পুজোকে ছুঁয়েই শিকড়ে ফেরেন দিল্লির বাঙালি

সফদরজং এনক্লেভে মাতৃ মন্দির সর্বজনীন দুর্গা পুজোয় এ বার খিচুড়ির জন্য সাড়ে চারশো কেজি গোবিন্দভোগ চাল আর সোনা মুগ ডাল এসেছে কলকাতা থেকে।

Advertisement

ইন্দ্রজিৎ অধিকারী

নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ০৫ অক্টোবর ২০১৯ ০৩:৫৩
Share:

২৯ বছরে পা দিল পূর্ব দিল্লির পূর্বাচল পুজো সমিতির দেবী আরাধনা। শুক্রবার ষষ্ঠীতে। নিজস্ব চিত্র

টানা প্রায় কুড়ি বছর। মালদহের কালিয়াচক থেকে আসা গজেন রবি দাসের ঢাকে কাঠি পড়লে, তবে যেন পুজো শুরু হয় জনকপুরি বাঙালি অ্যাসোসিয়েশনের।

Advertisement

সফদরজং এনক্লেভে মাতৃ মন্দির সর্বজনীন দুর্গা পুজোয় এ বার খিচুড়ির জন্য সাড়ে চারশো কেজি গোবিন্দভোগ চাল আর সোনা মুগ ডাল এসেছে কলকাতা থেকে। তা-ও বিমানে। যাতে প্রসাদের পাতে মিশে থাকে নিখাদ বাংলার গন্ধ।

রাজধানীর ‘বাঙালি পাড়া’ চিত্তরঞ্জন পার্কে প্রতি বারের মতোই সাজো-সাজো রব। কোমর কষে প্রতিজ্ঞা, পুজোয় ‘ঘরে’ থাকার দুঃখ টের পেতে না-দেওয়ার।

Advertisement

ইন্দিরাপুরমে প্রান্তিকের প্যান্ডেলের ‘থিম’ বাংলা সিনেমার একশো বছর। মাতৃ মন্দিরের মণ্ডপসজ্জায় ছোঁয়া শান্তিনিকেতনের। করোলবাগ পূজা সমিতির আয়োজন জুড়ে ‘অ-আ-ক-খ’ আর বিদ্যাসাগর। সঙ্গে প্রার্থনা, অন্তত বর্ণপরিচয়ের মলাটটুকু চিনুক ইংরেজি-হিন্দিতে সাবলীল এখানেই জন্মে বড় হওয়া নতুন প্রজন্ম।

দিল্লির বাঙালিদের বড় অংশের কাছে এই চার দিন তাই শুধু পুজো, ঢাক, প্রসাদ, উৎসব নয়। শিকড়ে ফেরার সুযোগও। যে শিকড়ের টানে এখনও ট্রেন আসানসোল পেরোলে, ঝালমুড়ির খোঁজ করেন প্রায় চার দশক আগে রাজ্য ছেড়ে আসা মদন মোহন বন্দ্যোপাধ্যায়। পুজোয় ছুটি না-মিললে, চাকরি ছাড়ার কথা ভাবেন সুব্রত হালদার। বাংলায় কথা বলার সুযোগ পেলে থামতেই চান না সবিতা পাঠক। এঁদের সকলের কাছে পুজো আসলে একে-অপরকে আঁকড়ে ধরার চেষ্টা। চেষ্টা, নিজেদের গান-বাজনা-বৈঠক-আড্ডা-সংস্কৃতি পরের প্রজন্মকেও চিনিয়ে যাওয়ার।

দিল্লি কালী বাড়ির ভাইস প্রেসিডেন্ট দেবাশিস ভৌমিক বলছিলেন, ‘‘এই যে চারটে দিন একে অন্যের সঙ্গে দেখা হওয়া, বাংলায় কথা বলে যাওয়ার অফুরান সুযোগ, এর জন্যও বছরভর পুজোর দিকে তাকিয়ে থাকি আমরা।’’ আর এক পুজোর অন্যতম উদ্যোক্তা দেবাশিস সাহার মতে, ‘‘বছরভর ব্যস্ততায় ডুবে থাকা বাঙালি মন এই উৎসবের দড়িতে বাঁধা পড়ে। ছুট লাগায় ফেলে আসা রাস্তা আর বাড়ির উঠোনে।’’

তাই দিল্লির অনেক উদ্যোক্তার কাছেই এই প্রবাসে পুজো আসলে বহু মাইল দূরে বসেও বুকের মধ্যে এক চিলতে বাংলাকে বাঁচিয়ে
রাখার প্রতিজ্ঞা। বেসুরে রবীন্দ্রসঙ্গীত কিংবা কম রিহার্সালের নাটকেও রবি ঠাকুরকে মনে করা। হয়তো সেই কারণেই এখানে মন্ত্রের মতোই গুরুত্ব পুজোর তিন-চার দিন সকলে এক সঙ্গে বসে প্রসাদ খাওয়ার। নির্ভেজাল আড্ডার পাশাপাশি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের। চিত্তরঞ্জন পার্কের উৎপল ঘোষের প্রশ্ন, ‘‘পুজোয় না-মাতলে এই আগমনী, রবীন্দ্রনাথ, নাটক, নজরুলের কবিতা গড়গড়িয়ে আবৃত্তি— এ সব নতুন প্রজন্ম জানবে কী ভাবে বলুন তো?’’

করোলবাগের রাকেশ বেরা, গোপীনাথ সামন্ত, দীপক ভৌমিক, তরুণ সামন্তদের আবার পুজো শেষেও ‘ছুটি’ নেই। দশমীর রাতে ফি বছর বাড়ির দিকে রওনা দেন এঁদের অনেকে। কেউ চক্কর কাটেন কলকাতার বিভিন্ন মণ্ডপে, তো কারও জন্য অপেক্ষায় তাঁর গ্রামের বাড়ি।

বাংলা সিনেমার একশো বছরকে প্যান্ডেলে ধরতে চাওয়া পুজোর অন্যতম উদ্যোক্তা নীলাদ্রি দেব চৌধুরীর দাবি, ‘‘মণ্ডপ সাজানোর কারুকার্য থেকে শুরু করে প্যান্ডেলের বাঁশ পর্যন্ত অনেক সময়ে বাংলা থেকে এনেছি আমরা। কারণ, তার নমনীয়তা।’’ কাজের চাপের মধ্যেও এই লেগে থাকা, প্রয়োজনে গাঁটের কড়ি খরচ করেও শিল্পী আনার উদ্যোগ— এই সবই ওই শিকড়ের টানে বলে তাঁদের দাবি। একমত প্যাটেল নগর পূজা সমিতির সাধারণ সম্পাদক শেলী ভৌমিকও।

বাংলার মতো কাশের দোলা, সাবেকি ঠাকুর দালান, দু’পা অন্তর মণ্ডপ এখানে হয়তো নেই। কিন্তু তা বলে এক চিলতে বাঙালিয়ানাটুকু বাঁচিয়ে রাখতে চেষ্টারও ত্রুটি নেই রাজধানীর বাঙালির।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন