National News

নাম ধরে নয়, সুরে সুরেই ডাকাডাকি হয় এ গ্রামে

কথায় বলে নামে কি আসে যায়। সেটাকেই কাজে করে দেখান চেরাপুঞ্জি থেকে ৫৬ কিলোমিটার দূরে থাকা পূর্ব খাসি পাহাড়ে কং থং গ্রামের বাসিন্দারা। এখানে সকলেই সকলকে ডাকেন নাম ধরে নয়, সুরে-সুরে। সকলের জন্য রয়েছে পৃথক নামের সুর! এক জনের ডাকে মোটেই অন্য জন ভুল করে সাড়া দেন না।

Advertisement

রাজীবাক্ষ রক্ষিত

গুয়াহাটি শেষ আপডেট: ২০ সেপ্টেম্বর ২০১৭ ১৬:০৩
Share:

চলছে আড্ডা। —নিজস্ব চিত্র।

ঘর থেকে মা সুর তোলেন, কুকু উ কুকুর রু....। পাহাড়ি পথের বাঁকে বন্ধুদের সঙ্গে তখন গল্পে মত্ত কুকু উ কুকুর রু। মায়ের ডাক কানে যেতেই বন্ধু ইউউ উ উই... আর আআই উউ কুকু..কে বিদায় জানিয়ে ঘরের পথ ধরে কুকু উ কুকুর রু।

Advertisement

কথায় বলে নামে কি আসে যায়। সেটাকেই কাজে করে দেখান চেরাপুঞ্জি থেকে ৫৬ কিলোমিটার দূরে থাকা পূর্ব খাসি পাহাড়ে কং থং গ্রামের বাসিন্দারা। এখানে সকলেই সকলকে ডাকেন নাম ধরে নয়, সুরে-সুরে। সকলের জন্য রয়েছে পৃথক নামের সুর! এক জনের ডাকে মোটেই অন্য জন ভুল করে সাড়া দেন না।

কংথং ট্যুরিজম কো-অপারেটিভ সোসাইটির চেয়ারম্যান রোথেল খংসিট জানান, বহু যুগ ধরে, এই গ্রামের গর্ভবতী মায়েরা পাহাড়-জঙ্গলে কান পেতে পাখির ডাক, ঝর্নার শব্দ থেকে সুর বোনেন। সন্তান জন্মের পরে, সেই সুর তার কানের কাছে গুনগুন করা হয়। সুর থেকে জন্ম নেয় গান। যার নাম ‘জিংগারওয়াই লেওবেই।’ আর ওই গানের প্রথম অক্ষর আর তার সুরটাই হয়ে যায় সন্তানের নাম। শিশুও জন্মের পরে তার নামের ‘জিংগারওয়াই লেওবেই’টাই আগে আওড়াতে শেখে।

Advertisement

আরও পড়ুন

প্রবল বৃষ্টিতে নাজেহাল মুম্বই!

এই সেই গ্রাম। —নিজস্ব চিত্র।

ছবির মতো কংথং গ্রামে এখন বাসিন্দার সংখ্যা প্রায় ৭০০। পাহাড়ি নদীর উপরে রাবার গাছের শেকড়ে তৈরি ‘জীবন্ত সেতু’ পার করে চলে যাতায়াত। দূর থেকে নামের সুর শুনেই সবাই বুঝে যান কে কাকে ডাকছে! গ্রামের প্রবীণরা জানান, আগেকার দিনে শিকারের সময় এই ভাবে নাম ডাকার শুরু। সেই প্রথাই চলছে। শুধু নাম-গান নয় তার সঙ্গে এক লোকগাথা ও স্বয়ম্বর ধাঁচের প্রথাও জড়িয়ে। প্রতি বছর গ্রীষ্মকালের নির্দিষ্ট পূর্ণিমায় গ্রামের অবিবাহিত নারী-পুরুষ আগুন জ্বেলে গানের আসর বসায়। যে ছেলে সবচেয়ে ভাল গান গায়, সে গ্রামের সবচেয়ে সুন্দরী কুমারীকে বিয়ে করার অধিকার পায়।

আরও পড়ুন

উদ্বোধনের আগেই ভেঙে পড়ল ৩৮৯ কোটির বাঁধ!

আগেকার দিনে শিকারের সময় এই ভাবে নাম ডাকার শুরু হয় এ গ্রামে।

অবশ্য সভ্যতার দাবি মেনে, আজকাল গ্রামবাসীদের খাতায়-কলমে খাসি নামও রাখা হচ্ছে। কিন্তু সেই নাম শুধুই স্কুল বা অফিসের কাজে লাগে। কোনও ব্যক্তি মারা গেলে, তাঁর নামের সুর আর গানও তাঁর সঙ্গেই শেষ হয়ে যায়। ওই সুর অন্য কেউ চালিয়ে যেতে পারবেন না।

‘জিংগারওয়াই লেওবেই’-এর কোনও লিখিত স্বরলিপি হয় না। কিন্তু বর্তমান প্রজন্ম নিজেদের নাম সুর করে গেয়ে মোবাইলে রেকর্ড করে রাখছে। দরকার মতো হোয়াট্স অ্যাপে সেই সুরের নামও পাঠানো যাচ্ছে। প্রবীণদের আক্ষেপ, এ ভাবে নবীনরা শুধু নিজের নামই মনে রাখছে, অন্যের নাম তো রেকর্ড করা হয় না। তাই আগের মতো সকলেই সকলের নাম মনে রাখার প্রথাও এই প্রজন্ম চালিয়ে যেতে পারবে কী-না সন্দেহ।

কংথং গ্রামে এখন বাসিন্দার সংখ্যা প্রায় ৭০০।

এমন আজব নাম-গানের গ্রামের বাসিন্দা দুই বিবাহিতা বোন সিডিয়াপ খংসিট ও সিথোহ খংসিটের জীবন নিয়ে স্বল্পদৈর্ঘ্যের ছবি ‘মাই নেম ইজ ইউউউউ’ বানিয়েছেন মণিপুরি পরিচালক ওইনাম দোরেন। দেখানো হয়েছে, তাঁদের ছেলেমেয়েরা পড়াশোনার জন্য শিলং শহরে গিয়ে নগর সভ্যতা, পশ্চিমী রক গানের সংস্পর্শে আসার পরেও কী ভাবে বেঁচে থাকে ‘জিংগারওয়াই লেওবেই’। দেশ-বিদেশে পুরস্কার জেতা ওই ছবি দেখার জন্য রাজ্যপাল বনোয়ারিলাল পুরোহিত রাজভবনে দু’বার স্ক্রিনিংয়ের ব্যবস্থা করেন। ওইনামকে সম্বর্ধনা দেওয়ার পাশাপাশি তিনি গ্রামের অন্তত দেড়শো মানুষকে রাজভবনে আমন্ত্রণ করে খাওয়ান। তাঁদের সুর-নামের বহর ও বাহার দেখে নিজের চক্ষুকর্ণের বিবাদভঞ্জন করেন পুরোহিত।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন