নয়াদিল্লি-ডিব্রুগড় রাজধানী এক্সপ্রেসের দুর্ঘটনার পিছনে রেলের যান্ত্রিক ত্রুটির বিষয়টি ক্রমশ স্পষ্ট হচ্ছে। লাইনের রক্ষণাবেক্ষণে যে ত্রুটি ছিল রাজধানী এক্সপ্রেসের চালকের বক্তব্যেও তা পরিষ্কার। একই সঙ্গে জেলা পুলিশের নিবিড় অনুসন্ধান বিষয়টিকে আরও জোরদার করেছে।
কাল এই দুর্ঘটনাটিকে ঘিরে দিল্লির সঙ্গে বিহারের যে রাজনৈতিক টানাপড়েন শুরু হয় তাতে কার্যত আজ ইতি টেনে দিয়েছে ট্রেনের চালক শুকদেব মাহাতর বয়ান। দুর্ঘটনার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই রাজ্য বিজেপি নেতৃত্ব, বিশেষত সারণের বিজেপি সাংসদ রাজীবপ্রতাপ রুডি মাওবাদী নাশকতাকে দায়ী করেন। রুডির বক্তব্যের প্রতিফলন ঘটে রেলমন্ত্রী সদানন্দ গৌড়া থেকে রেল বোর্ডের চেয়ারম্যান অরুণেন্দ্র কুমারের বক্তব্যে। তাঁরাও এই ঘটনার জন্য সরাসরি মাওবাদীদের দায়ী করেন। প্রথম দিকে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিংহের গলায় সেই সুর শোনা গেলেও পরে তিনি বক্তব্য পাল্টে বলেন, “তদন্ত পর্যন্ত অপেক্ষা করাই শ্রেয়। তার আগেই সিদ্ধান্তে পৌঁছনো ঠিক হবে না।” অন্য দিকে, রাজ্য প্রশাসন প্রথম থেকেই যান্ত্রিক ত্রুটিকেই দুর্ঘটনার কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেন। জেলাশাসক, পুলিশ সুপার এমনকী মুখ্যমন্ত্রীও এ ব্যাপারে সরব হন। আসলে পুরো বিষয়টি জেডিইউ বনাম বিজেপি, রাজনৈতিক চাপানউতোরের পর্যায়ে চলে যায়। প্রাক্তন রেলমন্ত্রী তথা রাজ্যের সদ্য প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমারও প্রশ্ন তোলেন, “তদন্তের আগেই কী করে ওঁরা নাশকতার কথা বলছেন?” এর পরেই রেল কর্তারা জানিয়ে দেন, তদন্তের আগে আর মন্তব্য করা ঠিক হবে না।
এই পরিস্থিতিতে কাল থেকেই রাজ্য প্রশাসন প্রকৃত ঘটনা উদঘাটনে তৎপর হয়। সংশ্লিষ্ট চালক, গেটম্যানের বক্তব্য নথিবদ্ধ করে জেলা পুলিশ। পুলিশ সুপার নিজে রেল লাইন বরাবর পরীক্ষা চালান। আজ সারণের পুলিশ সুপার সুধীর কুমার বলেন, “যদি মাওবাদী নাশকতা হত তবে তার চিহ্ন ওখানেই থাকত। তেমন কোনও চিহ্ন পাওয়া যায়নি।” তাঁর যুক্তি: ঘটনাস্থলে কোনও বিস্ফোরণ হলে প্রথমত, মাটিতে গর্ত থাকত। দ্বিতীয়ত, বারুদের চিহ্ন থাকত। তৃতীয়ত, কামরার নীচের ‘বগি’-তে ঝলসানো দাগ থাকত। পুলিশ সুপার বলেন, “এক ঘণ্টা আগে ওই লাইন দিয়ে কবিগুরু এক্সপ্রেস যায়। তার পরেই লাইনে কোনও ফাটল বা অন্য কোনও সমস্যা তৈরি হয়ে থাকতে পারে।”
ট্রেনটির চালকের বক্তব্যও পুলিশ সুপার উল্লেখ করেন। রাজধানীর অভিজ্ঞ চালক শুকদেব মাহাত আজ আনন্দবাজারকে বলেন, “বিস্ফোরণের আওয়াজ আমি পাইনি। ওই জায়গায় ট্রেনটি আসার পর আমি একটা ঘটঘট আওয়াজ পাই। বুঝি লাইনে কোনও সমস্যা রয়েছে।” রেলের এই ‘ফার্স্ট ক্লাস ড্রাইভার’-এর কথায়, “গাড়ির গতি তখন ছিল ঘণ্টায় ৬০ থেকে ৬৫ কিলেমিটার। ওই সন্দেহজনক আওয়াজ পেয়েই আমি ব্রেক কষি। ট্রেনের গতি কমে আসতে থাকে। কিন্তু ততক্ষণে যা হওয়ার হয়ে গিয়েছে। আমি পিছনে দেখি ইঞ্জিন তখনও লাইনচ্যুত না হলেও পিছনের কামরাগুলি রেল লাইন থেকে ছিটকে বেরিয়ে যাচ্ছে।” চালকের এই বয়ান রাজ্যের বক্তব্যকেই আরও জোরদার করেছে।
রেলের বিরুদ্ধে কোনও অভিযোগ না এনে পুলিশ সুপারের যুক্তি, “যদি মাওবাদীরা বিস্ফোরক ছাড়াও লাইনে ক্লিপ খোলা বা ওই ধরনের কোনও নাশকতামূলক কাজ করে থাকে তা হলে ঘটনাস্থলের অদূরে থাকা রেলওয়ে লেভেল ক্রসিংয়ে র গেট-রক্ষী তার আওয়াজ পেত। গেট-রক্ষী কিন্তু তাঁর বয়ানে আমাদের তেমন কোনও কথা বলেনি। সে বলেছে, ট্রেন রেল গেট পার হয়ে যাওয়ার পরেই সে একটা বুক কাঁপানো আওয়াজ পায়।”
পুলিশ সুপারের কথায়, “বগিগুলি লাইনচ্যুত হয়ে ঘষটাতে ঘষটাতে যেতে থাকে। তার একটা বিশাল আওয়াজ হয়। গেট-রক্ষী সেই আওয়াজের কথাই বলতে চেয়েছে।” উল্লেখ্য, গত কাল রেলের পাশাপাশি রাজ্য প্রশাসনের পক্ষেও ওই এলাকায় নমুনা সংগ্রহ করা হয় তা ফরেন্সিক পরীক্ষার জন্য পাঠানো হয়েছে। এ দিকে, আজ থেকে কমিশনার অফ রেলওয়ে সেফটি পি কে বাজপেয়ী ঘটনার তদন্তে নেমেছেন।