এ যেন সপ্তসুরে সঙ্গতের সাধনা। ৭ তরুণ-তরুণী। সবাই শহরের চেনা মুখ। বয়স কু়ড়ির ঘরে। এক-দু’জন হয়তো বা তিরিশ ছুঁয়েছেন। রকমারি পেশার সঙ্গে যুক্ত এঁরা। কেউ গবেষক, কেউ হবু ডাক্তার, কেউ বা সাংবাদিক তো অন্য জন জনপ্রিয় বাংলা ব্যান্ডের অ্যারেঞ্জার। স্নাতকস্তরের পড়াশোনা শেষ হয়নি এমনও রয়েছেন এক জন। এক জায়গায়ই এঁদের মধ্যে মিল রয়েছে। এরা সবাই ভাবতে জানেন, জানেন ভাবাতেও।
তারই প্রমাণ মিলল শহর শিলচরে আয়োজিত এক সান্ধ্য আলোচনা সভায়। নাগরিক অধিকার আন্দোলনের অগ্রণী নেতা এবং রাজ্য বিধানসভার একদা-সদস্য প্রয়াত তারাপদ ভট্টাচার্যের জন্ম শতবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজন করা হয় এক ভিন্নধর্মী আলোচনাপর্ব। বিষয়— ‘আজকের সমাজে নেতা কোথায়? কী বা তাঁদের পরিচয়?’
খোলামেলা এই আলাপন-পর্ব সঞ্চালনা করতে গিয়ে নজরে এল, আর পাঁচটা দিন নিজেদের কাজকর্ম আর অবসরকালীন হুল্লোড়ে মেতে থাকা এই ছেলেমেয়েগুলো চারপাশের সমাজ-সংস্কৃতি রাজনীতি নিয়ে সত্যিই যথেষ্ট চিন্তিত। কাকে আমরা নেতা বলে মেনে নেব? কোন কোন গুণের সমন্বয়ে তৈরি হন এক জন নেতা? নেতা মানে কি শুধুই রাজনীতির অঙ্গন যাঁরা দাপিয়ে বেড়ান তাঁরাই? সামাজিক-সাংস্কৃতিক-বৌদ্ধিক জগতে অগ্রবর্তীরাও কি নেতা অভিধা দাবি করেন না? ধর্মীয় নেতাদের বাড়বাড়ন্ত কি উদার প্রগতিশীল ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র নির্মাণে প্রধান অন্তরায় হয়ে উঠছে না? ঘণ্টাখানেকের মতবিনিময় ও তুমুল তর্কে উঠে এল এ ধরনের নানান প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন।
শুরুটা কিন্তু হয়েছিল একদমই নীচু আবহে। নামী ইংরেজি দৈনিকের সাংবাদিক নীলোৎপল ভট্টাচার্য জানালেন, নেতাদের কোনও গতানুগতিক ছবি দেখলে চলবে না। স্বাধীনতা আন্দোলন-পর্বে নেতারা ছিলেন এক ধরনের। দেশের মুক্তিসংগ্রামই ছিল তাঁদের একমাত্র আদর্শ। মানুষ তখন সেই আদর্শে আপ্লুত হয়েই সংগ্রামী নেতৃত্বের অনুগমন করেছে। স্বাধীনতা প্রাপ্তির পরের কয়েক দশক পর্যন্তও সেই ধারাই চলেছে। কিন্তু এত বছর পর আজ আর সেই নেতাদের খুঁজলে চলবে না। সময় পাল্টেছে। পাল্টেছে মানুষের চাহিদা। এবং সর্বোপরি বদল এসেছে প্রযুক্তিতে। ইন্টারনেট আর সোশ্যাল মিডিয়ায় আচ্ছন্ন এই সময়ে তাই নেতার চেহারা অন্য রকম হবে এটাই স্বাভাবিক। ‘এ নিয়ে গেল গেল’ রব তুললে চলবে না।
নীলোৎপলের সুরেই গলা মেলালেন সায়ন বিশ্বাস। গানের দল দলছুট-এর প্রাণপুরুষ। পেশায় ক্রীড়া সাংবাদিক সায়নের সোজাসাপ্টা বক্তব্য, ‘‘নেতা তো জনতার মধ্যে থেকেই উঠে আসেন। আমরা যেমন তেমনই তো হবেন আমাদের নেতারা। আমাদের চাওয়া-পাওয়া আর অভিযোগ-অভিমান বুঝতে পারেন এমন নেতা আমাদের মধ্যেই লুকিয়ে আছেন। খোঁজার দায়িত্ব আমাদের।’’
এঁদের এই মতামতই সম্ভবত তাতিয়ে দিলো তমালকে। বক্তব্যের সুর বাঁধলেন আরও চড়ায়। সাংস্কৃতিক কর্মী ও ছাত্র রাজনীতি করে উঠে আসা তমাল চক্রবর্তী সোজা বলে দিলেন, ‘‘নেতা নেই। যাঁরা আছেন তাঁরা বড়জোর জনপ্রতিনিধি। ভোটে জিতে আসা সাংসদ, বিধায়ক আর কমিশনারের দল। জনগণকে পথ দেখানোর ক্ষমতা তাঁদের নেই। থাকলে কি আর বরাক উপত্যকার এই দুর্দশা হয়?’’ উঠে আসছিল ধর্মগুরুদের প্রসঙ্গও। রাজনীতিতে ধর্মীয় প্রতাপের অনাকাঙ্ক্ষিত অনুপ্রবেশে ক্ষুব্ধ দেখালো সব আলোচককেই। বাংলাদেশের একটি ইংরেজি সংবাদ পোর্টালের সঙ্গে যুক্ত সাংবাদিক জাহির আলম জাকারিয়া। জাহিরের সংক্ষিপ্ত অথচ তীক্ষ্ণ মন্তব্য গুঞ্জন ছড়াল শ্রোতার আসনে থাকা বিশিষ্টজনদেরও। ধর্মীয় নেতৃত্বের প্রশ্নে তাঁর পাল্টা প্রশ্ন, ‘‘আজকাল তো সবাই ধর্মীয় নেতা। আধ্যাত্মিক নেতা কোথায়? হ্যাঁ, বিবেকানন্দ ছিলেন আধ্যাত্মিক নেতা।’’
সমাজতত্ত্বের গবেষিকা সুজাতা ভট্টাচার্য ঢুকে গেলেন আরও নিবিড় পাঠে। ম্যাক্স ওয়েবার উদ্ধৃত করে তিনি বললেন, ‘‘নেতাদের তো ক্যারিশমা থাকা চাই। তা আর আজকাল কোথায়?’’ শিলচর মেডিক্যাল কলেজে এমবিবিএসের ছাত্রী অনন্যা দত্তরায় এবং গুরুচরণ কলেজের কলাবিভাগের ছাত্রী প্রজ্ঞা অন্বেষাকে দেখালো নেতাদের নিয়ে তাঁরা রীতিমত বিরক্ত। গণতন্ত্রের মন্দিরে বসে মোবাইলে পর্ণোগ্রাফি দেখতে ব্যস্ত দেশের আইনপ্রণেতাদের দেখে সদ্য কৈশোর পেরনো অনন্যা-প্রজ্ঞারা সত্যিই হতাশ।
কার্ল মার্কস থেকে জওহরলাল নেহরু, রুশো থেকে গাঁধী। বইপড়া থেকে প্রতি দিনের বাস্তব অভিজ্ঞতা। দেশ থেকে বরাক উপত্যকা। সাত জনের মতামতের সাতকাহনে বাদ পড়েনি কিছুই। যুক্তি-তর্কে আপাত ভিন্নতা থাকলেও সুরসপ্তকের রাগিনী আলাপে-বিস্তারে বারবারই জানান দিচ্ছিল বেদনার বার্তা। সমকালীন নেতারা ব্যর্থ হয়েছেন উনিশ-কুড়ির মন বুঝতে। মধ্য-চল্লিশের সঞ্চালকের মনে তখন একটিই আর্তি— ‘‘নেতা চাই নেতা, আর সব হইয়া যাইবে।’’