গ্রাফিক: আনন্দবাজার ডট কম।
মোগলদের বিরুদ্ধে তৎকালীন ভারতের যত জন শাসক ‘প্রতিস্পর্ধা’ দেখিয়েছিলেন, তাঁদের প্রত্যেককে একবিংশ শতাব্দীর ভারতে প্রাসঙ্গিক করে তুলতে কোমর বেঁধে ময়দানে নেমেছে বিজেপি-আরএসএস। সেই তালিকায় নবতম সংযোজন মহারানি অহল্যাবাই হোলকর। চলতি মাসের শেষ দিনে অহল্যাবাইয়ের ৩০০তম জন্মবার্ষিকী। গোটা দেশে এই ত্রিশতবর্ষ পালন করছে বিজেপি। সঙ্ঘ পরিবারও অহল্যাবাই স্মরণে নানা কর্মসূচি নিচ্ছে। তবে এই সব ঐতিহাসিক চরিত্রের বিচরণ শুধু এ সব কর্মসূচিতে সীমাবদ্ধ থাকবে না। ইতিহাসের পাঠ্যক্রমেও তাঁদের ‘দাপট’ বাড়তে চলেছে বলে আভাস মিলছে।
ছত্রপতি শিবাজি এবং মহারাণা প্রতাপ দীর্ঘ দিন ধরে ভারতের ‘জাতীয়তাবাদী’ রাজনীতিতে ‘পূজিত’। কারণ, তাঁরা মোগল শাসকদের ‘প্রতিস্পর্ধী’ ছিলেন। নরেন্দ্র মোদী জমানায় ‘প্রতিস্পর্ধী’দের সেই তালিকা দীর্ঘতর হচ্ছে। এক দিকে ইতিহাসের পাঠ্যক্রমে মোঘল জমানার গুরুত্ব কমানোর পক্ষে সঙ্ঘপন্থী শিক্ষাবিদদের সওয়াল তীব্র হচ্ছে। অন্য দিকে, মোগলের সমসাময়িক ভারতে স্বতন্ত্র অস্তিত্ব নিয়ে টিকে থাকা বা মাথা তোলা হিন্দু শাসকদের প্রচারের আলোয় আনার চেষ্টা বাড়ছে।
অহোম (অসম) সাম্রাজ্যের সেনাপতি লাচিত বরফুকনের পরাক্রমে মোগল বাহিনী ব্রহ্মপুত্রে ডুবে গিয়েছিল। উত্তর-পূর্ব ভারতে পদার্পণের মোগল আকাঙ্ক্ষায় ইতি পড়েছিল। লাচিত বরাবরই অসমে বন্দিত। কিন্তু অসমের বাইরে তাঁর ‘বীরগাথা’ প্রচার পায়নি। ২০২২ সালে লাচিতের ৪০০তম জন্মবার্ষিকীকে ঘিরে গোটা দেশে লাচিতের কৃতিত্ব প্রচার শুরু হয়। শুধু অসম সরকার নয়, ভারত সরকারও তাতে উদ্যোগী হয়।
শিবাজির জ্যেষ্ঠপুত্র সম্ভাজিকে নিয়েও চর্চা বাড়িয়ে তোলা হয়েছিল পরিকল্পনামাফিক। প্রথমে মহারাষ্ট্রের ঔরঙ্গাবাদ জেলার নাম বদলে করা হয় ‘সম্ভাজিনগর’। তার পরে সম্ভাজির ‘বীরত্ব’ নিয়ে নানা স্তরে চর্চা বাড়ানো হয়। চলতি বছরের শুরুতে সম্ভাজিকে নিয়ে বলিউডে ‘ছাবা’ নামে একটি ছবিও মুক্তি পায়। ছবিটির কাহিনিতে ‘ইতিহাসের বিকৃতি’ রয়েছে বলে বামপন্থী ইতিহাসবিদদের একাংশ সরব হন। কিন্তু বিজেপি-আরএসএস পাল্টা ময়দানে নেমে ইতিহাসবিদদের ওই অংশের বক্তব্য নস্যাৎ করতে সক্রিয় হয়।
এ বার সঙ্ঘ পরিবারের মনোযোগ অহল্যাবাইয়ের প্রচারে। ইনদওরের এই মহারানি তথা রাজমাতার জন্ম ১৭২৫ সালের ৩১ মে। মহারাষ্ট্রের বর্তমান আহমদনগর জেলার একটি গ্রামে সাধারণ পরিবারে তাঁর জন্ম। কিন্তু মরাঠা সুবেদার মলহাররাও হোলকরের পুত্রের সঙ্গে বিবাহের সুবাদে তিনি হোলকর রাজত্বের শাসক হন। তখন মোগল রাজত্ব ক্ষয়িষ্ণু, হীনবল। কিন্তু পশ্চিম ভারতের কিছু স্থানীয় শাসকের বিদ্রোহ অহল্যাবাইকে যুদ্ধের মুখোমুখি দাঁড় করায়। তিনি সে সব যুদ্ধে জিতে রাজত্বের উপরে পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেন। তবে তাঁর সবচেয়ে বড় অবদান হিসাবে মনে রাখা হয়েছে বারাণসীতে বিশ্বনাথ মন্দিরের পুনর্নির্মাণ। ঔরঙ্গজেবের জমানায় শেষ বার আক্রান্ত হয়েছিল বিশ্বনাথ মন্দির। তার পরে অহল্যাবাই তা নতুন করে গড়ে দেন। এখন বারাণসীতে বিশ্বনাথ মন্দিরের যে মূল কাঠামো রয়েছে, তা অহল্যাবাইয়ের নির্মিত।
২০২৫ সালের ৩১ মে অহল্যাবাইয়ের জন্মের ৩০০ বছর পূর্ণ হচ্ছে। গোটা দেশে তা উদ্যাপন করছে বিজেপি। উদ্যাপনের রূপরেখা চূড়ান্ত করেছেন কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব। প্রত্যেক রাজ্যের প্রতিনিধিকে জাতীয় কর্মশালায় ডেকে পাঠিয়ে অহল্যাবাইয়ের জীবন ও কর্মকাণ্ড সম্পর্কে বক্তৃতা করার প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। ২১ মে থেকে ৩১ মে পর্যন্ত এই উদযাপন চলবে। পশ্চিমবঙ্গে এই কর্মসূচির দায়িত্বে প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী দেবশ্রী চৌধুরী। তাঁর কথায়, ‘‘জেলায় জেলায় সেমিনার হবে। আমাদের মহিলা কর্মীদের বোঝানো হবে, সাধারণ ঘর থেকে উঠে আসা মহিলারাও চাইলে রাজনীতিতে কতটা সফল হতে পারেন। সে যুগে মহিলাদের নিয়তি যে শুধু সহমরণ ছিল না, বরং সহমরণে যেতে চাওয়া পুত্রবধূকে নিরস্ত করে শ্বশুর তাঁর হাতে রাজত্ব সঁপে দিচ্ছেন, এমন দৃষ্টান্তও যে ছিল, তা সকলের জানা উচিত।’’
সেমিনারে দেবশ্রী ছাড়াও লকেট চট্টোপাধ্যায়, অগ্নিমিত্রা পাল, মালতী রাভা রায়, সুভাষ সরকার, বিমলশঙ্কর নন্দরা বক্তা হিসেবে থাকবেন। লকেট, অগ্নিমিত্রারা কর্মশালায় গিয়ে প্রশিক্ষণও নিয়ে এসেছেন। অগ্নিমিত্রার কথায়, ‘‘৩০০ বছর আগে একটা সাধারণ ঘর থেকে উঠে আসা এক মহিলা কী ভাবে স্বামী-পুত্রের আচমকা মৃত্যুতে বেসামাল হয়ে পড়া রাজত্বকে একা হাতে সামলে নিয়েছিলেন, কী ভাবে সাধারণ মানুষের মধ্যে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলেন, সে সব জানলে যে কেউ আশ্চর্য হবেন। ওই এলাকার মানুষ এখনও তাঁর নাম উচ্চারণ করার সময় বলেন— পুণ্যশ্লোক অহল্যামাতা।’’ বিজেপি বিধায়কের আরও বক্তব্য, ‘‘আমাদের তো এ সব জানতেই দেওয়া হয়নি। স্কুলে যে ইতিহাস পড়ানো হয়েছে, তার ৭০ শতাংশই তো মোগলের ইতিহাস। অহল্যাবাইদের উল্লেখই নেই।’’
‘ইতিহাস পাঠ্যক্রমে’র কথা অগ্নিমিত্রা ‘কথাপ্রসঙ্গে’ উল্লেখ করেছেন এমন নয়। পাঠ্যক্রমই আসল লক্ষ্য। আরএসএসের সহযোগী হিসেবে শিক্ষানীতি এবং শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে সারা বছর কাজ করে যে সংগঠন, সেই ভারতীয় শিক্ষণ মণ্ডলের (বিএসএম) সর্বভারতীয় সংগঠন সম্পাদক বিআর শঙ্করানন্দের কথায় তা আরও স্পষ্ট হচ্ছে। আনন্দবাজার ডট কমকে শঙ্করানন্দ বলেন, ‘‘আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার সব স্তরে পাঠ্যক্রমের বিকাশ ঘটিয়ে এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে বিশেষ ‘চেয়ার’ প্রতিষ্ঠা করে লোকমাতা অহল্যাবাইয়ের জীবন এবং চিন্তা সম্পর্কে সমাজে শক্তিশালী ভাষ্য প্রতিষ্ঠা করা প্রয়োজন।’’ শুধু অহল্যাবাই নন, বাকি যে সব ঐতিহাসিক চরিত্রকে গত কয়েক বছরে প্রচারের আলোয় আনা হয়েছে, তাঁদের প্রায় সকলের নাম শোনা যাচ্ছে শঙ্করানন্দের মুখে। তিনি বলছেন, ‘‘অহল্যাবাই হোন অথবা লাচিত বরফুকন, সম্ভাজি রাজে, রাজা শশাঙ্ক, বীর বিক্রম কিশোর মাণিক্য— সকল মহাপ্রাণের নামকে বাঁচিয়ে রাখাই রাষ্ট্রীয় পুনরুত্থানের কাজ।’’ পাশাপাশিই তিনি বলেছেন, ‘‘সর্বভারতীয় শিক্ষা সংগঠন হিসেবে আমরা এই চিন্তার রূপায়ণ ঘটাতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।’’ যে সংগঠনের সুপারিশ ২০২০ সালের ‘জাতীয় শিক্ষানীতি’ প্রণয়নের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পেয়েছিল, ‘পাঠ্যক্রম বিকাশে’র বিষয়ে সেই সংগঠনের সর্বোচ্চ নেতার এই মন্তব্য ‘ইঙ্গিতপূর্ণ’।
কেন্দ্রীয় শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী সুকান্ত মজুমদারও এই সব ঐতিহাসিক চরিত্রের ‘গুরুত্ব’কে স্বীকৃতি দিচ্ছেন। তবে মন্ত্রিত্বের বাধ্যবাধকতা থেকে পাঠ্যক্রম সংক্রান্ত মন্তব্যের ক্ষেত্রে তিনি সাবধানি। সুকান্তের কথায়, ‘‘আমাদের দেশে যে ইতিহাস পড়ানো হয়, তা নিয়ে এক কংগ্রেস সাংসদও আমাকে তাঁর আপত্তির কথা জানিয়েছেন। আমি তাঁর নাম বলব না। তিনি দক্ষিণ ভারতের সাংসদ। তিনি বলছিলেন, আমাদের ইতিহাস হল উত্তর ভারতের শাসকদের ইতিহাস। দক্ষিণ ভারতের শাসকদেরও অনেক বড় বড় কৃতিত্ব রয়েছে। এমন মহিলা শাসকেরা দক্ষিণ ভারতে ছিলেন, যাঁরা মোগলদের হারিয়েছিলেন। কিন্তু তাঁদের উল্লেখ ইতিহাসে নেই।’’ দক্ষিণ ভারতের ওই কংগ্রেস সাংসদের সঙ্গে সুকান্তের নিজের অভিজ্ঞতাও মেলে। তাঁর কথায়, ‘‘আমাদের উত্তরবঙ্গে শুক্লধ্বজ বা চিলারায়ের মতো বীরের কথা কোথাও পড়ানো হয় না। উত্তর-পূর্ব ভারতের লাচিত বরফুকনের নাম আমি অনেক বড় হয়ে জেনেছি। যে ইতিহাস স্কুলে পড়ানো হয়, তা যথেষ্ট হলে এ রকম হওয়ার কথা ছিল না।’’
তা হলে কি সরকার ইতিহাসের পাঠ্যক্রম পরিবর্তনের কথা ভাবছে? সুকান্ত সরাসরি তা বলছেন না। তবে তাঁর কথায়, ‘‘ভারতের ইতিহাসে যাঁরা গুরুত্বপূর্ণ ছাপ রেখে গিয়েছেন, তাঁদের কথা ইতিহাসের মাধ্যমে জানার সুযোগ অবশ্যই থাকা উচিত।’’