Coronavirus Lockdown

‘শৈশবের এই অপচয় না হলে চলতেই থাকবে’

কেন্দ্রীয় সরকারের সমীক্ষা বলছে, ২০০৫ সালে শিশুমৃত্যুর হার (ইনফ্যান্ট মর্টালিটি রেট  বা আইএমআর) ছিল প্রতি হাজারে ৫৭, ২০১৬ সালে তা দাঁড়িয়েছে ৪১-এ।

Advertisement

দেবাশিস ঘড়াই

কলকাতা শেষ আপডেট: ১৮ জুন ২০২০ ০৬:০৩
Share:

করোনা-গ্রাসে: ‘সাহায্যপ্রার্থী’র সরণিতে ওরাও। ছবি: সুমন বল্লভ

বিচারক ছেলেটিকে প্রশ্ন করেছিলেন, কেন সে নিজের বাবা-মাকে আদালতে অভিযুক্ত করতে চাইছে? নিস্পৃহ স্বরে ছেলেটি বলেছিল, ‘কারণ, আমি জন্মেছি বলে।’ বারো বছরের ছেলেটি আরও জানিয়েছিল, সে ভাল মানুষ হতে চেয়েছিল। সম্মান চেয়েছিল, ভালবাসা চেয়েছিল। পরিবর্তে পেয়েছিল ঘৃণা, তাচ্ছিল্য, অবজ্ঞা। শুধুমাত্র দরিদ্র পরিবারে জন্মানোর জন্য। ছেলেটির নিজের কথায়, ‘আমার জীবনটা পায়ের জুতোর থেকেও নোংরা।’

Advertisement

দু’বছর আগে কানে জুরি পুরস্কার জয়ী ‘ক্যাপারনাম’ সিনেমাটি লেবাননের এক কিশোর ও তার জীবনকে এ ভাবেই তুলে ধরেছিল। পরিচালক নাদিন লাবাকি বলেছিলেন, “সিনেমাটির পটভূমি লেবানন হলেও আসলে এটি সর্বজনীন সেই ছোটদের জীবনের গল্প, যারা তাদের প্রাপ্য মৌলিক অধিকারটুকু পর্যন্ত পায় না!”

তখনও করোনা সংক্রমণ আসেনি। তখনও জানা যায়নি, দু’বছর পরে, অর্থাৎ ২০২০ সালের শেষে শুধুমাত্র করোনা বিপর্যয়ের কারণে সারা বিশ্বের আরও ৮ কোটি ৬০ লক্ষ শিশু-কৈশোর দারিদ্রের অশুভ গ্রাসে পড়বে। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক অজিতাভ রায়চৌধুরীর কথায়, ‘‘প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে সুষম খাদ্যের কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু যাঁদের রুটিরুজিই অনিশ্চিত, তাঁরা কী ভাবে সেই সংস্থান করবেন? ফলে সব মিলিয়ে একটা অশুভ বৃত্ত তৈরি হয়েছে।’’ যে বৃত্ত গ্রাস করেছে শৈশব-কৈশোরকে। পরিসংখ্যান বলছে, বছরের শেষে সারা বিশ্বের নিম্ন ও নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারের ৬৭ কোটি ২০ লক্ষ শিশু-কিশোরের জীবন বিপর্যস্ত হতে চলেছে করোনার কারণে।

Advertisement

আরও পড়ুন: এক বস্তিতেই আক্রান্ত ১৬ জন, তা-ও ফেরেনি হুঁশ

অবশ্য সে জীবনের সঙ্গে অনিশ্চয়তার সম্পর্ক তো সেই জন্মসূত্রে। কেন্দ্রীয় সরকারের সমীক্ষা বলছে, ২০০৫ সালে শিশুমৃত্যুর হার (ইনফ্যান্ট মর্টালিটি রেট বা আইএমআর) ছিল প্রতি হাজারে ৫৭, ২০১৬ সালে তা দাঁড়িয়েছে ৪১-এ। আবার ২০০৫ সালে পাঁচ বছরের নীচে শিশুমৃত্যুর হার (আন্ডার ফাইভ মর্টালিটি রেট) প্রতি হাজারে ছিল ৭৪, ২০১৬ সালে তা হয়েছে ৫০। এক গবেষকের কথায়, ‘‘শিশুমৃত্যুর হার দেখে সংশ্লিষ্ট দেশের কেন্দ্রীয় সরকারের সামাজিক, প্রশাসনিক নীতি ও তার প্রয়োগ সম্পর্কে মোটামুটি একটা ধারণা করা যায়। সেখানেই প্রশ্ন রয়েছে ভারতের অবস্থান নিয়ে। বর্তমান পরিস্থিতিতে সেই প্রশ্নই আরও বড় হয়ে উঠেছে।’’

পরিসংখ্যান দিয়ে গবেষকেরা বলছেন, ২০১৫-’১৬ সালেই দেখা গিয়েছিল, কী ভাবে দেশের ৬-২৩ মাসের শিশুদের মাত্র ৯.৬ শতাংশ দৈনিক ন্যূনতম পুষ্টিকর খাদ্য পায়। ফলে বর্তমান সার্বিক অনিশ্চয়তায় দরিদ্র-নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের শিশুদের কী অবস্থা, তা সহজেই অনুমেয় বলে জানাচ্ছেন তাঁরা।

আরও পড়ুন: বিমানবন্দরের মেঝেতেই পিপিই ফেলছেন বহু যাত্রী

টাটা ইনস্টিটিউট অব সোশ্যাল সায়েন্সেস-এর ‘সেন্টার ফর ডেভেলপমেন্ট প্র্যাক্টিস অ্যান্ড রিসার্চ’-এর চেয়ারপার্সন-অধ্যাপক পুষ্পেন্দ্রকুমার সিংহ বলছিলেন, ‘‘করোনা সংক্রমণের আগে নিম্নবিত্ত পরিবারগুলির এই প্রত্যাশাটুকু ছিল, তারা যা পারেনি তাদের সন্তান ঠিক পারবে। কিন্তু করোনা ভবিষ্যৎকে ভু‌লিয়ে বর্তমানের টিকে থাকাকেই মুখ্য করে তুলেছে।’’

সমাজতত্ত্ববিদদের একটি অংশের বক্তব্য, দেশের যে কোনও শহরেই দেখা যাবে, কী ভাবে ফুটপাতেই অগুনতি শিশু জন্মাচ্ছে, বড় হয়ে উঠছে। আবার তাদের পরবর্তী প্রজন্মও বড় হচ্ছে সেই ফুটপাতেই! ‘ইন্ডিয়ান সোশিয়োলজিক্যাল সোসাইটি’র অন্যতম আহ্বায়ক অধ্যাপক মহেশ শুক্লের কথায়, ‘‘করোনা বোঝাল যে পরিবার পরিকল্পনা নীতির সঙ্গে সমাজের সব স্তরকে যুক্ত করতে হবে। শৈশবের এই অপচয় না হলে চলতেই থাকবে।” ‘ক্যাপারনাম’-এ বিচারক কিশোরটির কাছে জানতে চেয়েছিলেন, সে তার বাবা-মায়ের কাছ থেকে কী চায়? ছেলেটি বলেছিল, ‘আমি চাই ওরা যেন আর সন্তানের জন্ম না দেয়!’ আসলে

অর্থনীতি-সমাজনীতি-পরিবারনীতি সংক্রান্ত কঠিন তত্ত্ব না-জানা কিশোরটি নিজের জীবন দিয়ে বুঝেছিল, দারিদ্র এমন এক অশুভ শক্তি, যা ছোটদের এক ধাক্কায় বড় করে দেয়, যেখানে ছোটবেলা বলে কিছু থাকে না। শুধু থাকে দাঁতে-দাঁত চেপে টিকে থাকার লড়াই আর সেটাই প্রতিনিয়ত করে যেতে হয়!

মাঝেমধ্যেই করোনা বা অন্য কোনও বিপর্যয় এসে সেই লড়াইকেই আরও অনেক, অনেকটাই কঠিন করে তোলে!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন