বেশ কয়েক বছর আগের কথা। শিল্পপতি অনিল অম্বানী তখন রাজ্যসভার সদস্য। বেলা শেষে সংসদের সেন্ট্রাল হলে বসে নামমাত্র দামে দোসা খাচ্ছিলেন! কাছেই বসেছিলেন এক বামপন্থী সাংসদ। অনিলকে খেতে দেখে টিপ্পনী কেটে তিনি বলেন, ‘‘আপনারা না পুঁজিপতি? ভর্তুকি তুলে দিয়ে সংস্কারের কথা বলেন। অথচ এই দেখুন, ভর্তুকি দামে দোসা খাচ্ছেন!’’ বাঁকা কথাটা শুনেও হাসি চাপতে পারেননি অনিল! তার পর চামচটা সম্বরের বাটিতে ডুবিয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে বলেন, ‘‘আপনারাও তো খাচ্ছেন। জনগণের করের টাকায়! কই বারণ তো করছেন না?’’ বামপন্থী নেতাটি জবাবে এক গাল হেসে বলেন, ‘‘আমরা তো সর্বহারাদের পক্ষে। তাই ভর্তুকি জিইয়ে রাখতে সওয়াল করি। তবে হ্যাঁ, সংসদের খাবারে ভর্তুকি তুলে দেবার প্রস্তাব যদি আপনি আনেন, তা হলে আমরা বামপন্থীরাও পক্ষে ভোট দিতে পারি।’’
বলা বাহুল্য, ওই টিপ্পনী সেন্ট্রাল হলের আরও একটি রসিকতার ঘটনা হয়েই থেকে গিয়েছিল। বাস্তবের রূপ আর নেয়নি। আর এখন তথ্যের অধিকারের আওতায় সরকারের কাছে হিসেব চেয়ে দেখা গেল, গত পাঁচ বছরে সাংসদদের খাবারে ৬০ কোটি ৭০ লক্ষ টাকা খয়রাতি দেওয়া হয়েছে সরকারের কোষাগার থেকে। পেট্রোল-ডিজেলের উপর থেকে ভর্তুকি তুলে সাহসী সংস্কার করেছে সরকার। রান্নার গ্যাসের ভর্তুকি ছেড়ে দেশ গঠনে সামিল হওয়ার ডাক দিয়েছে। অথচ, সংসদের ক্ষেত্রে তারা হাত গুটিয়ে। সরকার ভর্তুকি দেয় বলে, লোকসভা ও রাজ্যসভার সাংসদরা এক প্লেট মাটন কারি খেতে পান মাত্র বিশ টাকায়। থ্রি কোর্স আমিষ থালি খেতে হলে দিতে হয় ৩৩ টাকা। দু’টোই বাজার দরের থেকে অনেক কমে। বাজার দরে শুধু বিক্রি হয় খোমানি মিষ্টি। তিনটের দাম ১৫ টাকা। এক মাত্র রুটি বেচে যৎসামান্য মুনাফা থাকে উত্তর রেল কর্তৃপক্ষের। সংসদের ক্যান্টিন পরিচালনা করে এই উত্তর রেলই। ১ টাকায় যে তাওয়া রুটি বিক্রি হয়, তা তৈরি করতে খরচ পড়ে ৭৭ পয়সা।
সাংসদদের খাবারের জন্য সরকারের ভর্তুকির বহর কতটা, তা জানতে সম্প্রতি সুভাষ অগ্রবাল নামে এক সামাজিক আন্দোলনকারী তথ্যের অধিকারের আওতায় মামলা করেছিলেন। তার জবাবে সরকারের তরফে জানানো হয়েছে, সংসদের ক্যান্টিনে এক প্লেট পুরি-তরকারির দামে ৮৮ শতাংশ ভর্তুকি দেয় কেন্দ্র। সাংসদ বা সংসদের যে সদস্যরা মাসে ১ লক্ষ ৪০ হাজার বা তার বেশি টাকা রোজগার করেন, তাঁরা এক প্লেট ‘ফ্রায়েড ফিশ উইথ চিপস্’ কেনেন মাত্র ২৫ টাকায়। মাটন কাটলেট পান ১৮ টাকায়। মশলা দোসা খান ৬ টাকায়। প্রতিটি খাবারের ক্ষেত্রেই বিপুল পরিমাণ ভর্তুকি দেয় কেন্দ্র। বাজারদরের তুলনায় ক্যান্টিনে যে জলের দরে খাবার পাওয়া যায়, তা এ থেকেই পরিষ্কার। তবে যে দেশে পানীয় জলও বিনামূল্যে পাওয়া যায় না, সেখানে সংসদে এই স্বজনপোষণ কেন, প্রশ্ন তুলেছেন সুভাষ। তাঁর কথায়, ‘‘বর্তমান সরকার যেখানে ভর্তুকি দেওয়ার রীতি সংস্কারের পক্ষে সওয়াল করছে, তখন সংসদের অন্দরেই এই দ্বিচারিতা কেন?’’
সংসদের ক্যান্টিনে ২০০৯-১০ অর্থবর্ষে ১০ কোটি ৪০ লক্ষ, ২০১০-১১-এ ১১ কোটি ৭০ লক্ষ, ২০১২-১৩ সালে ১২ কোটি ৫০ লক্ষ এবং ২০১৩-১৪ সালে ১৪ কোটি টাকা ভর্তুকি দিয়েছে কেন্দ্র। হিসেব বলছে, ভেজিটেবল স্ট্যু তৈরির উপকরণের বাজারদর প্রায় ৪২ টাকা। আর সেই খাবার মাত্র ৪ টাকায় কিনছেন সাংসদেরা। অর্থাৎ ভর্তুকির পরিমাণ প্রায় শতকরা ৯০ শতাংশ। মাছ, মাংস হোক বা ভাত-রুটি-বিরিয়ানি— সংসদের ক্যান্টিনে খাবার পাওয়া যায় সুলভে।
সাম্প্রতিক বাজেটে হোটেল রেস্তোরাঁয় খাবার ও পানীয়ের ওপর ১৪ শতাংশ পরিষেবা কর চাপিয়েছেন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি। কিন্তু শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত সংসদে খাবারের ওপর এ ধরনের কোনও করই নেওয়া হয় না। অর্থাৎ জনগণের ওপর কর চাপালেও নিজেদের এ ব্যাপারে চাপ মুক্তই রেখেছেন সাংসদরা।
২০১৪ সালের জুন-জুলাই নাগাদ রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়ার প্রাক্তন গভর্নর সি রঙ্গরাজনের নেতৃত্বে একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি কেন্দ্রকে দেওয়া রিপোর্টে জানিয়েছিল, দেশের কোনও মেট্রোপলিটন শহরের বাসিন্দার যদি দিনে ৪৭ টাকা খরচের সামর্থ্য থাকে, তবে তাঁকে মোটেও দরিদ্র বলা যায় না। আর গ্রামের বাসিন্দাদের দারিদ্রসীমার মাপকাঠি ছিল ৩২ টাকা। সে সবের পরেও দেশের একটা বড় অংশ দারিদ্রসীমার নীচে বাস করেন। অর্থাৎ, তাঁদের দিনে ৩২ টাকা খরচ করার সামর্থ্যও নেই। সেই হতদরিদ্রদের নির্বাচিত প্রতিনিধিরাই কার্যত বিনামূল্যে চর্ব্য-চুষ্য-লেহ্য-পেয় উপভোগ করছেন পেটপুরে। আর সেই খাবারের ভর্তুকি জোগাচ্ছে আম জনতার করের টাকা!
কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার এক সদস্য আজ বলেন, ‘‘বিতর্কটা নতুন নয়। ব্যাপারটা ঘুরে ফিরে আসে। দু’দিন তর্ক হয়। ট্রেনে বাসে মানুষ সমালোচনা করেন। তার পর ভুলে যান। মনে পড়ে বাজপেয়ী-জমানাতেও এক বার এ নিয়ে তোলপাড় হয়েছিল! কিন্তু পরে সংসদে আর প্রস্তাব আসেনি।’’ শুধু বাজপেয়ী-জমানা কেন, অতীতে শিল্পপতি কে কে বিড়লা যখন রাজ্যসভার সদস্য ছিলেন, তখনও এক বার ভর্তুকি তোলার কথা ওঠে। তখন কে কে বিড়লাও বলেছিলেন, ‘‘সাংসদ হিসেবে বেতন বৃদ্ধি পেলে যেমন বলতে পারি না, বেতন নেব না, সে রকম ভর্তুকি দেওয়া খাবার যদি সংসদে বহাল থাকে, তা হলে বলতে পারি না, বেশি পয়সা দিয়ে সেই খাবার কিনব।’’
তবে কে কে বিড়লার মতো সাহসী মন্তব্য কোনও সাংসদই আজ করেননি। বরং কংগ্রেস, বাম, তৃণমূল নির্বিশেষে সাংসদরা আজ মেনে নেন, ব্যাপারটা ঠিক নয়। সঙ্গতও নয়। রাজ্যসভার কংগ্রেস সাংসদ প্রদীপ ভট্টাচার্য বলেন, ‘‘খাবারে ভর্তুকি তুলে দেওয়ার পক্ষে আমি। খাবারের নায্য দাম নেওয়া হোক, আর গুণমানও ভাল হোক।’’ কিন্তু এই দাবি সংসদে তোলেননি কেন? প্রদীপবাবু বলেন, ‘‘আসলে আমি সংসদে চা-ছাড়া কিছু খাই না। তাই এ ব্যাপারেও মাথাও ঘামানো হয়নি।’’ রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মতে, আসল প্রশ্ন ওটাই। মাথা ঘামাবেন কে? কে-ই বা বেড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধবেন। ব্যক্তিগত ভাবে কোনও সাংসদ কী মত প্রকাশ করছেন বড় কথা নয়। এ ব্যাপারে সব ক’টি রাজনৈতিক দল মিলে সবর্সম্মত প্রস্তাব পেশ করতে পারেন সংসদে। অথবা রাজ্যসভার চেয়ারম্যান বা লোকসভার স্পিকার প্রস্তাব আনতে পারেন সংসদীয় কমিটিতে।
কিন্তু প্রশ্ন থেকে গেল, এ ব্যাপারেও সর্বসম্মতি হবে কি? কারণ, সাংসদদের সুবিধা বাড়ানোর পক্ষেই অতীতে বার বার দাবি উঠেছে। বামেরা বিক্ষিপ্ত ভাবে সাংসদদের বেতন বাড়ানোর বিরুদ্ধে মত দিতেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত মাইনে প্রকৃত পক্ষে বাড়লে সুবিধা নিতেও ছাড়েননি। এমনই এক উদাহরণ দিয়ে কংগ্রেসের এক নেতা বলেন, পূর্ণ সাংমা লোকসভার স্পিকার থাকাকালীন সাংসদদের বেতন বাড়ানো নিয়ে আলোচনায় তোলপাড় হয়েছিল। বামেরা প্রস্তাবে আপত্তি করেছিলেন। আর তা শুনে কংগ্রেসের তৎকালীন মুখ্য সচেতক সন্তোষমোহন দেব বলেছিলেন, ‘‘ঠিক আছে আপনারা না হয় বর্ধিত বেতন নেবেন না! প্রতিবাদও করবেন, বেশি বেতনও নেবেন, হয় নাকি!’’ তারপর বেতনবৃদ্ধি হয়েছে। বামেরাও নিয়েছেন। খাবারে ভর্তুকি ট্র্যাডিশনও চলছে সমানে।
মাস তিনেক আগে সংসদ-ক্যান্টিনে মধ্যাহ্নভোজ সেরেছিলেন প্রধানমন্ত্রী। ভাত, রুটি, রাজমা, সার্সো কা সাগ, আলুর তরকারি আর দই খেয়েছিলেন তিনি। দাম পড়েছিল ২৯ টাকা!