জিন্স, টি-শার্টে কাকভোরেই সমুদ্রসৈকতে তখন প্রধানমন্ত্রী

প্রায় দৌড়তে দৌড়তে গেলাম। গিয়ে দেখি, বাজপেয়ীজি সৈকতে হাঁটছেন। পরনে জিন্স, টি-শার্ট। চোখে রোদ চশমা! সঙ্গে জামাতা রঞ্জন ভট্টাচার্য।

Advertisement

জয়ন্ত ঘোষাল

নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ১৭ অগস্ট ২০১৮ ০৪:০১
Share:

অন্য বেশে: আঙ্করভাট মন্দিরে। —ফাইল চিত্র।

আরে, এখনও ঘুমোচ্ছ? প্রধানমন্ত্রী তো সমুদ্রসৈকতে!

Advertisement

মরিশাসের হোটেল। ভোর পাঁচটা। ফোন করলেন অশোক টন্ডন। অটলবিহারী বাজপেয়ীর মিডিয়া উপদেষ্টা। প্রায় দৌড়তে দৌড়তে গেলাম। গিয়ে দেখি, বাজপেয়ীজি সৈকতে হাঁটছেন। পরনে জিন্স, টি-শার্ট। চোখে রোদ চশমা! সঙ্গে জামাতা রঞ্জন ভট্টাচার্য।

সাংঘাতিক ‘ফোটো অপ’! এটা আমাদের সাংবাদিকদের ভাষা— মানে, ফোটো অপরচুনিটি!

Advertisement

এমনটাই ছিলেন বাজপেয়ী। বিরোধী নেতা হয়েছেন, প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। পোখরানে বিস্ফোরণ ঘটিয়েছেন। চিনের সঙ্গে বন্ধুত্ব করার চেষ্টা করেছেন। দলের কর্মসমিতির বৈঠকে রামমন্দির আন্দোলনের সিদ্ধান্ত হলে একা প্রতিবাদ করেছেন। কিন্তু চরিত্রের বর্ণময়তা ম্লান হতে দেননি কখনও। পাকিস্তান গিয়ে লাহৌরের আনারকলি বাজারে চোখের সামনে দেখেছি, তাঁকে ঘিরে উপচে পড়ছে স্থানীয় মানুষের ভিড়।

বাজপেয়ী মানে উদার মানসিকতা আর বৃহৎ প্রেক্ষাপটে ভাবনা। জনসঙ্ঘের নেতা হিসেবে মোরারজি সরকারের বিদেশমন্ত্রী হলেন। সেই প্রথম দিনের ঘটনা। সাউথ ব্লকে ছিল নেহরুর এক বিশাল ছবি। কোনও এক অতি-উৎসাহী আমলা বাজপেয়ী আসার আগে ছবিটি সরিয়ে দেওয়ার নির্দেশ দেন। তিনি ভেবেছিলেন, যুগ বদলেছে, বাজপেয়ী হয়তো খুশি হবেন! হয়েছিল উল্টো। বিরোধী নেতা হিসেবে বাজপেয়ী অনেক বার সাউথ ব্লকে এসেছেন, ছবিটি দেখেছেন। নির্দেশ দিলেন, ছবিটা ফেরত আনুন! নেহরু আবার ফিরলেন সাউথ ব্লকে।

আর রসিকতা? সর্বভারতীয় রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে রসিকতায় বাজপেয়ীর জুড়ি মেলা ভার। আনন্দবাজার পত্রিকায় যোগ দেওয়ার পরে ওঁর কাছে গিয়ে যে দিন জানালাম— বলেছিলেন, ‘‘বহুত আচ্ছা। বাজার মে রহো, আনন্দিত রহো।’’ আজও ভুলতে পারি না কথাটা। সত্যিই তো বাজারই সবচেয়ে বড় নিয়ন্ত্রক। আর আনন্দিত বা খুশি থাকাটা সবচেয়ে জরুরি! একটা কথায় সবটা বুঝিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা ছিল অসাধারণ। এক বার বাজপেয়ীজির কাছে গিয়ে অবসর গ্রহণের প্রস্তাব দিয়েছিলেন বেঙ্কাইয়া নায়ডু। বলেছিলেন, ‘‘আপনি রাষ্ট্রপতি হতে পারেন!’’ বেঙ্কাইয়া তখন আডবাণী-ঘনিষ্ঠ। সংবাদমাধ্যমে সে খবর প্রচারিত হলে বাজপেয়ী বলেছিলেন, ‘‘না ম্যায় টায়ার্ড হুঁ, না ম্যায় রিটায়ার্ড হুঁ!’’

বেড়াতে ভালবাসতেন খুব। বিদেশে গেলে আমাদের সঙ্গে নিয়ে যেতেন। নরেন্দ্র মোদী কিন্তু বিদেশে সাংবাদিকদের নিয়ে যাওয়াই বন্ধ
করে দিয়েছেন। বাজপেয়ী কোনও ঢাকঢাক গুড়গুড় না করে বিভিন্ন দেশের বিখ্যাত জায়গাগুলি দেখতে যেতেন আমাদের সঙ্গেই। আমেরিকায় পৌঁছতেন শুক্রবারে। শনি-রবি কূটনীতি নাস্তি! সোমবার কাজ শুরু। শনি-রবি স্থান মাহাত্ম্য অনুধাবন! জুরিখে নৌকাবিহার কিংবা মস্কোয় আমরা যাতে ক্রেমলিন প্রাসাদটা মিস না করি, তার খোঁজখবর নেওয়া!

বিল ক্লিন্টন তখন মার্কিন প্রেসিডেন্ট। হোয়াইট হাউস-এ বাজপেয়ী নৈশভোজে গেলেন আমাদের সঙ্গে নিয়ে। বাজপেয়ীকে বাড়িটা ঘুরিয়ে দেখালেন ক্লিন্টন। সঙ্গে আমরা। দোতলায় ওঠার সময় ছিল রোনাল্ড রেগনের এক বিশাল ছবি! বাজপেয়ী প্রশ্ন করলেন, ‘‘আপনার খুব প্রিয় চরিত্র?’’ ব্যস! ক্লিন্টন বলতে শুরু করলেন, কেন তিনি রেগন ভক্ত! প্রাইভেসি ভেঙে ক্লিন্টন তাঁর বেডরুমে নিয়ে গেলেন। দোতলার বারান্দা থেকে লিঙ্কনের সমাধি দেখতে পাচ্ছিলাম। সেটা সোশ্যাল মিডিয়ার যুগ নয়। বাজপেয়ী ফলাও করে এ সব প্রচার করার সুযোগ পাননি। কিন্তু তাই বলে আন্তর্জাতিক মহলে কম গুরুত্ব পেতেন না! নিয়মিত সাংবাদিক বৈঠক করতেন। এমনকি বিমানেও আমাদের কাছে চলে আসতেন, অনেক সময়ে নিজের কামরায় ডেকে পাঠাতেন।

খেতে ভালবাসতেন। নিজে পায়েস বানিয়ে সকলকে খাওয়াতেন। আগে তো বেশ কয়েকটা কুকুরও পুষতেন। কুকুরকে সঙ্গে নিয়ে হাঁটতে যেতেন। কন্যা নমিতার মেয়ে নীহারিকাকে নেহা বলে ডাকতেন বাজপেয়ী। কিছু দিন আগেও যখন মস্তিস্ক সজাগ, তখন তিনি যে ভাবে প্রতিদিন অফিস-ফেরত তাকে সময় দিতেন, সেটাও রাজনীতিকদের ক্ষেত্রে কমই দেখেছি।

আসলে বাজপেয়ী ছিলেন রঙিন মনের মানুষ। কবিতা লিখতেন। হলিউডের খোঁজখবর রাখতেন আর দিলীপকুমারের ফিল্ম দেখতে ভালবাসতেন। বলতেন, ‘‘মধুমতী যত বার দেখি, ভাল লাগে!’’ আর প্রায়ই বলতেন, ‘‘হিন্দু জাতীয়তাবাদের চেয়ে ভারতীয় জাতীয়তাবাদ শব্দটা আমার বেশি পছন্দ। এতে ভুল বোঝাবুঝি হয় না!’’

কাশ্মীরিয়ত, জামুরিয়ত আর ইনসানিয়তের কথা বলতেন বাজপেয়ী। বাসে করে লাহৌরে গিয়ে বলেছিলেন, ‘‘আমরা ভূগোল বদলাতে পারি না। কিন্তু ইতিহাস বদলাতে পারি!’’ একাত্তরের যুদ্ধের পরে ইন্দিরা গাঁধীকে ‘মা দুর্গা’র সঙ্গে তুলনা করতেও পিছপা হননি। সাক্ষাৎকারে এ কথা বলতে দ্বিধা করেননি যে, রাজীব গাঁধী না থাকলে তিনি সম্ভবত বাঁচতেন না। কারণ, আমেরিকায় নিয়ে গিয়ে তাঁর কিডনির চিকিৎসা করিয়েছিলেন রাজীবই!

বাজপেয়ীকে নিয়ে বার বার বলা হত— তিনি ঠিক মানুষ, কিন্তু আছেন ভুল দলে। বহু দিন হল, তিনি থেকেও ছিলেন না। আর আজ সত্যি সত্যি একটা পলকা সুতোর মত পার্থিব জীবনের যোগাযোগটাও ছিন্ন করে দিলেন। এখন চারিদিকে যখন সংকীর্ণতা, অসহিষ্ণুতার পরিবেশ, তখন চলে গিয়েও সবার কাছে প্রাসঙ্গিক হয়ে থাকবেন বাজপেয়ীজি!

(দেশজোড়া ঘটনার বাছাই করা সেরা বাংলা খবর পেতে পড়ুন আমাদের দেশ বিভাগ।)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন