের মধ্যেই খুঁজে বের করে ফেলেছেন অসম-বাংলাদেশের মধ্যে চলতে থাকা টেনশনের চোরাস্রোতের প্রধান কারণ। যে পুশ-ব্যাক পদ্ধতিতে এত বছর ধরে সনাক্ত হওয়া বাংলাদেশিদের ফেরত পাঠিয়ে আসছে অসমের সরকার- সেই পদ্ধতিই ভুল বলে মত বাংলাদেশের সহকারী হাই-কমিশনার কাজি মুনতাসির মুর্শেদের। আনন্দবাজারের সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে তিনি তুলে ধরলেন তাঁর ভবিষ্যতের রোড-ম্যাপ।
সেই বাংলাদেশ থেকে উজিয়ে গুয়াহাটি এসে সহকারী হাই-কমিশনারের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন এক বৃদ্ধ। জানান, তাঁর মেয়ে-জামাই-নাতি বন্দি আছে তেজপুরের কারাগারে। ভিসার মেয়াদ পার হওয়ার পরেও না ফেরায় গ্রেফতার হয়েছিলেন তাঁরা। কারাবাসের মেয়াদ পেরিয়েছে। কিন্তু দেশে ফেরার রাস্তা পাচ্ছেন না। খবর নিতে শুরু করেন মুর্শেদ। তখনই জানতে পারেন, অসমের বিভিন্ন কারাগার আর ডিটেনশর শিবিরে বন্দি আছেন সহস্রাধিক বাংলাদেশি। কিন্তু তার কোনও তথ্যই নিয়ম মতো তাঁর হাতে তুলে দেয়নি পুলিশ। এখন নিজেই উদ্যোগ নিয়ে পুলিশের কাছ থেকে সব তথ্য জোগাড় করছেন মুর্শেদ। তিনি জানান, আপাতত তেজপুরের জেলে গিয়ে ওই পরিবার ও বন্দি আরও এক বাংলাদেশির দেশে ফেরার ব্যবস্থা করবেন তিনি। তারপর শুরু করবেন রাজ্যের অন্য জেল ও ডিটেনশন শিবিরে ঘুরে বাংলাদেশিদের সঙ্গে কথা বলা। শুরু হবে তাঁদের ফেরত পাঠানোর ব্যবস্থা।
বাংলাদেশিদের ফেরত পাঠানো নিয়ে অসমে সব বিধানসভা অধিবেশনেই বিতর্ক চলে। রাজ্য সরকারের বক্তব্য বাংলাদেশের সঙ্গে প্রত্যার্পণ চুক্তি না থাকায় বাংলাদেশিদের ফেরত পাঠানো সমস্যার। মন্ত্রী চন্দ্রমোহন পাটোয়ারির হিসেবে, এই সরকারের আমলে মোট ৪০২২ জন বাংলাদেশিকে শনাক্ত করা হয়েছে, তার মধ্যে ফেরত পাঠানো হয়েছে মাত্র ৩০ জনকে। ১৯৮৬ সাল থেকে শনাক্ত হওয়া বাংলাদেশির সংখ্যা ৭৯,৭৭১। মাত্র ২৯,৭২৯ জনকে বাংলাদেশ পাঠানো হয়েছে।
মুর্শেদ বলেন, পদ্ধতিতেই ভুল ছিল। "বাংলাদেশি ধরলে পুলিশের উচিত নিকটবর্তী দূতাবাস দফতরে খবর দেওয়া। দূতাবাস ধৃত ব্যক্তির পরিচয় নিশ্চিত করার পরে তাকে ফেরানোর ব্যবস্থা করে। আমি দায়িত্ব নেওয়ার পরে সরকারিভাবে রাজ্যে ধৃত বাংলাদেশিদের ব্যাপারে আমায় কোনও তথ্য দেওয়া হয়নি। তাই আমিই এবার পুলিশের সীমান্ত শাখার কাছে তথ্য চেয়ে পাঠিয়েছি। তা এলে, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রকের অনুমতি নিয়ে আমি জেল বা ডিটেনশন শিবিরে গিয়ে কথা বলব।" ধৃতের পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করে তাদের ফেরত পাঠানো হবে। এতদিন দূতাবাসের দফতর না থাকার পদ্ধতিটি এলোমেলো ছিল। তাঁর আশা, এবার ধীরে সব নিয়মমাফিক ও দ্রুত হবে।
আরও পড়ুন:সেনাঘাঁটির কাছে বেওয়ারিশ ব্যাগ, ফের হাই অ্যালার্ট পঠানকোটে
কিন্তু যারা ফিরতে চান না বা ভিটেমাটি বিক্রি করে চলে এসেছেন- তাদের কি হবে? যাদের ফেরার টাকা নেই তাদের খরচ বহন করবে কে?
মুর্শেদ জানান, কেউ ফিরতে না চাইলে জোর করে পাঠানোর উপায় নেই। সেক্ষেত্রে তিনি ডিটেনশন শিবিরে থাকবেন। টাকার অভাব হলে বিদেশ মন্ত্রক সাহায্য করে থাকে। তিনি শিবির ঘুরে বাংলাদেশিদের জন্য ওয়ান ওয়ে ট্রাভেল পারমিট ইস্যু করবেন। তার ভিত্তিতেই বাংলাদেশিদের ওপারে গ্রহণ করা হবে।
দেদার অনুপ্রবেশের অভিযোগ নিয়ে মুর্শেদের প্রশ্ন, বাংলাদেশে দিন মজুরি করলে অন্তত ৫০০-৬০০ টাকা মেলে, যা ভারতের দ্বিগুণ। তাহলে টাকা কামাতে সেদেশের গরিবরা এখানে আসবেন কেন? তাঁর দাবি, হিন্দুদের উপরে বাংলাদেশে কোনও অত্যাচার হচ্ছে না। তাই কোথাও বিক্ষিপ্ত ঘটনা ঘটে থাকলেও হিন্দুদের দলে-দলে পালিয়ে আসার খবর সত্যি হতে পারে না।
বর্ধমানের খাগড়াগড় বিস্ফোরণের পরে এ দেশের বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম যে ভাবে জেএমবিকে কট্টর জঙ্গি সংগঠন হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে তার বিরোধিতা করে মুর্শেদ বলেন, “জেএমবির তেমন কোনও শক্তিই নেই। ভারতে তো দূরের কথা বাংলাদেশেই বড় নাশকতা ঘটানোর ক্ষমতা নেই তাদের।”
মুর্শেদের কথায়, "বাংলাদেশ-অসমের মধ্যে টানাপড়েনের সম্পর্ক কাটিয়ে পর্যটন, বাণিজ্য, রাজনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে দ্বিপাক্ষিক মিত্রতা বাড়ানোই আমার প্রথম লক্ষ্য হবে।" তিনি আপাতত বেশি জোর দিচ্ছেন অসম-বাংলাদেশের সরাসরি বিমান যোগাযোগ, পর্যটন ও বাণিজ্য বৃদ্ধিতে।
সেই ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে অসম থেকে ঢাকা পর্যন্ত পরীক্ষামূলকভাবে সরসারি বাস চলে। কিন্তু তার পর থেকে সেই পরিষেবা আর চালু হয়নি। মুর্শেদ অদূর ভবিষ্যতেও সরাসরি বাস চালু হওয়ার আশা দেখছেন না। কারণ, মেঘালয়ের দিকে দাওকি সীমান্তের কাছে পাহাড়ি পথে রাস্তা সরু ও খারাপ। সেখানে বড় ভলভো বাস চলা সমস্যার। সেই সঙ্গে নিয়মিত, পর্যাপ্ত পর্যটকেরও অভাব রয়েছে। তিনি জানান, বাংলাদেশের 'নোভো' বিমান সংস্থার সঙ্গে কথা এগিয়েছে। গুয়াহাটি-ঢাকা-ব্যাঙ্কক এবং সিঙ্গাপুর রুটে সপ্তাহে তিন দিন উড়ানের প্রস্তাব দিয়েছেন তিনি। ভারত-বাংলাদেশ জলপথ পরিবহণে বরং সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন মুর্শেদ।
তিনি জানান, গত দু'মাসে সাড়ে তিনশো ভিসার আবেদন পেয়েছেন তিনি। এসেছে পর্যটক ও ব্যবসায়ী দু'ধরণের আবেদনই। অসম থেকে বাংলাদেশে চা, বিশেষ করে 'গ্রিন টি' রফতানিতে উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ দেখছেন মুর্শেদ। তিনি বলেন, "এক সময় শ্রীহট্টের চা বিখ্যাত ছিল। আমরা চা রফতানি করতাম। এখন আমাদের চা আমদানি করতে হয়। সড়কপথে অসম থেকে শ্রীহট্ট যেতে এখন ঘণ্টা ৫-৬ লাগে। তাই সহজেই অসম থেকে বাংলাদেশে চা রফতানি করা যায়। রফতানি করা যায় কয়লা, মোম-পেট্রলজাত দ্রব্যও। কিন্তু সড়কপথে মেঘালয়ে 'সিন্ডিকেট'-এর সমস্যা বড় জট। সে ক্ষেত্রে জলপথ সস্তাও হয়, চেকপোস্ট বা সিন্ডিকেটের ঝামেলাও থাকে না।"
অসম থেকে ইতিমধ্যে 'মেডিক্যাল ট্যুরিজম'-এর প্রস্তাব পেয়েছেন মুর্শেদ। অনেকে বলেছেন, বাংলাদেশের মানুষ চিকিৎসার জন্য কলকাতা যান। কিন্তু অসমেও অনেক মেডিক্যাল কলেজ হচ্ছে। তৈরি হবে এইমস। তাই একই সঙ্গে চিকিৎসা ও বেড়ানোর জন্য বাংলাদেশ মানুষকে অসমমুখী করা যেতে পারে। মুর্শেদের ইচ্ছে চট্টগ্রামের সমুদ্র, মেঘালয়ের পাহাড়, অসমের অরণ্যকে এক করে একটি 'ট্যুরিজম সার্কিট' গড়ে উঠুক। বাণিজ্য ও পর্যটন বিকাশ নিয়ে তিনি রাজ্যের মন্ত্রীদের সঙ্গে শীঘ্রই বৈঠক করবেন। দেখা করবেন অন্য পাঁচ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীদের সঙ্গেও।