ক্ষমতায় আসার পর দু’মাসও পেরোয়নি। প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছিল নরেন্দ্র মোদী সরকারের দক্ষতা নিয়ে। কিন্তু শনিবার সে সন্দেহে কার্যত জল ঢেলে দিয়ে ইরাকে অপহৃত ৪৬ জন ভারতীয় নার্সকে অক্ষত দেশে ফিরিয়ে আনল সুষমা স্বরাজের নেতৃত্বাধীন বিদেশ মন্ত্রক। তা-ও স্রেফ বহুমুখী কূটনীতিকে সম্বল করে। একে মোদী-জমানার প্রথম কূটনৈতিক জয় হিসেবেই দেখতে চাইছে বিজেপি। উল্লেখ্য, বিদেশ মন্ত্রকের তৎপরতার ভূয়সী প্রশংসা করেছেন কেরলের কংগ্রেসি মুখ্যমন্ত্রী উমেন চান্ডিও।
বস্তুত, গত কুড়ি-পঁচিশ দিন ধরে যে ভাবে নাগাড়ে কাজ করে চলেছে বিদেশ মন্ত্রক, তা মাথায় রাখলে এই সাফল্যের কৃতিত্ব মোদী সরকার দাবি করতে পারে বলে মনে করছেন কূটনীতিকরা। মন্ত্রকের একাংশ অবশ্য বিশেষ ভাবে সুষমা স্বরাজের ভূমিকার প্রশংসা করছে। একের পর এক বৈঠক করে গিয়েছেন, কাজের চাপে নিজের নির্বাচনী কেন্দ্র ভোপালে সফরও বাতিল করেছেন সুষমা। কখনও প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী, কখনও জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত ডোভাল আবার কখনও বা পশ্চিম এশিয়ার একাধিক দেশের রাষ্ট্রপ্রধানের সঙ্গে কথা বলেছেন তিনি। যোগাযোগ রেখে চলেছেন কেরলের মুখ্যমন্ত্রী উমেন চান্ডির সঙ্গেও। সব মিলিয়ে এই পরিস্থিতি যে ভাবে সামলেছেন তিনি তাতে আম জনতার কাছে একটা সদর্থক বার্তা গিয়েছে বলে মনে করছে রাজনৈতিক শিবির। আর তা হল, এত অল্প সময়ে মোদী সরকারের যোগ্যতা সম্পর্কে নেতিবাচক মূল্যায়ন করার কোনও জায়গা নেই।
আজ সেই বিশ্বাসে অক্সিজেন জুগিয়েছেন বিজেপির রাজনৈতিক বিরোধী কেরলের কংগ্রেসি মুখ্যমন্ত্রী। এ দিন ইরাক-ফেরত নার্সদের অভ্যর্থনা জানাতে কেরলের কোচি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে হাজির ছিলেন চান্ডিও। ঠিক ১১টা বেজে ৫৭ মিনিটে অবতরণ করে এয়ার ইন্ডিয়ার বিমান। বেরিয়ে আসেন নার্সরা। পরিবার-পরিজনদের পাশে পেয়ে বিহ্বল হয়ে পড়েন তাঁরা। গোটাটাই স্বচক্ষে দেখে অভিভূত চান্ডি বলেন, “কেরলের উদ্বেগ, চিন্তা সমস্তটা বুঝে পদক্ষেপ করেছে কেন্দ্র। নার্সদের ছাড়িয়ে আনতে আপ্রাণ চেষ্টা করেছে বিদেশ মন্ত্রক এবং ইরাকের ভারতীয় দূতাবাস।”
এ দিন ওই একই বিমানে চেপে উত্তর ইরাকের কিরকুক শহরে বন্দি থাকা প্রায় ৮০ জন ভারতীয়ও দেশে ফিরেছেন। তাঁদের মধ্যে বেশিরভাগই তেলঙ্গানার বাসিন্দা। কোচিতে নার্সদের পৌঁছে দিয়েই হায়দরাবাদে তাঁদের পৌঁছে দেয় বিমানটি। তাঁরাও জানাচ্ছেন, কেন্দ্র ঠিক সময়ে পদক্ষেপ না করলে তাঁদের পক্ষে ফেরা সম্ভব হত না। তবে ইরাক থেকে ভারতীয়দের ফেরানোর প্রক্রিয়া যে এখানেই থমকে যাবে না, তা এ দিন ফের স্পষ্ট করেছে বিদেশ মন্ত্রক।
শনিবার রাতের মধ্যেই ইরাকের নজাফ থেকে চাটার্ড বিমানে নয়াদিল্লি পৌঁছে যাওয়ার কথা অন্তত ২০০ জন ভারতীয়ের। সোমবারের মধ্যে আরও চারশো জনকে ফেরানোর তোড়জোড় করা হচ্ছে। অন্য দিকে, বাগদাদে ভারতীয় দূতাবাস চেষ্টা চালাচ্ছে ইরাকের বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থায় কর্মরত অন্তত ৪০০ জন কর্মীকে ছাড়িয়ে আনার। “সব মিলিয়ে সোমবারের মধ্যে সরকারি খরচে প্রায় ১২০০ ভারতীয় ফিরতে পারেন বলে ধারণা।” বলেন বিদেশ মন্ত্রকের মুখপাত্র সৈয়দ আকবরউদ্দিন। কিন্তু এত সাফল্যের মধ্যেও একটা খচখচানি যাচ্ছে না। মসুলে এখনও ৩৯ জন ভারতীয় শ্রমিক বন্দি রয়েছেন। এবং তাঁদের কী হবে, সে নিয়ে অস্পষ্টতা কাটেনি এ দিনও।
কিন্তু এত অল্প সময়ের মধ্যে কী ভাবে এমন সাফল্য পেলেন সুষমা? এর পিছনে রয়েছে সমান্তরাল কূটনীতি। মন্ত্রক সূত্রে খবর, এক সঙ্গে একাধিক দিক থেকে চেষ্টা করছিল কেন্দ্র। প্রথমে আমেরিকা, তার পর ইরাকের স্বয়ংশাসিত কুর্দিস্তানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। তার পর ধীরে ধীরে সিরিয়া, ইজরায়েল, রাশিয়ার সঙ্গেও কথা বলে ভারত সরকার। সৌদি আরবকেও চাপ দেওয়া হয়। আইএসআইএল জঙ্গিদের সাহায্য করে থাকে সৌদি আরব। ভারতীয় বন্দিদের ছাড়িয়ে আনতে সৌদি আরবকে পাশে পেয়ে গিয়েছে ভারত। ভারতীয়দের মুক্তি দিতে আইএসআইএল জঙ্গিদের উপর পরোক্ষ চাপ বাড়াতে থাকে সৌদি আরব। ইরাকি বায়ুসেনার হাতে সম্প্রতি পৌঁছে গিয়েছে রুশ যুদ্ধবিমান। ইরাকি সেনার পাল্টা হামলায় কিছুটা বিপাকে পড়েছে জঙ্গিরা। এ হেন অবস্থায় ভারতীয়দের মুক্তি দিয়ে আসলে তাঁদের নজরে রাখার বাড়তি দায়িত্ব থেকে মুক্তি পেতে চাইছিল তারা। ঠিক সে সময়ই ভারতীয় দূতাবাসও নার্সদের জানায়, জঙ্গিদের সঙ্গেই যেন তিকরিত ছেড়ে চলে যান তাঁরা। অতঃপর ঠিকানা বদল এবং মুক্তি। সরকারি ভাবে অবশ্য সৈয়দ আকবরউদ্দিন অবশ্য বলেন, “ইরাক এবং ইরাকের বাইরেও বন্ধু দেশগুলির সাহায্যে নানা ধরনের
চেষ্টা করা হয়েছে।” প্রয়োজনে অপ্রচলিত পন্থাও নেওয়া হয়েছে বলে জানান তিনি।
এমন দক্ষতার সঙ্গে এই সমস্যার মোকাবিলা এবং সাফল্যকে স্বাভাবিক ভাবেই ব্যবহার করতে ছাড়ছে না বিজেপি। দলের সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে যোগাযোগের দায়িত্বে থাকা শ্রীকান্ত শর্মা এ দিন বলেন, “ইরাকে আটকে থাকা ভারতীয়দের ছাড়িয়ে আনতে যে ভাবে ভারত সরকার এগিয়ে এল, তার জন্য আমরা কৃতজ্ঞ।”
এই জয়ের ফলে বিরোধী মত তো বটেই, নিজেদেরই ইতিহাসকে জয় করল বিজেপি। ১৯৯৯ সালের ডিসেম্বরে কন্দহর বিমান ছিনতাই কাণ্ডে তিন জঙ্গিকে মুক্তির পরিবর্তে অপহৃত যাত্রীদের ফিরিয়ে আনতে পেরেছিল এনডিএ সরকার। কিন্তু সেখানেও রক্তপাত আটকানো যায়নি। রুপিন কাটিয়ালের প্রাণ গিয়েছিল জঙ্গি-গুলিতে।
এ বার কিন্তু রক্তপাত কিংবা বন্দিমুক্তি কোনওটাই দেখতে হয়নি সুষমা স্বরাজের মন্ত্রককে। কূটনৈতিক ইনিংসের গোড়ায় যে জয় পেল মোদী সরকার, তা তাদের ভবিষ্যতে উৎসাহ জোগাবে বলেই আশা সব শিবিরেরই।