বিজেপি-অগপ জোট বাঁধতেই বরাক উপত্যকায় আলোচনা শুরু হয়ে গিয়েছিল—শেষ পর্যন্ত ‘বঙাল খেদা’-দের সঙ্গে হাত মেলাল গেরুয়াবাহিনী! এরা ক্ষমতায় এলে বাঙালিদের দুর্ভোগ নতুন মাত্রা পাবে। ভোটের বাক্সে এর কতটা প্রভাব পড়েছে তা ১৯ মে-র আগে বলা মুশকিল। তবে ভোটের পরেও সেই আলোচনা অব্যাহত রয়েছে।
বিদায়ী বিধানসভায় বিজেপির একমাত্র বাঙালি বিধায়ক দিলীপকুমার পালের দাবি, ‘‘এ আশঙ্কা অমূলক।’’ তাঁর কথায়, ‘‘সরকার গড়বে বিজেপি জোটই। তারা সমস্ত জনগোষ্ঠীর মানুষের স্বার্থেই কাজ করবে। দলের জাতীয় চরিত্র বাঙালি-অসমিয়া মানসিক দূরত্ব কমাবে।’’ কিন্তু অগপ কি তার নীতি-কৌশল থেকে সরে আসবে? বাঙালি বিদ্বেষ কি ভুলে যাবে? দিলীপবাবুর সোজা জবাব, ‘‘তারা কী করবে, সেটা তাদের বিষয়। কিন্তু বিজেপি তার ঘোষিত নীতি, কর্মসূচি থেকে একচুলও সরবে না।’’ তাঁর আশা, বিজেপি একক নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করবে। এ ছাড়াও রয়েছে অন্য শরিক দল। ফলে সরকার গঠন বা পরিচালনায় অগপ অনৈতিক চাপ সৃষ্টির কৌশল নিলে তা বিজেপি মেনে নেবে না।
সর্বানন্দ সোনোয়ালের সঙ্গে শেষ পর্যায়ের ভোট শেষ হতেই তাঁর বিস্তৃত কথা হয়েছে বলে জানালেন দিলীপবাবু। সে আলোচনায় তিনবারের প্রাক্তন বিধায়ক পরিমল শুক্লবৈদ্যও উপস্থিত ছিলেন। বরাক উপত্যকার দুই নেতা সে দিন নানা বিষয়ে মুখ্যমন্ত্রী পদপ্রার্থীর সঙ্গে কথা বলেন। দিলীপবাবু জানান: মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে সর্বানন্দ সোনোয়ালের শপথ গ্রহণ এখনশুধু সময়ের অপেক্ষা। ১৯ মে গণনার পরই দিনক্ষণ চূড়ান্ত হবে। এমন সময়েও তিনি বরাক উপত্যকার বিভিন্ন সমস্যা খুঁটিয়ে জেনে নেন। তা থেকে তাঁর ধারণা, অগ্রাধিকার তালিকা তৈরি শুরু করে দিয়েছেন সর্বানন্দ। সে তালিকায় বরাক উপত্যকারও কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উঠে আসবে।
কিন্তু বাংলাদেশি বিতাড়নের নামে তাঁর সেই পুরনো আন্দোলন, সুপ্রিম কোর্টে মামলা কিংবা সন্দেহবাতিকতা যদি মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে? দিলীপবাবু জোরালো দাবি, বাংলাদেশি ইস্যুতে দলের অবস্থান থেকে পৃথক কোনও ভাবনা সর্বানন্দ সোনোয়ালের নেই। ঘনিষ্ট কথাবার্তায় সেদিনও রাজ্য সভাপতি নাকি তা স্পষ্ট করে দিয়েছেন।
সর্বা-কে উদ্ধৃত করে দিলীপবাবু বলেন, বাংলাদেশ বা পাকিস্তান থেকে যে সব হিন্দু নির্যাতিত হয়ে ভারতে আশ্রয় নিয়েছেন, তাদের নাগরিকত্ব প্রদানে সরকার প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। রাজ্যে বিজেপি নেতৃত্বাধীন জোট সরকার গঠনের পরও এই অবস্থান থেকে সরে আসার প্রশ্ন ওঠে না।
কিন্তু অসম চুক্তি ও নির্যাতিত হিন্দুদের নাগরিকত্ব, দুটোকে এক সঙ্গে কী করে মেলানো হবে? দিলীপবাবুর জবাব, ওই আইনি জটিলতার সমাধান আইনের মাধ্যমেই বেরিয়ে আসবে। তাই বলে দলের মূল ভিত্তি হিন্দু সুরক্ষার সঙ্গে কোনও আপস করা হবে না। এ জায়গায় তাঁর বড় ভরসা রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ বা আরএসএস। এরাই বিজেপি-অগপকে এক জায়গায় এনেছে। আবার এরাই শরণার্থীদের নাগরিকত্ব নিয়ে সবচেয়ে বেশি সরব রয়েছে।
সর্বানন্দ সোনোয়ালকে যেমন প্রচণ্ড বাঙালি-বিদ্বেষী বলে মনে করা হয়, তেমনি শিলচরের বিধায়ক দিলীপকুমার পালকে মুসলিম-বিদ্বেষী বলে অভিযুক্ত করা হয়। দুটোকেই ভুল বলে দাবি করেন দিলীপবাবু। তাঁর যুক্তি, সর্বানন্দ সোনোয়াল বাঙালিকে মোটেও শত্রু বলে মনে করেন না। তিনি অনুপ্রবেশকারী-মুক্ত অসম গড়ার স্বপ্ন দেখেন। শরণার্থীরা যে অনুপ্রবেশকারী নন, দলের রাজ্য সভাপতি বহুবার তা উল্লেখ করেছেন। একই ভাবে তাঁকে মুসলিম-বিদ্বেষী বলা যুক্তিহীন। তাঁর কথায়, ‘‘আমি কোনও ভারতীয় মুসলমানকে হিন্দুদের চেয়ে কম আপন বলে মনে করি না। কিন্তু বাংলাদেশ থেকে এখানে এসে জনসংখ্যার ভারসাম্য যারা বিঘ্নিত করছে, আমি তাদের চরম বিরোধী। এই ষড়যন্ত্র কোনও মতে মেনে নেওয়া যায় না।’’
বীথিকা দেবকে হারিয়ে বিধায়ক হিসেবে পুনর্নির্বাচিত হওয়ার ব্যাপারে একশো ভাগ আশাবাদী দিলীপবাবু। কংগ্রেসে দেববাড়ির ওজনদার প্রার্থী, নিজের দলের ভোট কাটাকুটির খেলা—সে সব মেনে নিয়েও তিনি জানান, ‘‘জিতছি আমিই। ওজনদার প্রার্থী হলফনামায় নিজেকে অশীতিপর ঘোষণার পর বহু কংগ্রেসি কাজের মানুষ খুঁজে খুঁজে পদ্মচিহ্নে বোতাম টিপেছেন।’’ আর দলের অভ্যন্তরীণ কলহ তাঁর ভোটে প্রভাব ফেলতে পারেনি বলেই মনে করছেন তিনি। দিলীপবাবু বলেন, ‘‘ভোট না দেওয়ার কথা বলার জন্য প্রথমে ভোট আদায়ের ক্ষমতা থাকা চাই। দলে যারা আমার বিরোধিতা করেন, তাঁদের কারও নিজের জন্যই ভোট আদায়ের ক্ষমতা নেই। ফলে আমাকে ভোট না দেওয়ার কথা বলার সামর্থ তাঁদের কোথায়!’’
তবে কি ফলাফল ঘোষণার পর এ সব ঘিরে আরেক প্রস্ত কলহের সম্ভাবনা? দিলীপবাবুর ধারণা, তেমনটা হবে না। আলোচনা চলবে। দোষত্রুটি খতিয়ে দেখা হবে। তাই বলে বাইরে ছড়িয়ে পড়ার মত কোনও কাণ্ড ঘটবে না। আর মন্ত্রিত্ব নিয়ে? সেখানেও একই রকম নিরুত্তাপ শিলচর পুরসভার প্রাক্তন বিরোধী দলনেতা, ১৭ মাসের বিধায়ক দিলীপকুমার পাল। সোজাসুজিই বললেন, ‘‘ও সব নিয়ে এখনই ভাবছি না। বরিষ্ঠ নেতারা রয়েছেন, তাঁরা সে সব স্থির করবেন। মন্ত্রিত্বের জন্য লালায়িত নই, আবার দায়িত্ব নিতে বললে পিছপাও হব না।’’